মানুষ নয়, ৩৬ বছর ধরে বিড়াল, ইঁদুরদের জন্য বর্ম তৈরি করেন এই শিল্পী! কেন?

Cat and Mouse Armour: একটি ইঁদুরের বর্ম তৈরি করার জন্য প্রায় ৪০ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।

দুর্ধর্ষতম অস্ত্রও যাতে সম্রাটের দেহে সামান্য ক্ষতও না তৈরি করতে পারে, সেই কারণেই তৈরি হয়েছিল বর্ম। শক্ত ধাতুর তৈরি প্রাণ বাঁচানোর পোশাক। রাজা নেই, সম্রাটও নেই। তরোয়াল বল্লম নিয়ে লড়ার দিনও গত। এখন গুলিগোলার বাজার। কোনদিক থেকে কখন সুতীব্র গুলি এসে রাজার, থুড়ি নেতার দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেবে বলা যায় না। যতই দেহরক্ষীরা চশমার আড়াল থেকে নজর রাখুক না কেন, যতই ঘেরাটোপ থাকুক না কেন, সাবধানের মার নেই। তাই বুলেট আটকাতে এখন বুলেটপ্রুফ বর্ম। তা রাজা, মন্ত্রী, সেনাপতি, নেতা, প্রোমোটার বা স্থানীয় নেতার এসব মানায়। কিন্তু ৩৬ বছর ধরে ইঁদুর আর বিড়ালের জন্য বর্ম তৈরি করছেন এক শিল্পী! এ কেমন যুদ্ধের প্রস্তুতি! এ কেমন নিরাপত্তা? জেফ ডি বোয়ার কানাডিয়ান শিল্পী। প্রায় প্রায় চার দশক ধরে তিনি বিড়াল এবং ইঁদুরদের জন্য নানান বর্মের নকশা তৈরি করছেন।

এই ৩৬ বছরে ডি বোয়ার তাঁর ক্যালগারি স্টুডিওতে ৫০০ টিরও বেশি প্রাণীর বর্ম তৈরি করেছেন। ইঁদুরের মাপের ক্রুসেডার বর্ম থেকে শুরু করে ছোট ছোট মাথা ঢাকা আর লেজ ঢাকার হেলমেট, মধ্যযুগীয় ইসলামিক নকশার বর্ম- কী নেই বিড়ালের জন্য! সে ইঁদুর আর বিড়ালদের মধ্যে সারাক্ষণই হাতাহাতি মারামারি চলতেই থাকে পাড়ার দুই উত্তেজিত ক্লাবের উঠতি মস্তানদের মতো। কিন্তু তার জন্য ছোটখাটো হাতবোমাই তো যথেষ্ট, এসব বর্ম, শিরস্ত্রাণ কেন? কী এমন যুদ্ধের প্রস্তুতি? ডি বোয়ার জানিয়েছেন, যুদ্ধ কোনও উদ্দেশ্যই নয়। চারপেয়ে প্রাণীদের জন্য তাঁর এই হাতে তৈরি করা বর্ম ইত্যাদি মানুষের কল্পনাশক্তিকেই নাড়া দিতে চায়।

ডি বোয়ার এই আজব কাজের অনুপ্রেরণা পান ক্যালগারির গ্লেনবো মিউজিয়ামে বর্ম সংগ্রহশালায় গিয়ে। তখন তাঁর বয়স সবে পাঁচ বছর। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে বোয়ার বলছেন, "আমি মনে করি, খুব অল্প বয়সে শিশুরা বর্মকে আকর্ষণীয় কিছু একটা জিনিস হিসাবে চিনতে শেখে। আমার জন্য ব্যাপারটা সত্যিই ভুতুড়ে ছিল। কীভাবে বর্ম তৈরি করা হয়েছিল? কে এটা পরতেন? কেন তারা পরতেন? পরে তাদের অভিজ্ঞতা কেমন হতো? এই চিন্তাভাবনা এবং ধারণাগুলি সারা জীবনই আমার মাথাতে ঘুরেছে।"

