কেন কুকুরের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ নয় বেড়াল? কতটা রহস্যময় এই প্রাণী

বেড়াল কেন কুকুরের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ নয়? এবং কিছু বেড়াল কেন বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ, আবার কেউ কেউ কেন আপন খেয়ালে থাকে; কেনই বা মানুষের ডাক বা আদরকে উপেক্ষা করে?

আজ আন্তর্জাতিক বেড়াল দিবস বা ইন্টারন্যাশানাল ক্যাট ডে। বেড়াল সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ারের তরফে চালু করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্যাট ডে।

যে যাই বলুক, বেড়ালের মনের রহস্য জানা বড়ই কঠিন। কখনও নাম ধরে ডাকলে সে সাড়া দেয়, কখনও দেয় না। পথচলতি অচেনা মার্জার কখনও গায়ে গা ঘষে বন্ধুত্ব করে যায়, কখনও বা চেনা বেড়াল ডাকলেও পাত্তা দেয় না। আবার কখনও বা আপনি যেমন আচরণ করেন, আপনাকে অনুকরণ করে আপনার পোষ্য বেড়াল। আজ না হয় রহস্যভেদ করা যাক মজাদার এই প্রাণীটির মনের।

অনেক প্রাণীর মতোই বেড়ালও বন্যপ্রাণীই ছিল, মানুষের সংস্পর্শে আসার পরে ধীরে ধীরে গৃহপালিত পশুর বৈশিষ্ট্য লাভ করে বেড়াল। গৃহপালিত নয় এমন বেড়াল বা ফেরাল ক্যাট আচরণগত দিক থেকে অনেক বেশি হিংস্র এবং নামেই বোঝা যাচ্ছে, তাদের স্বভাব কিছুটা বন্যও। কিন্তু ফেরাল ক‍্যাট আর আমাদের গৃহপালিত বেড়াল বা নিদেনপক্ষে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেড়ালকে বাহ্যিকভাবে কিন্তু প্রায় একইরকম দেখতে। কিন্তু তাদের আচার-আচরণে পার্থক্য কিন্তু বিস্তর, আর সেখানেই বিবর্তন এবং জিনের খেলা।

আরও পড়ুন: বাঘের মৃতদেহকে মানুষের স্যালুট, ভালবাসার ফুল, এক অন্য মানবিকতার গল্প

দশহাজারেরও বেশি সময় থেকে বন্য বেড়ালরা মানুষের সংস্পর্শে আসতে আসতে গৃহপালিত বেড়ালে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কীভাবে বেড়ালরা মানুষের সংস্পর্শে এল, তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে দশ হাজার বছর আগের মিশরের ইতিহাসে।

মিশরীয় সভ্যতাতে বেড়ালকে দেবতা হিসেবে মানা হতো। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা ছিল কৃষিনির্ভর। কিন্তু প্রায়শই ইঁদুর বা সাপের আক্রমণে সেই শস‍্য নষ্ট হতো। তখনও বেড়ালরা গৃহপালিত নয় এখনকার মতো। তারা ঘোরতরভাবে মাংসাশী তখন। এই বন্য বেড়ালগুলি তখন ইঁদুর আর সাপ খেয়ে শষ্যকে বাঁচাত ক্ষতির হাত থেকে। আর তখন থেকেই বেড়ালকে দেবতার স্থান দিয়েছিলেন প্রাচীন মিশরীয়রা। তারপর থেকেই বেড়াল মানুষের সংস্পর্শে ধীরে ধীরে আসতে শুরু করে।

প্রাচীন মিশরে যে সমস্ত বাড়িতে বেড়াল থাকত, জনসমাজে তাদের বিশেষ কদর ছিল সেই আমলে। বাড়িতে আগুন লাগলে বাড়ির অন্য কিছু বাঁচানোর আগে, বাঁচানো হতো বাড়ির বেড়াল। বাড়ির পোষ্য বেড়াল মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা ভুরু কামিয়ে শোক পালন করতেন, আর শোক পালন ততদিন চলত, যতদিন না নতুন করে ভুরু গজায়।

তখন থেকেই আদরের প্রাণীও হয়ে ওঠে তারা। তারপর বিগত দশহাজার বছরে মানুষের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে নিতে বন্য ও হিংস্র থেকে তারা বেশ খানিক শান্ত হয়েছে, আদুরে হয়েছে। মাছ-মাংসের পাশাপাশি দুধ-ভাতের মতো খাবারও সে খেতে শিখেছে।

কিন্তু এত বদল তো এমনি হয়নি। দীর্ঘ দশ হাজার বছর ধরে তাদের শরীরের ২৮১টি নির্দিষ্ট জিনে খুব দ্রুত বদল এসেছে। যার জন্য গৃহপালিত বেড়াল বন্য বেড়ালের থেকে এত আলাদা হয়ে উঠেছে বাহ্যিক গঠন, আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস, এবং বুদ্ধিমত্তার দিক থেকে।

