কার্গিল বিজয়: বরফের শিখরে মুশারফকে যে জবাব দিয়েছিল ভারতীয় সেনা
Kargil War: ক্যাপ্টেন বাত্রা অন্য একজন সৈন্য লেফটেন্যান্ট নবীন আহিরওয়ারকে উদ্ধার করার জন্য বাঙ্কার থেকে বাইরে বের হন, তখনই শত্রুর একটি গুলি সরাসরি ক্যাপ্টেন বাত্রার বুকে লাগে এবং ভারত বীর 'শের শাহ'-কে হারায়।
২২ এপ্রিল ২০২৫. কাশ্মীরের পহেলগাঁও উপত্যকায় সাধারণ ভারতীয় পর্যটকদের হত্যার ঘটনার পর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আবারও তৈরি হয়েছে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মনে আবারও বিক্ষোভের আগুন। ভারতের সাধারণ মানুষজন চাইছেন যেন ভারত সরকার পাকিস্তানকে এই আক্রমণের বিপরীতে যোগ্য জবাব দেয়। পাকিস্তান ও ভারতের এমন আঘাত প্রত্যাঘাতের গল্প তো নতুন নয়। পড়শি দেশের সঙ্গে বরবরই তিক্ততা থেকে গিয়েছে ভারতের। এই নতুন নৃশংস হামলার পরে, ভারত পাকিস্তানকে কী জবাব দেবে, কীভাবে প্রত্যুত্তর দেবে সেই আবহে আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ভারত ও পাকিস্তানের চতুর্থ যুদ্ধ অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের স্মৃতি। কার্গিল যুদ্ধ অবশ্যই পাকিস্তান সেনার অপ্রত্যাশিত অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনীর অদম্য সাহস ও বীরত্বের জ্বলন্ত উদাহরণ।
পহেলগাঁওয়ের বর্তমান প্রেক্ষাপটে কার্গিল যুদ্ধের তাৎপর্য বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য। সেই যুদ্ধে যেমন পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীরা রাতের অন্ধকারে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শৃঙ্গগুলি দখল করেছিল, তেমনই পহেলগাঁওয়ের পরিস্থিতিও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকির ইঙ্গিত বহন করে। কার্গিল যুদ্ধ কেবল সামরিক সংঘাত ছিল না, ভারতের জাতীয়তাবাদের এক শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হয়ে দাঁড়ায় কার্গিলের জয়। এই প্রেক্ষাপটে কার্গিল যুদ্ধের ইতিহাস পর্যালোচনা অত্যন্ত জরুরি। কার্গিলের বিজয়ের পর পাকিস্তান একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ভারতের বিরুদ্ধে আর কোনও সামরিক আক্রমণ করার সাহস দেখাতে পারেনি। এই যুদ্ধের তীব্রতা দেখে আমেরিকাও বিশ্ব মঞ্চে প্রকাশ্যে পাকিস্তানের বিরোধিতা করেছিল।
মুশারফের প্রতিশোধ স্পৃহা
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের জন্য ঐতিহাসিক এই দিনে পাকিস্তান ৯৩,০০০ সৈন্য নিয়ে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং এই সময়েই পাকিস্তান দু'টি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। ভারতীয় সেনার সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে বাংলাদেশ এবং নিজের দেশে ফিরে যেতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সেনা। এই যুদ্ধে পাকিস্তান সেনার এমন অপমান হয়েছিল যা ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি। ভারতের কাছে এই কঠিন পরাজয়ে এক পাকিস্তানি সেনা অফিসার খুবই আশাহত হয়েছিলেন। তিনি পারভেজ মুশারফ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হিটলার জার্মানির পরাজয় দেখে আহত হয়ে, ১৯৩৯ সালে মিত্র দেশগুলোকে হারানোর স্বপ্ন দেখে পুনরায় জার্মানিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুনে ঠেলে দিয়েছিলেন। ঠিক তেমনই, মুশাররফও ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানার ষড়যন্ত্র করতে শুরু করেন।
এরই মধ্যে, ১৯৮৪ সালে ভারত পাকিস্তানকে সিয়াচেনে পরাজিত করে, যা মুশাররফকে আরও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই সময় চিন একটি শক্তিশালী পরমাণু রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছিল এবং পাকিস্তানও চিনের সাহায্যে পরমাণু বোমা তৈরির চেষ্টা করছিল। প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান বিপদ দেখে ১৯৯৮ সালে পোখরানে দ্বিতীয়বার ১১ এবং ১৩ মে তারিখে সফল পরমাণু পরীক্ষা করে ভারত এবং এর কিছুদিন পরেই পাকিস্তানও পরমাণু পরীক্ষা করে। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশই পরমাণু রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর চিন্তিত হয়ে পড়েন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী। তিনি বোঝেন, যদি এই মুহূর্তে দু'টি দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে পরমাণু আক্রমণ করতে শুরু করে, তাহলে সব দিকেই ভয়াবহ ক্ষতি হবে।
এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ১৯৯৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লি থেকে লাহোর বাস যাত্রা করেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সাথে ঐতিহাসিক লাহোর ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন লাহোরে বাস থেকে নামেন, তখন তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। তখনও কেউ জানতেন না, পাকিস্তান সেনার মনে ঠিক কী পরিকল্পনা দানা বাঁধছে।
আরও পড়ুন-আমরা কাশ্মীরের ‘আপনা আদমি’ হতে পারি না?
