অবাক করা এই দুই চিড়িয়াখানা চিরতরে হারিয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ থেকে
Oldest Zoo In Kolkata: হেস্টিংসের সময় ১৭১৭-১৮ পর্যন্ত ৬০৩০ সিক্কা টাকা খরচ করে বানানো হয়েছিল নতুন পক্ষিশালা এবং ১৮২২ সালে নতুন করে কিছু জন্তুর খাঁচা।
সামনেই শীতকাল আর শীতকাল মানেই কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানায় বাঘ কিংবা সিংহের খাঁচার সামনে কচিকাঁচাদের ভিড়। কেউ বাবার কোলে আবার কেউ বা মায়ের হাত ধরে গুটিগুটি পায়ে চষে ফেলে পশুপাখিদের ঘরবাড়িগুলো। যদিও কলকাতায় এখন অন্যান্য অনেক বিনোদনের পার্ক তৈরি হয়েছে কিন্তু তা সত্ত্বেও চিড়িয়াখানার ভিড় আজও অব্যর্থ। তবে, কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানার আগেও এই বাংলাতেই ছিল আরও এক চিড়িয়াখানা। এই চিড়িয়াখানা নির্মিত হয়েছিল কলকাতা থেকে ১৬ মাইল উত্তরে ব্যারাকপুরে।
প্রথমেই বলে নেওয়া যাক, ব্যারাকপুর সম্পর্কে খুঁটিনাটি কিছু তথ্য। ব্যারাকপুরের প্রাচীন নাম ছিল ‘চানক’। তবে এই চানকের সঙ্গে কিন্তু জোব চার্নকের কোনও সম্পর্ক নেই, তখন জোব কলকাতার বুকে পা অবধি রাখেননি। বরং সংস্কৃত শব্দ ‘চাণক্য’ থেকে এই শব্দটির আগমনের সম্ভাবনাই বেশি। সে যাই হোক, ১৭৭২ সালে কোম্পানির ফৌজি ব্যারাক নির্মাণ করা হয় এই স্থানে। সেখান থেকেই চানক ক্রমে হয়ে উঠল ব্যারাকপুর। এই ব্যারাককে কেন্দ্র করে তখন ব্যারাকপুরের সে এক বিশাল ব্যাপার। ব্যারাকপুর তখন দ্বিতীয় রাজধানী বলা চলে। লাটসাহেবের বাগানবাড়িও ছিল এই ব্যারাকপুরেই। তবে ব্যারাকপুরের আসল প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ওয়েলেসলি। কলকাতার রাজভবনের মতোই ব্যারাকপুরের প্রাসাদও তাঁরই দান। তিনি যখন ব্যারাকপুরে আসেন তখন স্যার জন শোরের বাংলোটা তাঁর নিতান্তই এক কুটির বলে মনে হল। তাই সেই কুটির ভেঙে তিনি তাঁর সাময়িক বাসস্থান হিসাবে তৈরি করলেন এক দোতলা বাড়ি এবং একই সঙ্গে তাঁর পরিকল্পনা ছিল এক সুবিশাল প্রাসাদ গড়ার।
বড়লাটের কি আর অল্পতে মন ভরে? তাই কেবলমাত্র দোতলা বাড়িতেই এই লাটসাহেবি সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি বানালেন এক সুবিশাল বাগান । ন'শো বিঘা জমি নিয়ে এই বাগানের পত্তন হলেও পরবর্তী সময়ে তার সীমা বর্ধিত হয়েছিল সাড়ে তিনশো একরে, অন্তত কার্জন তো সেকথাই বলে গিয়েছেন! বর্তমানে ব্যারাকপুরের মঙ্গল পাণ্ডে বাগানটিই আসলে ওয়েলেসলি নির্মিত সেই বাগান। এই বাগানের মধ্যেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন সুবিশাল এক চিড়িয়াখানা। অনেকেই এই চিড়িয়াখানাকে লাটবাহাদুরের নিছক খামখেয়ালিপনা বলে মনে করেছেন, অনেকে আবার বলেছেন দেশিয় রাজাদের উপহার দেওয়া অর্থের দ্বারাই এর নির্মাণ। দু'টো যুক্তিই আসলে সম্পূর্ণ ভুল।
আরও পড়ুন- উদ্বাস্তু হচ্ছে বাঘও! কেন বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসছে বাঘের দল?
