সিগারেটের ছ্যাঁকা থেকে বেধড়ক মার! ব়্যাগিংয়ের নামে যা চলে দেশের এই কলেজ-হস্টেলে...
Ragging Horror: অন্য এক প্রাক্তন পড়ুয়ার অভিজ্ঞতা আরও ভয়ঙ্কর। একবার ব়্যাগিংয়ের সময় অনুপস্থিত থাকার কারণে তার উপর মারাত্মক যৌন অত্যাচার চালায় সিনিয়রেরা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া স্বপ্নদীপের রহস্যজনক মৃত্যু ঘিরে দিন দুয়েক ধরে তোলপাড় বাংলা। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হস্টেলের তিনতলা থেকে পড়ে মৃত্যু হয় বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্বপ্নদীপ। আত্মহত্যা না খুন, এই তরজার মধ্যেই সামনে এসেছে ব়্যাগিংয়ের তত্ত্ব। হস্টেলের কয়েকজন আবাসিকের বিরুদ্ধে রুজু করা হয়েছে খুনের অভিযোগ। গ্রেফতার করা হয়েছে এক প্রাক্তনীকেও। স্বাভাবিক ভাবেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় নিন্দার, দাবি শাস্তিরও। অনেক পড়ুয়াই অভিযোগ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে মারাত্মক ব়্যাগিংয়ের সংস্কৃতি চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। রাত বাড়লেই শুরু হয় অত্যাচার। উঁচু ক্লাসের দাদা-দিদিদের খিদমত খাটা থেকে শুরু করে নানা রকম ভাবে হেনস্থা করা হয় সদ্য হস্টেলে আসা পড়ুয়াদের। এটাই যেন দস্তুর। বহু সময়েই সেই হেনস্থা মানসিক থেকে শারীরিক হয়ে পড়ে। মারধর থেকে যৌনহেনস্থা- চলে সমস্ত কিছুই।
আরও পড়ুন: যাদবপুরের র্যাগিং সংস্কৃতি: মুখে বিপ্লব বুলি, রাত বাড়লেই শুরু দাদাগিরি
স্বপ্নদীপের শরীরেও মিলেছে একাধিক কালশিটে, ক্ষতের দাগ। মাত্র দিন কয়েক আগেই হস্টেলে এসেছিল ছেলেটা। রীতিমতো যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে যাদবপুরের মতো বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিয়েছিল স্বপ্নদীপ। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের যাদবপুর-বাসই প্রাণঘাতী হয়ে দেখা দিল স্বপ্নদীপের জন্যে। কলেজে পড়ার স্বপ্ন, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল তাঁরা। মারা গেল নদীয়ার ছেলে স্বপ্নদীপ। শুধু কি স্বপ্নদীপ। এমন ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও একাধিক বার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলের আবাসিকদের বিরুদ্ধে ব়্যাগিংয়ের অভিযোগ এনেছেন পড়ুয়ারা। সেই সব অভিযোগে জমেছে পলি সময়মাফিক। এক বছর আগেই খড়গপুরে এক ছাত্রের রহস্যজনক দেহ উদ্ধার হয়েছিল হস্টেলের ঘর থেকে। ঘটনায় সামনে এসেছিল ব়্যাগিংয়ের ভয়ানক রূপ।
এ যেন কোনও নতুন কথা নয়। দেশের বেশিরভাগ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে পড়তে আসা পড়ুয়াদের কাছেই এক আতঙ্কের নাম ব়্যাগিং। মফসসল থেকে আসা নতুন ছেলেটি শহরে মানিয়ে নিতে পারবে তো, পড়াশোনা করতে পারবে তো এই শঙ্কার থেকে বড় হয়ে উঠছে ক্রমশ বেঁচে ফিরতে পারবে কিনা সেই প্রশ্ন। নানা আইনি কাগজপত্র, হলফনামা সত্ত্বেও কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি লাগাম লাগাতে পারছে না এই অর্থহীন ব়্যাগিং সংস্কৃতিতে। আদৌ কি প্রথমবর্ষের পড়ুয়াদের এই ভাবে হেনস্থা, কোণঠাসা করার মাধ্যমে কোনও মোক্ষলাভ হয় উঁচুক্লাসের পড়ুয়াদের। এই ভয়ের আবহ কি সত্যিই সম্ভ্রম বাড়ায় সিনিয়রদের প্রতি, যা কথা বলে, বন্ধুত্বপূর্ণ সদ্ভাব রেখে সম্ভব হয় না! এই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় কারওর কাছে নেই। যারা ব়্যাগিং করেন, তাঁদের কাছেও নেই। শুধুমাত্র ধারাবাহিক ভাবে চলে আসা একটি নোংরা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা হয় এক প্রবল আক্রোশ থেকে। অদ্ভুত ভাবে এর নেপথ্যে লুকিয়ে থাকে বিকৃত এক অহং বোধ, যা কানে কানে বলে 'আমাদের সঙ্গে যা হয়েছে, ওদের সঙ্গে হবে না-ই বা কেন!' এ-ও আসলে এক প্রতিহিংসা, যা এই সংস্কৃতিকে বছরের পর বছর ধরে বাঁচিয়ে রেখে আসছে।