কিন্তু এদের মধ্যে তেরোটি জিন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের মধ্যে বেশ কিছু জিনে পরিবর্তনের ফলে বন্য ও হিংস্র থেকে নরম-সরম, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং বাড়িতে পালনের যোগ্য হয়ে উঠেছে তারা। শুধু তাই নয়, এই জিনগুলির মধ্যে বেশ কিছু জিন নতুন আচার ব্যবহার শেখা, বুদ্ধিমত্তা, এবং ভয়ের প্রতিক্রিয়ার মতো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করে আজকের গৃহপালিত বেড়ালদের মধ্যে। এমনকী, মানুষের ইশারায় খাবার কীভাবে খুঁজবে, তা-ও শিখিয়ে দিয়েছে এই নির্দিষ্ট কতগুলি জিন।

২০০৫ সালে ড. এ মিকলুসের একটি গবেষণা বলছে, মানুষের ইশারা বা মানুষের আচার-ব্যবহারকে গৃহপালিত বেড়াল বুঝতে পারে। গবেষকরা বেড়ালদের ওপর পরীক্ষা করে দেখান, তার মালিক বা মালকিনের ইশারায় বেড়াল খাবার খুঁজতে পারে। এমনকী, কোনও নির্দিষ্ট কিছুতে বেড়ালটির মালিক বা মালকিন ভয় পেলে, বেড়ালটিও ভয় পায় তার দেখাদেখি; আবার সেই নির্দিষ্ট জিনিসে যদি বেড়ালটির মালিক বা মালকিন ভয় ব্যতীত অন্য কোনও অনুভূতি প্রকাশ করে, বেড়ালটিও একই অনুভূতি প্রকাশ করে তার দেখাদেখি। সোজা কথায়, বেড়ালটি তার মালিক বা মালকিনের অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে, এবং সেইরকম আচরণ করে।

এখানেই শেষ নয়, মালিক বা মালকিনের গলার স্বরকে অন্যের গলার স্বরের থেকে তফাৎও করতে পারে গৃহপালিত বেড়াল। বেড়ালরা দু'জন পৃথক ব্যক্তির গলা আলাদা করে চিনতে পারে কি না, তা বোঝার জন্য ২০১৩ সালে সাইটো ও শিনজু়কা নামের দুই গবেষক একটি পরীক্ষা করে দেখেন। তাঁরা দু'টি রেকর্ডিং বেড়ালদের শোনান, একটিতে বেড়ালের মালিক বা মালকিন বেড়ালটির নাম ধরে ডাকছেন, আরেকটি রেকর্ডে অন্য কোনও ব্যক্তি বেড়ালের নাম ধরে ডাকছে। দেখা যায়, মালিক বা মালকিনের নাম ধরে ডাকার শব্দ শুনে বেড়ালগুলির সাড়া দেওয়ার প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে অন্য কোনও ব্যক্তি তাদের নাম ধরে ডাকার শব্দে বিশেষ সাড়া দিতে দেখা যায় না সেই বেড়ালগুলিকে।

আবার আচরণ অনুযায়ী কণ্ঠস্বরও বদল করতে পারে গৃহপালিত বেড়াল। বেড়ালছানার প্রায় ন'টি ভিন্ন কণ্ঠস্বর রয়েছে, আবার প্রাপ্তবয়স্ক বেড়ালের রয়েছে প্রায় ষোলোটি ভিন্ন কণ্ঠস্বর। খাবার চাওয়ার সময় বা কোনও দরকারি বিষয়ে যে শব্দে তারা ডাকে, আদর খাওয়ার সময় কিন্তু সেই শব্দে ডাকে না। খিদে পেলে বা দরকারের সময়ে যে ডাক, সেই ডাকের কম্পাঙ্ক এবং তীক্ষ্ণতা অনেক বেশি, আদরের খাওয়ার সময়ের ডাকের তুলনায়। অন্তত সেরকমই জানা যাচ্ছে ড. কারেন ম্যাককম্বের গবেষণা থেকে, যা ২০০৯ সালে 'সেল প্রেস' নামের জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।

কিন্তু তা সত্ত্বেও যখন মনে প্রশ্ন জাগে, বেড়াল কেন কুকুরের মতো বন্ধুত্বপূর্ণ নয়? এবং কিছু বেড়াল কেন বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ, আবার কেউ কেউ কেন আপন খেয়ালে থাকে; কেনই বা মানুষের ডাক বা আদরকে উপেক্ষা করে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তরেও ঘুরেফিরে আবার বিবর্তনের প্রসঙ্গ চলে আসে। গৃহপালিত বা রাস্তার কুকুর মানুষের সঙ্গে তিরিশ হাজারেরও বেশি বছর সময় কাটিয়ে ফেলেছে, গৃহপালিত বেড়াল সেখানে কাটিয়েছে মোটে দশ হাজার বছর। অন্যদিকে বন্য কুকুর, অর্থাৎ যারা মানুষের সহচর্যে আসেনি, তারা কিন্তু সাংঘাতিক হিংস্র। এতদিন মানুষের সহচর্যে থাকায়, স্বাভাবিকভাবে গৃহপালিত বা রাস্তার কুকুর অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে; তারা সহজেই আমাদের পোষ মানে। কিছু বেড়াল এখনও খানিকটা বন্য বেড়ালের মতো আচরণ করে, মানুষকে এড়িয়ে চলে, বা সহজে পোষ মানে না ঠিক একই কারণে।

 

More Articles