১৯৯৮ সালে মুশারফ যখন পাকিস্তান সেনার প্রধান হন, তখন তিনি ভারতের বিরুদ্ধে 'অপারেশন বদর' শুরু করার পরিকল্পনা করেন। এই অপারেশনের অধীনে পাকিস্তান সেনার উদ্দেশ্য ছিল ন্যাশনাল হাইওয়ে ১-এ দখল করে সিয়াচেন হিমবাহে ভারতীয় সামরিক অবস্থানের দুর্বলতা সৃষ্টি করা এবং একইসঙ্গে সিয়াচেন থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরবরাহ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা। পাকিস্তান সেনা চেয়েছিল যেভাবে পাকিস্তান বাংলাদেশকে হারিয়েছিল, সেভাবে ভারতও যেন লাদাখ এবং পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয়।
এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য পারভেজ মুশারফ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে না জানিয়েই কার্গিল অঞ্চলে অনুপ্রবেশকারী পাঠাতে শুরু করেন। কার্গিলের বাটালিক টাউনের এক স্থানীয় মেষপালক, তাশি নামগ্যাল, তাঁর হারানো ইয়াক খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। দূরবীন দিয়ে দেখার সময় তিনি পাঠানি পোশাক পরা কিছু লোককে পাহাড়ি অঞ্চলে পাথর ভেঙে বাঙ্কার তৈরি করতে দেখেন, যাদের কাছে অস্ত্রও ছিল। তাশির সন্দেহ হয় যে এরা সম্ভবত নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে এসেছে। তাই তিনি দ্রুত নিকটস্থ ভারতীয় সেনা পোস্টে এই খবর দেন।
এই অনুপ্রবেশের বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের জওয়ানদের পাঠায়, তখন ভারতীয় সৈন্যদের মনে হয়েছিল এই অনুপ্রবেশকারীরা মুজাহিদিন জঙ্গি। কিন্তু ৫ মে পাকিস্তান সেনা কার্গিলে ভারতের একটি গোলাবারুদের ডিপো লক্ষ্য করে হামলা চালায় এবং সেটি ধ্বংস করে দেয়। তখনও ভারতের সেনাবাহিনী বুঝতে পারেনি, এই আক্রমণের পিছনে মুজাহিদিন জঙ্গিরা রয়েছে না কি রয়েছে খোদ পাকিস্তান সেনাবাহিনী। ১০ মে-র পর থেকে পাকিস্তান শুরু করে অপারেশন বদর। পাকিস্তানের দিক থেকে প্রচুর সেনা ভারতের মাশকোহ এবং দ্রাস সেক্টরে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে। গোপন সূত্র থেকে ভারতীয় সেনা খবর পায়, ইতিমধ্যেই পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ১৫০ কিলোমিটার ভিতর পর্যন্ত ঢুকে পড়েছে এবং কার্গিল সহ ভারতের বেশ কয়েকটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ পর্বত শৃঙ্গ এখন পাকিস্তানের হাতে। মাশকোহ উপত্যকার বেশ কয়েকটি উঁচু স্থান, পয়েন্ট ৫৩৫৩, টাইগার শৃঙ্গ সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অংশ চলে গিয়েছিল পাকিস্তানের হাতে। কাগার গ্রাম, বাটালিক রেঞ্জ এবং চোরবাতলার পর্বতচূড়া ও তুর্টুক গ্রামের দক্ষিণ অংশকেও পাকিস্তানি সৈন্যরা অনুপ্রবেশ করে দখল করে নিয়েছিল। এইভাবে অনেক কৌশলগত পর্বতচূড়া পাকিস্তানিদের দখলে চলে গিয়েছিল।
পাকিস্তানের এই অনুপ্রবেশ ছিল ১৯৭১ সালে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তির সরাসরি লঙ্ঘন। তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলি ভুট্টো এবং ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল এই চুক্তি। যখন এই খবর প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর কাছে পৌঁছয়, তখন তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন এবং বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। ভারত সরকার পাকিস্তান সরকারের কাছে এই অনুপ্রবেশের জন্য জবাবদিহি চেয়েছিল, কিন্তু নওয়াজ শরিফ এবং পাকিস্তান সেনা বারবার এই নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করার বিষয়টি অস্বীকার করে এবং বলতে থাকে যে পাকিস্তান সেনা নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করেনি, এটি মুজাহিদিনদের কাজ। তবে পাকিস্তানের এই মিথ্যা বেশিদিন গোপন থাকেনি। শীঘ্রই ভারতের সেনাবাহিনী এই অঞ্চল থেকে পাকিস্তানের বেশকিছু নথি উদ্ধার করে এবং পরিষ্কার হয় যে পুরোটাই ঘটেছিল পাকিস্তানের নির্দেশে। এই খবর সামনে আসার পর চাপে পড়ে যায় পাকিস্তান। আন্তর্জাতিক মহলেও এই অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়ে পাকিস্তান সেনা।
