মাত্র একবার সঙ্গমেই বছরের পর বছর ডিম দেয় এরা! কচ্ছপদের যেসব তথ্য আজও অজানা

Unknown facts about turtles : জানেন আদৌ কোনও দাঁত থাকে না জীবিত কচ্ছপের! যেসব অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে এই প্রাণীকে ঘিরে

ছোটবেলার স্মৃতি বাক্সের ধুলো ঝাড়লে একটা পরিচিত গল্পের বই আজও উঁকি দেয়। ঈশপের গল্প। সেই বইয়ের পাতায় পাতায় গল্পের ছলেই বলা ছিল জীবনের কিছু সার সত্যি। সেই বইয়ের পাতায় আবার একবার উঁকি দিলে দেখা মেলে বহু বহু পশু, পাখি প্রাণীদের সঙ্গে। মনে পড়ে সেই কচ্ছপ আর খরগোশের গল্পের কথা। দ্রুতগামী খরগোশকেও কেবল একাগ্রতা জোরে দৌড় প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিয়েছিল শ্লথগামী কচ্ছপ। গল্পের সেই কচ্ছপ আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। ভারতীয় আইনে কচ্ছপকে বাড়িতে পোষাও অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়।

কালচে রং, বাইরের খোলস বেশ শক্ত। মাথার মনের দিকে মুখ থাকে। পাগুলি দেহের ভারে প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছে। ওভাবেই ধীর গতিতে হেঁটে চলে এই প্রাণীরা। মূলত সরীসৃপ প্রজাতির একটি ক্রম হল কচ্ছপ। যা টেস্টুডিন নামে পরিচিত। এটা উভচর প্রজাতির প্রাণী। জল এবং ডাঙা দুই জায়গাতেই বসবাস করতে পারে। এমনকী ডিমও পাড়ে দুই জায়গাতেই। এখানেই শেষ নয় দীর্ঘায়ু এই প্রাণীদের নিয়ে এমন আরও অনেক তথ্য আছে যা আজও জানেনা অনেকেই। আসুন এক নজরে দেখে নেওয়া যাক সেইসব।

১. ২০২১ সালে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত জেফ লোভিচের লেখা “টার্টলস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড” বইয়ে কচ্ছপ সম্পর্কে এরকম বহু অজানা তথ্যের হদিশ দেওয়া হয়েছে। এখনও পর্যন্ত গোটা বিশ্বে প্রায় সাড়ে তিনশো ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির কচ্ছপের উল্লেখ মেলে।

আরও পড়ুন - পৃথিবীর কেন্দ্র ঘিরে রয়েছে প্রাচীন মহাসমুদ্র! যে আবিষ্কার ঘিরে শোরগোল গোটা বিশ্বজুড়ে

২. শুধুই ঈশপের গল্পের সেই রেসই নয়, দীর্ঘায়ুর দিক থেকেও সব প্রাণীকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যায় কচ্ছপ। কচ্ছপই পৃথিবীর একমাত্র প্রাণী যারা সবচেয়ে বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে। এদের কিছু প্রজাতি আবার প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় বাঁচে। কচ্ছপের সব প্রজাতির মধ্যে গ্যালাপাগোস জায়ান্ট প্রজাতির কচ্ছপ বাঁচে সবচাইতে বেশি, গড়ে প্রায় ১৯০ থেকে ২০০ বছর।

৩. শুধু যে আয়ুর নিরিখে সবাইকে পিছনে ফেলতে পারে এমন নয় পাশাপাশি মেরুদণ্ডী প্রাণীদের মধ্যে তাদের একটি দীর্ঘতম জীবাশ্ম রেকর্ড এর অধিকারী হয়েছে কচ্ছপ প্রজাতিই। ইতিহাস বলছে, আজ থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগেও ছিল কচ্ছপ। সেই সময় ডাইনোসরের পায়ের নীচে কচ্ছপের জীবাশ্ম এর হদিশ আজও মেলে, যা বিশ্বে প্রাচীনতম।

৪. বেঁচে থাকা কচ্ছপদের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল লেদারব্যাক সামুদ্রিক কচ্ছপ। এই কচ্ছপটির শেলের দৈর্ঘ্য ছিল প্রায় দশ ফুটের কাছাকাছি। আর কচ্ছপটির এখনও পর্যন্ত রেকর্ড দৈর্ঘ্য আট ফুট এবং ওজন এক টনেরও বেশি। এছাড়া গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের দৈত্যাকার কাছিমও প্রায় ৮০০ পাউন্ডেরও বেশি ওজনের হতে পারে।

