রয়েছে আইনি কড়াকড়ি, ধরপাকড়ও চলছে দেদার, তবুও কেন দিনদিন আসামে বেড়ে চলেছে বাল্যবিবাহ?
Child Marriage increasing Assam : আজকে আবার স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে, কেন এই ‘বাল্য বিবাহ’ নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে? কেন এই দেশেরই একটি অঙ্গরাজ্যে এই সমস্যা নিয়ে সেই রাজ্যের সরকার এতো চিন্তিত হয়ে পড়েছে, গ্রেপ্তার করা হচ...
গত কিছুদিন ধরে, অসমে ভয়ানক পরিস্থিতি। থানা থেকে শুরু করে সরকারি হাসপাতালে উপচে পড়ছে ভীড়। স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে, বিবাহ যোগ্য মহিলারা, যাঁরা সন্তানসম্ভবা, তাঁরা যেন অবিলম্বে, নিজেদের নাম নথিভুক্ত করিয়ে নেন। যদি কোনও মহিলা, এই নাম নথিভুক্ত করান, তখন খোঁজ করা হচ্ছে, সেই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের, তারপরে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গত কয়েকদিনে, আসামে এই কারণে প্রায় আড়াই হাজার যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই নির্দেশিকার পরবর্তীতে ১৮র কমবয়সী মহিলারা ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে, নিজেরা বাড়িতেই প্রসবের ব্যবস্থা করছেন নয়তো গর্ভপাত করিয়ে নিতে চাইছেন। যাঁদের পরিবারের পুরুষেরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, সেই মহিলাদের মধ্যে কারও কোলে সদ্যজাত শিশু, কেউ সন্তানসম্ভবা। তাঁরা বিভিন্ন থানায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, যাতে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার নির্দেশে এই ‘বাল্য বিবাহ’ বন্ধ করার প্রক্রিয়া চলছে। এই গ্রেপ্তারি নিয়ে ইতিমধ্যেই সারা অসমে চর্চা শুরু হয়েছে। সবার অলক্ষ্যে না ঘটলেও, এই ঘটনাটির কিন্তু দেশের সমস্ত রাজ্যেই কমবেশী প্রভাব আছে।
‘বাল্য বিবাহ’ নিয়ে কথা বলতে গেলে, প্রথমেই যে মানুষদের কথা মাথায় আসে, তাঁরা হলেন, রাজা রামমোহন রায় এবং বিদ্যাসাগর। সতীদাহ প্রথা, বিধবা বিবাহ এবং ‘বাল্য বিবাহ’ রোধে তাঁর এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লড়াই আজও আমরা স্মরণ করি। একদিকে হিন্দু সমাজের মধ্যে যখন এই লড়াই চালাচ্ছিলেন বেঙ্গল রেনেসাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত এই মানুষজন, তখন মুসলমান সমাজে এই লড়াই শুরু করেন বেগম রোকেয়া। মুসলমান নারীদের কীভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটানো যায়, সেইদিকে যেমন উদ্যোগী হয়েছিলেন, কীভাবে মুসলমান নারীদের বেশ কিছু প্রচলিত নিয়মকানুন থেকে বের করে আনা যায়, সেই লক্ষ্যেও কাজ করেছিলেন। সেই সময়কার এই সমস্ত মনীষীদের অদম্য প্রচেষ্টার ফলে বন্ধ হয়েছিল বেশ কিছু মধ্যযুগীয় কুপ্রথা।
আরও পড়ুন - নিষিদ্ধপল্লিতে পরের পর হত্যা, কলকাতার ত্রাস হয়ে উঠেছিল এই নারী