কার্গিল যুদ্ধের সূচনা
ভারত এবং পাকিস্তানের এই সংঘাতে ভারতের প্রথম হতাহতের ঘটনা ঘটে ১৫ মে তারিখে। জাট রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সৌরভ কালিয়া এবং পাঁচজন জওয়ানকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দি করে। এই জওয়ানরা কাকসার এলাকায় টহল দেওয়ার জন্য গিয়েছিলেন, তখনই পাকিস্তান সেনা তাদের উপর হামলা করে। ২২ দিন ধরে এই সৈন্যদের পাকিস্তান সেনা বন্দি করে রাখে এবং চরম নির্যাতন চালায়। এরপর যখন এই জওয়ানদের মৃতদেহ ভারতে ফেরত পাঠানো হয়, তখন ভারতীয় সৈন্যদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সামনে একটাই পথ খোলা ছিল, পাকিস্তানকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়া।
১৯৯৯ সালের ১০ মে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান সেনার বিরুদ্ধে 'অপারেশন বিজয়' শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল কার্গিল এলাকার উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করা এবং পাকিস্তান সেনাকে সেখান থেকে বিতাড়িত করা। সেইজন্য কাশ্মীরের অন্যান্য অংশ থেকে হাজার হাজার সৈন্যকে কার্গিলের দিকে পাঠানো হয়। সেই সময় ভারতের সেনাপ্রধান ছিলেন বেদ প্রকাশ মালিক, যিনি অপারেশন বিজয়ের নেতৃত্ব দেন এবং ১৬,০০০ ফুট উচ্চতায় শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য ভারতীয় সামরিক কৌশলও পরিকল্পনা করেন।
এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম পদক্ষেপ ছিল কার্গিলের খাড়া পাহাড়গুলিতে চড়া, যা চড়তে ১২ থেকে ১৩ ঘণ্টা সময় লাগত। ভারতীয় সেনার প্রধান অসুবিধা ছিল পাকিস্তানের পাহাড়ে অবস্থান।পাকিস্তান থেকে এইসব পাহাড়ে উঠে আসাটা অনেকটাই সহজ কিন্তু ভারত থেকে এই পাহাড়ে চড়া সহজ বিষয় ছিল না। তার মধ্যে আবার পাহাড়ের উপরে অবস্থান করছিল পাকিস্তান সেনা। ফলে ভারতের সেনা জওয়ানরা চড়তে শুরু করলেও পাকিস্তান সেনা তাদের সহজেই দেখতে পেয়ে গুলি চালিয়ে দিত।
এই কারণে ভারতীয় সেনা ঠিক করে তারা রাত্রিবেলায় এই পাহাড়ে চড়বে। কিন্তু অসুবিধা ছিল যে কার্গিলের পাহাড়গুলিতে একদিকে যেমন হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ছিল, তেমনই উপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেনের অভাব দেখা দিচ্ছিল। এমন পরিস্থিতিতে উপরে চড়তে গিয়ে সৈন্যরা হয় নিজেদের সঙ্গে জল ও খাবার নিয়ে যেতে পারত, নয়তো অস্ত্র নিয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করতে পারত। সামান্য ভুল হলেই উপরে বসে থাকা শত্রুরা সহজেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর হামলা করতে পারত।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অপারেশন সফল করার জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সময় তারা যথাক্রমে 'অপারেশন সফেদ সাগর' এবং 'অপারেশন তলোয়ার' শুরু করে। ২৫ মে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি ভারতীয় বিমানবাহিনীকে অপারেশন সফেদ সাগর শুরুর অনুমতি দেয় এবং ২৬ মে ভারতীয় বিমানবাহিনী 'অপারেশন সফেদ সাগর' শুরু করে। বিমানবাহিনীকে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, কোনও অবস্থাতেই যেন তারা নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম না করে।
আরও পড়ুন-জয়শঙ্করের পর এবার রাজনাথ সিংকে ফোন! মার্কিন মধ্যস্থতায় প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা কমবে?