লর্ড ওয়েলেসলি চেয়েছিলেন ১৮০০ সালে নির্মিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পড়ুয়াদের জন্য একটা ন্যাচারাল হিস্ট্রি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা। তাই ফোর্ট লাগোয়া গার্ডেনরিচে জমি নেওয়ার কথাও তিনি ভেবেছিলেন কিন্তু তা কোনও কারণে সম্ভব হয়নি। তবে শোনা যায়, কিছু পশুপাখি নাকি গার্ডেনরিচে সংগ্ৰহও করা হয়েছিল। কার্জনের কথায়, ১৮০০-১৮০৪ সালের মধ্যে তাদের ভরণপোষণে ওয়েলেসলি খরচ করেছিল সাড়ে তিনশো পাউন্ড। চিড়িয়াখানার পাশাপাশি তিনি নাকি কৃষির উন্নতির জন্যও এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন কিন্তু খরচের বহর দেখে কোম্পানি আর সে পথে হাঁটেনি।
সে যাই হোক, আবার আসা যাক চিড়িয়াখানার কথায়। ভাবা মাত্রই তিনি দেশের বিভিন্ন কর্মচারীদের সমন পাঠালেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে স্থানীয় পশুদের নমুনা সংগ্ৰহ কাজের জন্য। সমন গেল দেশের বাইরে কিছু ইংরেজ ঔপনিবেশেও। বিখ্যাত এবং উৎসাহী ডাঃ ফ্রান্সিস বুকাননকে তিনি নিযুক্ত করলেন তত্ত্বাবধায়ক এবং গবেষক হিসাবে। তাঁকে সাহায্য করার জন্য নিযুক্ত করা হল আরও এক চিত্রবিদকে। চিড়িয়াখানার যে খরচা বরাদ্দ হয়েছিল, তা ছিল খানিক এরকম– পশুপাখিদের জন্য পাঁচশো টাকা, চিত্রকরের মাইনে একশো টাকা, একজন কেরানির জন্য চল্লিশ টাকা, চিত্রকরের রঙ তুলির জন্য ঊনষাট টাকা এবং আরও নতুন নতুন জীবজন্তু কেনা বাবদ মাসে তিনশো টাকা।
কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসতে থাকল বিচিত্র সব পশুপাখি, কিছু আবার এল দেশের বাইরে থেকেও। ব্যারাকপুর চিড়িয়াখানা তখন জীবজন্তুর কোলাহলে গমগম করছে। বুকানন আর তাঁর চিত্রকরের আঁকা চিড়িয়াখানার রঙিন অ্যালবামগুলো আজও লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে সযত্নে সংরক্ষিত। ছবিগুলির নীচে বাংলা, হিন্দি এবং উর্দুতে লেখা হয়েছে তাদের পরিচয় এবং অনেক ছবির নিচেই এদেশের চিত্রকরদের স্বাক্ষরও রয়েছে। লর্ড ওয়েলেসলি দেশ ছাড়ার পরেও এই চিড়িয়াখানা জীবিত ছিল ৭৫বছর খানেক। তবে, ওয়েলেসলি বিদায় নেওয়ার পরেই বিদায় নিয়েছিলেন ডাঃ বুকানন। তিনি আর কখনও ব্যারাকপুরে ফেরেননি। এরপরে এশিয়াটিক সোসাইটির এক সদস্য উইলিয়াম লয়েড গিরনস আর একজন স্বেচ্ছাসেবী ডাঃ ফ্লেমিং নিজের ইচ্ছায় নিয়মিত ছবি আঁকতে যেতেন। চিড়িয়াখানায় বাঘ, ভল্লুক ছাড়াও ছিল পেলিক্যান, ফ্লেমিংগো, জাভার পায়রা, কালো চিতা, বাজ পাখি আরও কত কী!