হস্টেলের ব়্যাগিং প্রাণ কেড়েছে স্বপ্নদীপের। এমন অজস্র পড়ুয়া রয়েছেন, যাঁরা ব়্যাগিং সহ্য করে কোনওমতে টিকে গিয়েছেন, পড়াশোনা শিখে চাকরিবাকরিও করছেন, জীবনে দাঁড়িয়েছেন, কিন্তু ওই ব়্যাগিংয়ের কয়েকটা রাত, কয়েকটা দিন তাঁদের ভিতরে ছেড়ে গিয়েছে এক গভীর ক্ষত। যা সারাজীবন তাড়া করে বেড়ায় তাদের। স্বাভাবিক সম্পর্ক, স্বাভাবিক জীবনের পথে জেগে থাকে কাঁটার মতো। থ্রি ইডিয়টস সিনেমায় কৌতুকে মুড়ে ব়্যাগিংয়ের সেই ভয়ঙ্কর রূপ পরিবেশিত করেছিলেন পরিচালক। যেখানে নবাগত পড়ুয়াদের অন্তর্বাস নিয়ে টানাটানি করা হয়। তবে এ সব শুধুই সিনেমা নয়। আদতে এর চেয়েও ভয়ঙ্কর অনেক কিছুই ঘটে হস্টেল-জীবনে। এমন অভিজ্ঞতা অনেকেই ভাগ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই সব ব্যক্তির অভিজ্ঞতা আদতে শিউড়ে ওঠার মতোই।
ভারতেরই একটি কলেজের ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে আসা প্রাক্তন পড়ুয়ারা জানিয়েছেন তাঁর কলেজ ভোটের অভিজ্ঞতা। যেখানে ভোট প্রচারের জন্য অদ্ভুত সব জিনিস ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হল জুনিয়রদের। এমনকী বাদ যেত না গোপনাঙ্গও। কে কত বেশি ভোট জোগার করে আনতে পারবে তাঁদের নেতাদের জন্য। তার জন্য দেওয়া হত অদ্ভুত সব কাজের নির্দেশ। কখনও অন্তর্বাস সরিয়ে, তো কখনও যৌনাঙ্গে টর্চের আলো মেরে নানা ভাবে অত্যাচার করা হত ফ্রেশার্সদের। আর তার মাধ্যমেই আশ্চর্য নারকীয় আনন্দ খুঁজে পেতেন সিনিয়রেরা।
এখানেই শেষ নয়। একবার এক পড়ুয়াকে বাধ্য করা হয় সকলের সামনে লিঙ্গত্থানের জন্য। নির্দেশ অনুয়ায়ী কাজ না-করতে পারলেই জুটত মার, গালাগালি। আলাপ-পরিচয়ের নামে এমনই ভয়ঙ্কর সব ব়্যাগিং চলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলিতে। তার মধ্যে রয়েছে ভারতের সেরা কয়েকটি কলেজও।
আরেক জন প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া জানিয়েছেন, তাঁর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। পশ্চিমবঙ্গেরই একটি কলেজের প্রাক্তন পড়ুয়া জানিয়েছেন, ব়্যাগিংয়ে তাঁদের বাধ্য করা হয়েছিল, একে অপরের লিঙ্গের মাপ জেনে সেই দিয়ে একটি তালিকা বানানোর জন্য। সেই কাজ না-করতে পারলে জুটত আরও কঠোর শাস্তি। ভয়ঙ্কর অস্বস্তি আর লজ্জা নিয়ে তাঁরা বাধ্য হয়েছিলেন এমন একটি কাজ করতে। সেই লজ্জা আজও পিছু ছাড়েনা তাঁকে।
অন্য এক প্রাক্তন পড়ুয়ার অভিজ্ঞতা আরও ভয়ঙ্কর। একবার ব়্যাগিংয়ের সময় অনুপস্থিত থাকার কারণে তার উপর মারাত্মক যৌন অত্যাচার চালিয়েছিল সিনিয়রেরা। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওই ছাত্র জানান, তাঁকে নগ্ন করে তাঁর নিতম্বে গুঁজে দেওয়া হয় জ্বলন্ত সিগারেট। এখানেই শেষ নয়, ঢুকিয়ে দেওয়া হয় পেনসিলও। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ও রক্তপাতে তিনি পরিত্রাহী চিৎকার করলেও তাঁকে বাঁচাতে আসেননি একজনও। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়েছিল তাঁকে। সিনিয়ররা শাসিয়েছিল, ঘটনার কথা কাউকে জানালে আরও মারাত্মক পরিণতি হবে তাঁর। ভয়ে লজ্জায় সেদিন কাউকে কিছু বলতে পারেননি। কিন্তু সেই ঘা, সেই যন্ত্রণা আজও যেন দগদগে তাঁর মাথায়।
আরও পড়ুন: ‘দাদা’দের ভাগ্যে বডি ম্যাসাজ, ‘দাগী’ হলে নারকীয় অত্যাচার! তিহারের জেলকুঠুরি যেমন…
এসব শুনে মনে হয়, যাদবপুরের স্বপ্নদীপের সঙ্গেও কি এমন কিছুই হয়েছিল! প্রত্যক্ষদর্শীদের অনেকেই জানিয়েছেন, মৃত্যুর আগের দিন রাতে বারবার তিনি বলেছিলেন, তিনি সমকামী নন। কেন বলেছিলেন সে কথা? কলেজের হস্টেলে কি এমনই কোনও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সতেরো বছরের স্বপ্ননীলকে? কবে শেষ হবে ব়্যাগিংয়ের মতো এই নারকীয় প্রথা? বিশ্বের বিশ্বমানের সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কবে কাটবে এই তিমির? এই চিরন্তন প্রশ্নটা বোধহয় স্কুল পেরিয়ে কলেজে পড়তে আসা আরও অনেক অনেক পড়ুয়া ও তাঁদের পরিবারের সকলেরই।