অপারেশন সফেদ সাগর
'অপারেশন সফেদ সাগর' ছিল কার্গিল যুদ্ধে ভারতীয় বিমানবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সেই অভিযান যা কার্গিলের পর্বতচূড়া থেকে পাকিস্তান সেনাকে বিতাড়িত করার জন্য শুরু হয়েছিল। যখন কার্গিল সংঘাত বাড়তে থাকে এবং শত্রুরা কার্গিলের চূড়াগুলিতে বসে ক্রমাগত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্ষতি করতে থাকে, তখন সেনাবাহিনীর ভারতীয় বিমানবাহিনীর সাহায্যের প্রয়োজন হয়। এমন পরিস্থিতিতে বিমানবাহিনী এগিয়ে আসে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। পাকিস্তান সেনাকে ব্যস্ত রেখে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পাহাড়ে চড়ার সুযোগ করে দেয়। এছাড়াও, পাহাড়ের উপরে চড়তে গিয়ে সৈন্যরা বেশি জিনিসপত্র নিয়ে যেতে পারত না বলে বিমানবাহিনী তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও সরবরাহ করত।
শুরুর দিকে সেনাবাহিনী চেয়েছিল, ভারতীয় বিমানবাহিনী শুধুমাত্র তাদের সাহায্য করুক। সেই কারণে বিমানবাহিনী তাদের মিগ-১৭ যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্যের জন্য আসে। কিন্তু, কার্গিলের পাহাড়গুলিতে কৌশলগত কারণে বিমানবাহিনীকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগ বিমানচালক লেফটেন্যান্ট নচিকেতা পাকিস্তান সেনার হাতে ধরা পড়ে যান। পরে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে ৪ জুন তারিখে পাক সেনা তাঁকে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হয়।
নচিকেতার ধরা পড়ে যাওয়ার পর ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের কৌশল পরিবর্তন করে। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আরও সাহায্য করার জন্য ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের অত্যাধুনিক মিগ-২১, মিগ-২৩ এবং মিগ-২৭ ব্যবহার করতে শুরু করে এবং মিরাজ ২০০০-কে লেজার গাইডেড বোমার সাহায্যে নির্ভুল হামলার জন্য ব্যবহার করা হয়। এদের সাহায্যে বিমানবাহিনী শত্রুদের অবস্থানের উপর নজরদারি করে এবং তাদের উপর বিমান হামলা করে ও পাকিস্তান আর্মির অবস্থানের তথ্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে জানায়। এই তথ্যের সাহায্যেই সেনাবাহিনী উন্নত পরিকল্পনার মাধ্যমে শত্রুদের লক্ষ্যবস্তু করে।
অপারেশন সফেদ সাগরের সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন কার্গিল গার্ল নামে পরিচিত ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাহসী পাইলট গুঞ্জন সাক্সেনা। এই অপারেশনেই প্রথমবার যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি নিজের কপ্টার চালিয়েছিলেন এবং তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা পাইলট যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বিমান চালান। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে ভারতীয় জওয়ানদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতেন এবং যুদ্ধে শহিদ হওয়া অনেক ভারতীয় সৈন্যকে পাহাড় থেকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেন।
অপারেশন তলোয়ার
তিন মাস ধরে চলা এই সংঘাতে ভারতীয় নৌবাহিনীও পাকিস্তানকে ঘিরে ফেলছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সমর্থন করতে এবং পাকিস্তানকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলতে নৌবাহিনী এই সময় 'অপারেশন তলোয়ার' শুরু করে, যাতে পাকিস্তান নৌ বাহিনীর সাপ্লাই চেইন বন্ধ করা যায়। অপারেশন তলোয়ারে যদিও পাকিস্তান নৌ বাহিনীর সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করেনি ভারতীয় নৌসেনা। এই অপারেশনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে যুদ্ধ থেকে পিছু হটানো।