আজকে আবার স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পরে, কেন এই ‘বাল্য বিবাহ’ নিয়ে আলোচনা করতে হচ্ছে? কেন এই দেশেরই একটি অঙ্গরাজ্যে এই সমস্যা নিয়ে সেই রাজ্যের সরকার এতো চিন্তিত হয়ে পড়েছে, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে কিশোরদের? তথ্য বলছে, দেশের মধ্যে মেটারনাল মর্টালিটি রেট, অর্থাৎ মায়েদের মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশী আসামে। যদিও গত পাঁচ বছরে, শিশু মৃত্যু কিছুটা হলেও কমেছে, কিন্তু জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্যের রিপোর্ট অনুযায়ী, এক বছরের আগে শিশু মৃত্যু হার দেখাচ্ছে, একহাজার জনের মধ্যে ৩১ টি শিশু মারা যায় শুধুমাত্র আসামেই। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী যে সময়ে, দেশে দেখা যাচ্ছে প্রায় ২৫ শতাংশ মহিলার প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, সেই সময়ে অসমে এই সংখ্যা ৩২ শতাংশ। এই তথ্য দেখলে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, সমস্যা অনেক গভীরে। কোভিডের পরবর্তীতে দেশে কাজ হারানো মানুষের এই সংখ্যা অনেক বেশী। তার ওপরে মাথার ওপর বেনাগরিক হওয়ার খাঁড়া এনআরসি ঝুলছে। ইতিমধ্যেই ১৯ লক্ষ মানুষের নাম বাদ পড়েছে। যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁরা সর্বসান্ত হয়েছেন, আইন-কানুনের মারপ্যাঁচ সামলাতে সামলাতে। বেশীরভাগ পরিবারের মানুষজন আর কন্যা সন্তানদের ঘরে বসিয়ে খাওয়াতে আগ্রহী নয়, তাই তাঁরা যত দ্রুত সম্ভব, কন্যা সন্তানদের দায় ঘাড় থেকে ফেলে দিতে চাইছেন। পুরো বিষয়টি একটি রাজনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যা, এবং তার সমাধান হওয়াও উচিৎ মানবিকভাবে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী যেভাবে, নাবালিকা বিয়ে করার জন্য, ঐ কিশোরদের ওপরে পকসো এবং অন্যান্য ধারা প্রয়োগ করছেন, যেভাবে প্রহিবিশন অফ চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট দিয়ে ঐ কিশোরদের হেনস্থা করছেন, তা দিয়ে কিন্তু এই সমস্যা সমাধানে সঠিক রাস্তা খুলবে না।
যে রাজ্য এবং দেশে এখনও দারিদ্র আছে, যেখানে মহিলাদের সচেতনতা এবং শিক্ষার হার কম, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাই এখনও বহু মানুষের কাছে পৌঁছয়নি, সেখানে এই ধরনের অপরাধে যদি কিছু কিশোরকে গ্রেপ্তার করে, তাঁদের ক্রিমিনাল বানিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে কি এই সমস্যার সমাধান হতে পারে? বুলডোজার একটা সংস্কৃতি, বুলডোজার একটা মানসিকতা, তা দিয়ে হয়তো অপরাধীকে দুরমুশ করে দেওয়া যায়, কিন্তু অপরাধ কি কমে? তথ্য বলছে, প্রসুতি মায়েদের স্বাস্থ্যের মাপকাঠিতেও আসামের স্থান, জাতীয় গড়ের পিছনে। মহিলাদের উন্নয়নের ক্ষেত্রেও অসমের অবস্থা বেশ খারাপ। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মহিলাদের এক পঞ্চমাংশ আজ অবধি স্কুলে যায়নি। অসমে ৩০ শতাংশেরও কম এই বয়সী মহিলারা দশম শ্রেণী অবধি পড়াশুনা করেছেন, যেখানে জাতীয় গড় এক্ষেত্রে ৪১, যার ফলে রাজ্যের কর্মক্ষম মানুষদের মধ্যেও মহিলাদের সংখ্যা কমেছে। জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্যের রিপোর্ট বলছে, অকৃষি ক্ষেত্রে, যেখানে পুরুষদের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ, সেখানে মহিলদের সংখ্যা মাত্র ১৭। দেখা গেছে, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ২০ শতাংশ মহিলারা স্কুলের মুখ না দেখেও সন্তানের জননী হয়ে গেছেন। ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী, হিন্দুদের মধ্যে ‘বাল্য বিবাহে’র হার মুসলমানদের থেকে বেশী, তাহলে কেন শুধু মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু বানানো হবে? এদিকে নরেন্দ্র মোদী তাঁর ‘বেটি পড়াও বেটি বাঁচাও’ শ্লোগানকে সামনে রেখে নিজের প্রচার করে চলেছেন, ওদিকে মহিলারা যেই তিমিরে থাকার সেই তিমিরেই রয়ে যাচ্ছেন। অসমের সরকার ও নানান সময়ে এই সংক্রান্ত প্রোগ্রাম নিয়েছেন, যাতে মহিলাদের সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু তাতেও খুব বেশী লাভ হয়নি।
আরও পড়ুন - বাংলার বীভৎসতম হত্যা! টিকিট কেটে ১৮৭৩ সালের পরকীয়া মামলার শুনানি দেখেছিল মানুষ
যেদিন সরকার তিন তালাক আইন রদ করেছিল, সেদিনও তাঁদের মাথায় ছিল কীভাবে মুসলমান পুরুষদের অপরাধী বানানো যায়, একটি খারাপ প্রথা বন্ধের জন্য আগে প্রয়োজন ছিল সামাজিক স্তরে সেই সমস্যা নিয়ে আলোচনা চালানো, তা না করে, পুলিশ প্রশাসন দিয়ে যদি ‘তিন তালাক’ বলে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চাওয়া কোনও মুসলমান পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাহলে সেই সমস্যার সমাধান হয় কি? আজকেও অসমে যখন ‘বাল্য বিবাহ’ করার জন্য সেই রাজ্যের কম বয়সী কিশোরদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, তখন কি সরকারের আদৌ এই সমস্যার সমাধানের কোনও উদ্যোগ আছে বলে মনে হচ্ছে? এই গ্রেপ্তারির পরে আরো যে সমস্যা তৈরী হতে পারে, সেই সম্পর্কেও কোনও ধারণা ছিল না বলেই আরো সমস্যাটা নিয়ে সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে ভাবা উচিৎ। যে কিশোরদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেই পরিবারে সেই মানুষটিই হয়তো একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি, তাঁদের স্ত্রীদের কেউ হয়তো সন্তানসম্ভবা, আবার কারও কোলে একদম ছোট বাচ্চা। তাঁদের মধ্যে অনেকে অঞ্চলের থানায় গিয়ে বিক্ষোভও দেখাচ্ছেন, তাঁদের স্বামীদের মুক্তির দাবীতে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, কেঁদেকেটে কোনও লাভ নেই, তিনি তাঁর অবস্থানে কঠোর থাকবেন। যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁরা যেহেতু আইনত অপরাধী, তাঁদের মুক্তি দেওয়ার প্রশ্নই নেই। সেই একই বুলডোজার নীতি, সেই একই তিন তালাকের বন্ধের সময়কার নীতি।
অথচ রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে কি এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করা যেত না? যে প্রক্রিয়া এই রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরা নিচ্ছেন, তার মধ্যে দিয়ে হয়তো অপরাধী কমতে পারে, কিন্তু অপরাধ কি কমবে? কি কারণে, বাবা- মায়েরা কম বয়সে তাঁদের কন্যা সন্তানদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন, সেই কারণ খোঁজা কি বেশী জরুরী নয়? কোভিড সময়কালের পরে এবং এনআরসির আতঙ্কের পরে, কেন মানুষজন তাঁদের পরিবারের কন্যা সন্তানদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাইছেন, সেই বিষয়ে তো রাজনৈতিক মাথাদেরই ভাবতে হবে।

Whatsapp