আরও পড়ুন- বাড়িতে বিড়াল আছে? গবেষণা বলছে, এই ভয়াবহ মানসিক রোগের শিকার হতে পারেন আপনি…

ডি বোয়ার তাঁর বাবার মেটাল ফ্যাব্রিকেশনের দোকানের সরঞ্জাম নিয়ে কাজ শুরু করেন এবং স্কুলেই প্রথম মানুষের দেহের মাপের বর্ম তৈরি করেন। কিন্তু ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি আর্ট স্কুলে গয়নার নকশা প্রস্তুতকারক হিসেবে বর্ম তৈরি করতে চাইলেও যা যন্ত্রপাতি পেতেন তিনি তা ছিল অত্যন্ত ক্ষুদ্র, খুব ছোট জিনিস নকশা করা যেত তাতে। তা সেসব দিয়ে ছোট ছোট আকারে মানুষের জন্যই বর্ম তৈরি করতে পারতেন, কিন্তু করার তাগিদই জাগেনি। তারপরে তাঁর মনে হয়, ইঁদুরের জন্য বর্ম তৈরি করলে কেমন হয়! যেই ভাবা, সেই কাজ! 

ইঁদুরের কাজ করতে করতে ডি বোয়ার বুঝতে পেরেছিলেন এই ইঁদুরদের এত বর্ম তৈরি করে হবেটা কী? যোগ্য প্রতিপক্ষ দরকার! স্বাভাবিকভাবেই বিড়ালই যোগ্যতম প্রার্থী, শুরু হলো বিড়ালের জন্য বর্ম তৈরির কাজ। ডি বোয়ার নানান গয়না, বড় ভাস্কর্য, এমনকী মৃতের ছাই-মাটি রাখার পাত্রও তৈরি করেন—কিন্তু পশুর জন্য বর্ম তৈরির কাজটিই সবচেয়ে ভালোবাসেন তিনি।

ডি বোয়ার বর্ম তৈরির জন্য বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতি এবং সেই নির্দিষ্ট যুগের উপর বিস্তর গবেষণা করেন। সেই সময়ের অস্ত্রশৈলী নিয়েও পড়াশোনা করেন। তারপর বর্মের নকশাটি প্রথমে হাতে আঁকেন। তারপরে মাটির মডেল তৈরি করেন। তারপর নানা ধাতব অংশ জুড়ে জুড়ে কাজ এগোতে থাকে। প্রতিটা বর্মই নানা অংশ জুড়ে জুড়ে তৈরি। যেমন রোমান গ্ল্যাডিয়েটর মাউস ৫০টি বিভিন্ন অংশ দিয়ে তৈরি। বিড়ালের এমন বর্মে ৫০০টি ভিন্ন অংশ থাকতে পারে। যেহেতু কাজটি অত্যন্ত সূক্ষ তাই সময়ও লাগে বিপুল! একটি ইঁদুরের বর্ম তৈরি করার জন্য প্রায় ৪০ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। ডি বোয়ার বেশিরভাগ বর্মই তৈরি করেন নিকেল, ইস্পাত, পিতল দিয়ে। কখনও কখনও সোনা বা প্ল্যাটিনামও ব্যবহার করেন।

আরও পড়ুন- কেন কুকুরের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ নয় বেড়াল? কতটা রহস্যময় এই প্রাণী

কিন্তু এই বিড়াল ইঁদুরের বর্মের দরকার কী? কল্পনাকে বাস্তবের রূপ না হয় দেওয়া গেল, কিন্তু তারপর? আসলে এমন অনেক মানুষের তরফে তাঁর কাছে বর্ম তৈরির অনুরোধ আসে যা অত্যন্ত ব্যক্তিগত ক্ষেত্র থেকেই জন্ম নেয়। অনেকেই মারা যাওয়া প্রিয় পোষ্যকে স্মরণ করার জন্য বর্ম তৈরি করা রাখতে চান। একবার এক পুলিশ আধিকারিক চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় কুকুরটির জন্য সামুরাই কুকুরের হেলমেট তৈরি করে দিন বোয়ার। অনুরোধ ফেলতে পারেননি শিল্পী।

More Articles