১৯৯৯ সালের মে মাসে ভারতীয় নৌবাহিনী তাদের পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চলীয় নৌবহরকে আরব সাগরে সরিয়ে নেয়। ভারতের নৌ শক্তি পাকিস্তানের নৌ শক্তির চেয়ে ৭ গুণ বেশি ছিল। তাই যখন ভারতীয় নৌবাহিনী প্রকাশ্যে তাদের যুদ্ধজাহাজ নিয়ে করাচির আশেপাশে নৌ অবরোধ করে, তখন পাকিস্তান নৌবাহিনী নীরব থাকে। ভারতীয় নৌবাহিনীর কৌশলের কারণে পাকিস্তান এতটাই চাপে পড়ে গিয়েছিল যে তারা তাদের তেল ট্যাঙ্কার এবং প্রধান যুদ্ধজাহাজগুলিকে করাচি বন্দর থেকে সরিয়ে মাকরানে নিয়ে যায়, যাতে ভারতীয় জাহাজের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়া যায়। যদিও 'অপারেশন তলোয়ার'-এ ভারতীয় নৌবাহিনী পাকিস্তানের উপর সরাসরি হামলা করেনি, তবে তারা তাদের এই কৌশলের মাধ্যমে পাকিস্তানের সমুদ্র বাণিজ্য এবং তেল সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছিল। ১৪ জুলাই ভারতীয় নৌবাহিনীর এই অপারেশন শেষ হয় এবং প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী এটিকে এক বিশাল সাফল্য বলে ঘোষণা করেন।
আরও পড়ুন-কার্গিল যুদ্ধে লড়েছিলেন নানা পাটেকর! অবাক করবে অভিনেতার এই অজানা কাহিনি
অপারেশন তোলোলিং
তোলোলিংয়ের যুদ্ধ কার্গিলের উঁচু পাহাড়ের শিখরে সংঘটিত একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ ছিল, যা কার্গিল যুদ্ধে ভারতের জয় প্রায় নিশ্চিত করে দিয়েছিল। এই পাহাড়টিতে পাকিস্তান সেনা আগে থেকেই ঘাঁটি তৈরি করে বসেছিল এবং এখানকার পাহাড়গুলিকে পুনরুদ্ধার করা ভারতীয় বাহিনীর জন্য সবচেয়ে কঠিন ছিল। ১৬,০০০ ফুটের উচ্চতা এবং হিমাঙ্কের নীচে তাপমাত্রা থাকার কারণে ভারতীয় সেনাবাহিনী এই পর্বত চূড়ায় পৌঁছতে পারছিল না। তারই মধ্যে একটা ভুল তথ্য এসে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। ভারতীয় সেনাকে জানানো হয়, এই পাহাড়ে সবমিলিয়ে ৪ থেকে ৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য অবস্থান করছেন। সেই কারণে ভারতীয় সেনা বেশি সংখ্যক ব্যাটেলিয়ান নিয়ে তোলোলিংয়ের লড়াই করতে যায়নি। কিন্তু এই তথ্য পুরোপুরি ভুল প্রমাণিত হয়। ভারতীয় সেনা জানতে পারে, পাকিস্তান সেনার একটা গোটা কোম্পানি তোলোলিংয়ের পাহাড়ে মোতায়েন ছিল। এই পাহাড়ে চড়া সেনা ইউনিটে ১৮ গ্রেনাডিয়ার্স ব্যাটালিয়ন এবং বেশ কয়েকজন অফিসার ছিলেন, যার মধ্যে একজন ছিলেন ক্যাপ্টেন অজিত সিং। কিন্তু একটা ব্যাটেলিয়ান নিয়ে পাকিস্তানের গোটা কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। আরও কয়েকটি ব্যাটেলিয়ান প্রয়োজন লড়াই করার জন্য।
খবর পাওয়ার পর ভারতীয় সেনার মেজর রাজেশ সিং অধিকারী তাঁর ব্যাটেলিয়ান নিয়ে পাহাড়ের উপরে চড়া শুরু করেন। এক দিক থেকে আক্রমণ করছেন ক্যাপ্টেন অজিত সিং, আর অন্য দিক থেকে আসছেন মেজর রাজেশ সিং অধিকারী। মেজর রাজেশ অধিকারী পাকিস্তান সেনার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলেন কিন্তু তখনই অনুপ্রবেশকারীরা তাঁকে দেখে ফেলে এবং তাঁর ব্যাটেলিয়ানের উপরে গুলি চালাতে শুরু করে। এই গুলিতে মেজর রাজেশ অধিকারী শহিদ হন এবং তার দু'জন সঙ্গীও মুখোমুখি লড়াইয়ে শহিদ হন। এরপর পাকিস্তান সেনার দিক থেকে ভারী গুলিবর্ষণ শুরু হয়, যা থেকে বাঁচতে সৈন্যদের পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিতে হয়। সৈন্যরা সামান্য নড়াচড়া করলেই পাকিস্তান সেনার দিক থেকে গুলি চলতে শুরু করত। এর ফলে ভারতীয় সৈন্যদের একটি দল মাঝপথে ফেঁসে যায়। তাদের কাছে গ্রেনেডও প্রায় শেষ হয়ে আসছিল।
এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ৯০ জন সৈন্য নিয়ে পাহাড়ের উপরে ওঠা শুরু করেন কর্নেল রবীন্দ্র নাথ। ১২ জুন তারিখে এই ৯০ জন সেনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছাকাছি পৌঁছয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী সৈন্যদের তিনটি দলে ভাগ করা হয় এবং নাম দেওয়া হয় অর্জুন, ভীম, অভিমন্যু। প্রথম দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সামনে থেকে আক্রমণ করার, দ্বিতীয় দল পিছন থেকে আক্রমণ করবে এবং তৃতীয় দলটি কভার ফায়ার করবে। পিছন দিক থেকে যে দলটি পাকিস্তান সেনের উপর আক্রমণ শুরু করেছিল সেই দলের মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মেজর বিবেক গুপ্তা। পাকিস্তান সেনার সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে মেজর বিবেক গুপ্তা এবং তাঁর ৬ জন সৈন্য শহিদ হন কিন্তু এই সকল সৈন্যদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। ৪ ঘণ্টা টানা যুদ্ধের পর ভারত তোলোলিংয়ের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে।
সরাসরি পাকিস্তানি সেনার সঙ্গে লড়াইয়ের মধ্যেই লড়াই শুরু হয়ে যায় প্রশাসনিক স্তরেও। ১৩ জুন ১৯৯৯, ভারত তোলোলিংয়ে একটি বড় বিজয় অর্জন করে। ঠিক তার পরেই ১৫ জুন পাকিস্তানের ডুবন্ত নৌকা বাঁচাতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ আমেরিকার দ্বারস্থ হন যুদ্ধবিরতির আর্জি নিয়ে। পাকিস্তান কিন্তু কখনই জানায়নি যে তারা সরাসরি এই যুদ্ধ করছে, তারপরেও পাক প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধবিরতির আর্জি নিয়ে যান। এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন এবং সিদ্ধান্ত নেন আমেরিকা ভারতের পাশে থাকবে। ফলে, এদিকেও সমস্যা হয়ে যায় পাকিস্তানের।
পয়েন্ট ৫১৪০ এর যুদ্ধ - শেরশাহ বিক্রম বাত্রার ভূমিকা
তোলোলিংয়ে সাফল্যের পর ভারতীয় সেনারা আর থামতে চাননি। এরপর তোলোলিংয়ের উত্তরে আরেকটি উঁচু পাহাড় ছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল পয়েন্ট ৫১৪০। এর উচ্চতা ছিল ১৭ হাজার ফুট। এছাড়াও তোলোলিং এবং পয়েন্ট ৫১৪০-এর মধ্যে ১০টি উঁচু স্থান ছিল, যাদের 'হাম্পস' বলা হতো। ভারতীয় সেনাবাহিনী এই হাম্পসগুলি দখল করে নিয়েছিল কিন্তু পয়েন্ট ৫১৪০ পুনরুদ্ধার করা তখনও বাকি ছিল। এটি পুনরুদ্ধার করার দায়িত্ব লেফটেন্যান্ট কর্নেল যোগেশ কুমার জোশীকে দেওয়া হয়েছিল। এরপর সৈন্যদের দু'টি দল গঠন করা হয়, যার একটি দলের নেতৃত্ব লেফটেন্যান্ট সঞ্জীব সিং জামওয়ালকে দেওয়া হয় এবং অন্য দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট বিক্রম বাত্রা, যাঁর কোড নাম ছিল শের শাহ। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল পাহাড়টিকে দু'টি ভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করা। ২০ জুন দু'টি দলই পাহাড়ে চড়া শুরু করে এবং দু'জনই এই অভিযানে সফল হয়। বিক্রম বাত্রার নেতৃত্বে তাঁদের দল সম্মুখ হামলা চালায় এবং হাতাহাতি লড়াইয়ে তিনি একাই চারজন শত্রুকে খতম করেন। কয়েক ঘণ্টার ভারী লড়াইয়ের পর ভারতীয় সৈন্যরা পয়েন্ট ৫১৪০ দখল করে নেয় এবং তাদের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে বিক্রম বাত্রা 'ইয়ে দিল মাঙ্গে মোর' সংকেতও দেন। পয়েন্ট ৫১৪০-এর বিজয় ভারতের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক জয় ছিল। এই পয়েন্ট থেকে পাকিস্তানের অনেক নথিও উদ্ধার করা হয়েছিল, যা প্রমাণ করে যে এই যুদ্ধে পাকিস্তান নিজেদের সম্মান বাঁচানোর জন্য কেবল মিথ্যা কথাই বলে চলেছিল।

ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা
পয়েন্ট ৫১৪০-এর পরাজয়ের পর পাকিস্তান সেনা আরও কোণঠাসা হয়ে উঠতে শুরু করে। ২ জুলাই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আবারও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের কাছে সাহায্য চান কিন্তু, ক্লিনটন সরাসরি জানিয়ে দেন, এই ইস্যুতে আমেরিকা কোনওভাবেই পাকিস্তানকে সমর্থন করবে না এবং লাইন অফ কন্ট্রোল থেকে পাকিস্তানকে সেনা সরাতে হবে। এরপর ৪ জুলাই আমেরিকান রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনের সঙ্গে বৈঠকের পর নওয়াজ শরিফ নিয়ন্ত্রণ রেখা থেকে সেনা সরাতে রাজি হন।
টাইগার হিল দখল ও দ্রাসের পুনরুদ্ধার
৪ জুলাই কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তান যুদ্ধ থেকে পুরোপুরিভাবে সরে যায় এবং ভারতীয় সেনা টাইগার হিল দখল করতে সক্ষম হয়। ১৭ হাজার ফুটের থেকেও উঁচু এই শৃঙ্গটি প্রযুক্তিগতভাবে ভারতীয় সেনার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি শৃঙ্গ ছিল কারণ, এখান থেকে দ্রাস অঞ্চলকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এই চূড়ায় বসে থাকা সৈন্যরা দ্রাসের প্রতিটি ছোট-বড় কার্যকলাপের উপর নজর রাখতে পারত। ৩ জুলাই ভারতীয় সৈন্যরা পুনরায় টাইগার হিল পুনরুদ্ধারের জন্য কৌশল তৈরি করে। এই কাজটি ১৮ গ্রেনাডিয়ার্স এবং ৮টি শিখ রেজিমেন্টকে দেওয়া হয়। এর আগে ভারতীয় বিমানবাহিনী ২ জুলাই শত্রুদের ঘাঁটিগুলির উপর নজরদারি শুরু করেছিল। ৩ জুলাই রাতে ভারতীয় সৈন্যরা টাইগার হিলের দিকে চড়া শুরু করে। যেহেতু টাইগার হিলের একটি দিক সম্পূর্ণরূপে খাড়া ছিল, তাই ভারতীয় সেনাবাহিনী কৌশল তৈরি করে তারা বহু দিক থেকে আক্রমণ করবে, অর্থাৎ সৈন্যদের গ্রেনেডিয়ার দল খাড়া দিক থেকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে অনুপ্রবেশকারীদের হতভম্ব করে দেবে, তেমনই ৮ শিখ রেজিমেন্ট সামনে থেকে আক্রমণ করে তাদের অভিযান সম্পন্ন করবে।
১৮ গ্রেনাডিয়ার্সের দলটি দল দড়ি এবং পর্বতারোহণের সরঞ্জাম ব্যবহার করে এই অভিযান সম্পন্ন করে। এতে ১৮ গ্রেনাডিয়ার্সের ব্যাটেলিয়ানকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লেফটেন্যান্ট বলবন্ত সিং। তিনি সাড়ে চারটার মধ্যে টাইগার হিলে পৌঁছে শত্রুদের হতভম্ব করে দেন। অন্যদিকে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর ভারী আর্টিলারি শেলিং এবং বিমান হামলায় শত্রুদের অবস্থা আগেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যখন হাতাহাতি যুদ্ধ হয়, তখন শত্রুরা তাদের ১২ জন সঙ্গীকে হারায় এবং ভারতের দিক থেকে ছয়জন হতাহত হয়। আহত সৈন্যদের মধ্যে একজন ছিলেন ১৯ বছর বয়সী যোগেন্দ্র সিং যাদব, যিনি স্বেচ্ছায় এই মিশনে যাওয়ার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। তিনি রোপ লিড করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শত্রুরা তাদের সম্পর্কে জানতে পারে এবং তারা মেশিনগান ও রকেটের গুলিবর্ষণে তাঁকে আহত করে। আহত অবস্থায়ও তিনি তার চড়া অব্যাহত রাখেন এবং শত্রুদের উপর গ্রেনেড ছুঁড়ে চারজনকে খতম করেন। সঙ্গীদের সঙ্গে মিলে অন্য বাঙ্কারটিও লক্ষ্য করেন। তার সাহসিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাকি সৈন্যরাও উৎসাহিত হয়, পরে সবাই টাইগার হিলে বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুন-ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: কাশ্মীর বৈরিতার যে ইতিহাসে দাঁড়ি পড়েনি আজও
শেষ মিশন - পয়েন্ট ৪৮৭৫