৫. সব প্রজাতির কচ্ছপই ডিম পাড়ে। সবথেকে কম ডিম পারে দক্ষিণ আফ্রিকার পাঁচ আঙ্গুলের প্যাডলোপারে নামক কচ্ছপ, অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ডিম পাড়ে লেদারব্যাক সামুদ্রিক কচ্ছপ। কিছু স্ত্রী কচ্ছপ একবার মাত্র সঙ্গম করেই বছরের পর বছর ধরে উর্বর ডিম উৎপাদন করতে পারে। কচ্ছপের লিঙ্গ নির্ভর তাপমাত্রার উপর। নিম্ন তাপমাত্রায়, পুরুষরা বাসাবাড়িতে উপস্থিত হয়, উচ্চ তাপমাত্রায়, মহিলারা।

৬. কচ্ছপদের অনেক প্রজাতির নারী ও পুরুষ আলাদা; যদিও বিভিন্ন প্রজাতির ক্ষেত্রে নারী পুরুষের পার্থক্য বিভিন্ন হয়ে থাকে। কিছু প্রজাতির পুরুষদের ঘাড় মেয়েদের থেকে লম্বা থাকে। আবার কিছু প্রজাতির মেয়েদের নখর পুরুষদের থেকে বড় হয়ে থাকে। অধিকাংশ কচ্ছপ প্রজাতিতে পুরুষদের থেকে মেয়েরা আকারে বড় হয়ে থাকে। পুরুষের খোলসের উপরের অংশ প্রজননে সহযোগিতা করার জন্য ভিতরের দিকে বাকানো থাকে। কচ্ছপদের লিঙ্গ নিরূপণের সবথেকে সহজ উপায় হচ্ছে তাদের লেজ লক্ষ্য করা। সাধারণত মেয়েদের নিচের দিকে বাকানো ছোট লেজ থাকে অন্যদিকে পুরুষদের উপর দিকে বাকানো তুলনামূলক ভাবে বড় লেজ থাকে।

৭. কচ্ছপ বাদে উভচর প্রাণী, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং সমস্ত সরীসৃপের পাঁজরের খাঁচার বাইরে নিতম্ব এবং কাঁধের জয়েন্টগুলি অবস্থিত। কচ্ছপদের মধ্যে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি পাঁজরের খাঁচার ভিতরে থাকে, যা দেহের মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক শেল গঠনে বিশেষ সহায়তা করে।

আরও পড়ুন - ধুতি-টোপর পরে তৈরি বট গাছ! যেভাবে ধুমধাম করে ‘একমাত্র ছেলে’র বিয়ে দিলেন বৃদ্ধা মা

৮. কিছু কচ্ছপ কীস্টোন প্রজাতি, যার মানে তারা একটি সম্পূর্ণ পরিবেশগত সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করে। দক্ষিণ-পূর্বে গোফার কচ্ছপ এবং আফ্রিকান উদ্দীপ্ত কচ্ছপের বর্জিং অভ্যাস অন্যান্য অনেক প্রাণীর জন্য ভূগর্ভস্থ আশ্রয় তৈরি করে।

৯. আরও একটি মজার বিষয় হল সমষ্টি জীবিত কচ্ছপই হয় দাঁতহীন। যদিও তারা সকলেই কামড় দিতে পারে। একটি বড় অ্যালিগেটর স্ন্যাপিং কচ্ছপ সহজেই তার শক্তিশালী মাথার পেশী এবং ছুরি ন্যায় ধারালো চোয়াল দিয়ে একজন ব্যক্তির আঙুল কেটে ফেলতে পারে। জীবাশ্ম রেকর্ডের উপর ভিত্তি করে জন্য যায়, আজ থেকে প্রায় ১৫০ মিলিয়নেরও বেশি বছর আগে নাকি কচ্ছপের দাঁত ছিল।

১০. কচ্ছপই প্রথম প্রাণী যারা চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে পুনরায় নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। ১৯৬৮ সালে মহাকাশযানে চেপে রওনা দেয় দুই রাশিয়ান কাছিম। তাদের সঙ্গে খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছিল ঠিকই তবে, তারা কোনও রকম খাবার ছাড়াই এই বিশেষ ভ্রমণ করতে পারত বলেই জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মূল কারণ হল সমস্ত প্রজাতির কচ্ছপই দীর্ঘ সময়ের জন্য উপবাস করতে পারে।

১১. অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠীর তুলনায় কচ্ছপের মধ্যে চোখের রঙ অত্যন্ত পরিবর্তনশীল। এর বিশেষ বিশেষ ধরনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - লাল চোখওয়ালা পুরুষ বক্স কচ্ছপ, সাদা চোখওয়ালা মিসিসিপি ম্যাপ কচ্ছপ এবং সাহারা ব্লু-আইড পুকুরের কচ্ছপ।

সব মিলিয়ে এক রহস্যময় প্রাণী এই কচ্ছপ। যদিও বর্তমানে সারা বিশ্বেই অসাধু ব্যবসায়ীদের বারবার অংক কচ্ছপের বিলুপ্তির মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবাধে কচ্ছপ চালান আদতে গোটা প্রজাতিকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গিই একমাত্র পারে এই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে। সারা বিশ্বে ২৩ মে পালিত হয় কচ্ছপ দিবস।

More Articles