আরও পড়ুন- বৈজ্ঞানিক সত্যকে তুচ্ছ করে চিতা ফেরানো শুধুই রাজনৈতিক দেখনদারি
হেস্টিংসের সময় ১৭১৭-১৮ পর্যন্ত ৬০৩০ সিক্কা টাকা খরচ করে বানানো হয়েছিল নতুন পক্ষিশালা এবং ১৮২২ সালে নতুন করে কিছু জন্তুর খাঁচা। ১৮২৩ সালে লর্ড আমহার্স্ট লিখেছেন, "কী নেই এই সংগ্ৰহশালায়! তিব্বতের বাইসন, দক্ষিণ আফ্রিকার গাধা, ক্যাঙ্গারু আরও কত কিছু"! কিন্তু লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের সময় এইসব কিছুতেই এক অতিদীর্ঘ বিরাম চিহ্ন টানা হয়। তাঁর এই চিড়িয়াখানায় কোনও আগ্ৰহ ছিল না। তিনি ইচ্ছামতো জীবজন্তু একসময় দান করতে শুরু করেন। মাসে পাঁচশো টাকা খরচ করতেও তিনি নারাজ ছিলেন।
লর্ড অকল্যান্ডের আমলে আবার এই চিড়িয়াখানা প্রাণ পায় তাঁর দুই বোনের হাত ধরে। ১৯৩৭সালে এমিলি ইডেন জানিয়েছেন, চিড়িয়াখানা রীতিমতো ভর্তি। বেবুন, জিরাফ, কালো ভাল্লুক, সাদা বাঁদর, গণ্ডার, কচ্ছপ সব আবার ঠাঁই পায় এই স্থানে। লর্ড লিটনের সময় অবশেষে কফিনের শেষ পেরেকটি পোঁতা হয়। অবশিষ্ট জীবজন্তুদের তুলে দেওয়া হয় সদ্য নির্মিত আলিপুরের চিড়িয়াখানায়। এইভাবেই সমাপ্তি ঘটে এশিয়ার প্রথম নির্মিত চিড়িয়াখানার।
এবার আসা যাক আমাদের দেশিয় রাজা নির্মিত এক চিড়িয়াখানার কথায়। এই চিড়িয়াখানার নির্মাতা ছিলেন বাদশাহ ওয়াজিদ আলি শাহ। মেটিয়াবুরুজে তাঁর নেশা ছিল তিনটি জিনিসের। এক, নতুন নতুন সৌধ নির্মাণ। দুই, গান-বাজনা এবং তিন, চিড়িয়াখানা। আবদুল হলিম ‘শারর’ নামে লখনউয়ের এক লেখক এই চিড়িয়াখানা সম্পর্কে কিছু বিবরণ দিয়ে গেছেন। তাঁর কথাতে, নুর মঞ্জিলের সামনে লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা এক সুবিশাল পথে ঘোরাফেরা করত চিতা, হরিণ ইত্যাদি নানান জন্তু। এক শ্বেতপাথর বাঁধানো পুকুরে ছাড়া থাকত শুতুরমুর্গ, কিশোরী ফিলমার্গ সারস, কায়া, বগলা, করকর চকোর হাঁস এবং অন্যান্য জাতের পাখি এবং নানান জাতের কচ্ছপ। কুড়িটিরও বেশি জাতের বাঁদর, বিশেষ আকর্ষণ ছিল সর্পগৃহ। ‘পিতল পিঞ্জর’ নামে ছিল এক বিশাল পাখির ঘর। হাজার পাখি থাকত সেখানে। এছাড়াও ছিল আফ্রিকার জিরাফ, বোগদাদি উট, হাতি, ভাল্লুক আরও কত কী!
নবাব ওয়াজিদ আলি খানিক বেপরোয়াভাবেই টাকা খরচা করতেন এই চিড়িয়াখানায়। শোনা যায়, ধার মেটাতে তিনি এক আস্ত সোনার পালঙ্ক গলিয়ে ফেলার হুকুম দিয়েছিলেন। আরও শোনা যায়, একজোড়া রেশমপরা পায়রা কিনতে তিনি খরচ করেছিলেন চব্বিশ হাজার টাকা এবং একজোড়া সাদা ময়ূর কিনতে খরচ করেছিলেন এগারো হাজার টাকা। এই চিড়িয়াখানায় নাকি বাজপাখিই ছিল আটশোর বেশি। নবাবের মৃত্যুর পর সম্পত্তি নিলামে উঠলে চোরাবাগানের মল্লিকরা নাকি চিড়িয়াখানার অংশবিশেষ কিনে নিয়েছিল।
তথ্যসূত্রঃ
১। শ্রীপান্থ রচিত ‘কলকাতা’