১৯৯৯ সালের ৭ জুলাই ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার নেতৃত্বে জম্মু ও কাশ্মীর রাইফেলসকে পয়েন্ট ৪৮৭৫ দখল করার জন্য পাঠানো হয়। এই মিশনে তাঁর বাকি সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন অনুজ নায়ার। ক্যাপ্টেন বাত্রা এই অভিযানে শত্রুদের ধূলিসাৎ করে দেন। শরীরে গুলি লাগা সত্ত্বেও তিনি শত্রুর দিকে এগিয়ে যান এবং গ্রেনেড ছুঁড়ে শত্রুদের পরাজিত করেন। ৭ জুলাই অভিযান প্রায় সম্পন্ন হয়েই গিয়েছিল। ভারত পয়েন্ট ৪৮৭৫-এ বিজয় ঘোষণা করার জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু এরই মধ্যে ক্যাপ্টেন বাত্রা অন্য একজন সৈন্য লেফটেন্যান্ট নবীন আহিরওয়ারকে উদ্ধার করার জন্য বাঙ্কার থেকে বাইরে বের হন, তখনই শত্রুর একটি গুলি সরাসরি ক্যাপ্টেন বাত্রার বুকে লাগে এবং ভারত বীর 'শের শাহ'-কে হারায়। ভারত ৪৮৭৫-এর দখল নিলেও, এই যুদ্ধে ভারত তার এক বীর সেনা যোদ্ধাকে হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর রাইফেলসের ১৩তম ব্যাটালিয়নের ২৪ বছর বয়সি ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা এই যুদ্ধে জয়ী হলেও, একজন আহত সঙ্গীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। পয়েন্ট ৪৮৭৫ এখন 'বাত্রা টপ' নামে পরিচিত।
পয়েন্ট ৪৮৭৫-এর যুদ্ধের সঙ্গেই কার্গিলে ভারতের জয়ও নিশ্চিত হয়ে যায়। একদিকে যেখানে ভারত দ্রাসের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়, তেমনই ৭ জুলাই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাটালিক সেক্টরে জোবার হাইটসও দখল করতে সক্ষম হয়। বাটালিক-তুর্ক সাব সেক্টর, যা সিয়াচেনের কাছে অবস্থিত, সেটিও ভারতীয় সেনাবাহিনী নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। যুদ্ধে ভারতের এই আধিপত্য পাকিস্তানকে যুদ্ধে পিছিয়ে যেতে বাধ্য করছিল এবং এরই ফলস্বরূপ ১১ জুলাই পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা বাটালিক সেক্টর থেকে পিছু হটতে শুরু করে। একই সঙ্গে ১২ জুলাই আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সৈন্যদের পুরো কার্গিল থেকে পিছু হটতে হয়। পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে, পাকিস্তান নিজেদের সেনাবাহিনীর সদস্যদের মৃতদেহ পর্যন্ত নিজের দেশে ফেরত নিয়ে যেতে চায়নি। ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী 'অপারেশন বিজয়'-কে বিশাল সাফল্য বলে ঘোষণা করেন। এরপর ভারতীয় বিমান বাহিনী একটি সার্চ অপারেশন চালায় এবং ১২ দিনের দীর্ঘ এই অপারেশনের পর ২৬ জুলাই ভারতীয় বিমানবাহিনী ও সেনাবাহিনী ঘোষণা করে কার্গিল থেকে অনুপ্রবেশকারীরা সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত হয়েছে। সেই কারণেই ২৬ জুলাই দিনটি সারা ভারতে কার্গিল বিজয় দিবস হিসেবেও পালন করা হয়।
এই পরাজয়ে ক্ষুব্ধ পারভেজ মুশারফ অক্টোবর মাসে নিজের দেশের সংবিধান স্থগিত করে দেন। তিনি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন এবং প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হন। কার্গিলে জয়ের জন্য ভারতকে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা, লেফটেন্যান্ট মনোজ কুমার পাণ্ডে, মেজর রাজেশ সিং অধিকারী এবং মেজর বিবেক গুপ্তার পাশাপাশি শত শত সাহসী জওয়ানকেও হারাতে হয়েছে। যুদ্ধের পর ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা, লেফটেন্যান্ট মনোজ কুমার পাণ্ডে, মেজর রাজেশ সিং অধিকারী, মেজর বিবেক গুপ্তা, রাইফেলম্যান সঞ্জয় কুমার এবং গ্রেনাডিয়ার যোগেন্দ্র যাদবকে ভারতের সর্বোচ্চ বীরত্ব পুরস্কার পরমবীর চক্রে সম্মানিত করা হয়। কার্গিলের উঁচু চূড়াগুলি আজও শহিদদের বীরত্বের কাহিনি শুনিয়ে শান্তভাবে ভারতের সীমান্ত রক্ষা করে চলেছে।