টলি কেলেঙ্কারি: সিনেমাপাড়ায় থ্রেট কালচারই শেষ কথা?
Tollygunge Threat Culture: টালিগঞ্জে উপরে-নীচে, ডাইনে-বাঁয়ে বহিষ্কারের খাঁড়া ঝোলানো। যে খাঁড়ায় বলি হচ্ছেন সাধারণ টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে পরিচালক সকলেই। খাঁড়া কার হাতে?
পর্ব ১
গত কয়েকমাসে একটি শব্দ বাংলার গলি-চৌরাস্তায় গমগমিয়ে শোনা যাচ্ছে। বাংলার রাজনৈতিক জমকের ঠিক নীচে, গভীর অন্ধকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে সেই শব্দ; থ্রেট কালচার। হুমকি যেখানে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে সেই রাজ্যের সাংস্কৃতিক চেতনা-চৈতন্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। আরজি করে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার নেপথ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ও স্বাস্থ্য পরিষেবাতে বছরের পর বছর চলতে থাকা ভয়ের-হুমকির সংস্কৃতির কথা সামনে এসেছে। আন্দোলন চলছে, চলবেও। তবে শুধুই কি স্বাস্থ্য? বাংলার আস্ত বিনোদনের জগৎটিই তো বেঁচে আছে ধমকানি-চমকানির উপর! কিছু কিছু স্ফুলিঙ্গ আগুন ধরায়, তখন ধোঁয়া চোখে পড়ে। বাকিটা শেষ হয় নিভৃতে। টালিগঞ্জের যে মোহময় জগত, বাইরে থেকে যে জাঁক দেখে ধাঁধা লেগে যায় আমজনতার, তার অন্দরে কী চলে তা সম্প্রতি কিছু ঘটনায় প্রকাশ্যে আসে। যার মধ্যে একটি আত্মহত্যার চেষ্টা, আর একাধিক শ্লীলতাহানি আর অজস্র বহিষ্কার। উপরে-নীচে, ডাইনে-বাঁয়ে বহিষ্কারের খাঁড়া ঝোলানো। যে খাঁড়ায় বলি হচ্ছেন সাধারণ টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে পরিচালক সকলেই। খাঁড়া কার হাতে? অভিযোগের আঙুল স্বরূপ বিশ্বাসের দিকে। সম্পর্কে তৃণমূলের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই। ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ানস ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সভাপতি তিনি। তিনি পরিচালক নন, অভিনেতা নন, ক্যামেরা, আর্ট ডিরেকশন, সম্পাদনা, শব্দগ্রহণ কোনও কিছুতেই সিদ্ধহস্ত নন। কেবল, তাঁর আছে ক্ষমতা। আর ক্ষমতার হাতে খাঁড়া।
গত ২১ সেপ্টেম্বর টালিগঞ্জের কেশসজ্জা শিল্পী তনুশ্রী দাস আত্মহত্যার চেষ্টা করেন গায়ে কেরোসিন ঢেলে। আসলে করেন না, করতে বাধ্য করা হয় বলেই মনে করেছেন তাঁর সহকর্মী, সহযোদ্ধারা। তনুশ্রী বিনোদনের জগতের থ্রেট কালচারের সাম্প্রতিকতম শিকার। তিনি বেঁচে গিয়েছেন, শরীরের ক্ষতর চেয়েও প্রগাঢ় তাঁর মানসিক ক্ষত। কেন অন্যরা মনে করছেন আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেওয়া হলো তনুশ্রীকে?
গণতান্ত্রিক নিয়মে সিনে অ্যান্ড ভিডিও হেয়ার স্টাইলিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন চেয়েছিলেন তনুশ্রী এবং তাঁর সহকর্মীরা। হেয়ার ড্রেসার গিল্ডে নির্বাচন হয় সিলেকশনের ভিত্তিতে। দু'টি পক্ষ মনোনয়ন দাখিল করেছিল। সূত্রের খবর, একটি পক্ষ স্বরূপ বিশ্বাসের। দ্বিতীয় যে পক্ষ, তার সদস্যদের মনোনয়নগুলিকে নানা অছিলায় বাতিল করা হয়েছিল। এই বিক্ষুব্ধ সদস্যরা স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি তুলেছিলেন, সেই দাবিতে বাদানুবাদ হয়। গিল্ড জানায়, এই সদস্যরা অভব্য আচরণ করেছেন, শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছেন। সেই প্রেক্ষিতে গিল্ড বিরোধী আচরণের দায়ে গত ১ মে, ৫ জনকে সাসপেন্ড করা হয়। এই সাসপেন্ড হওয়া সদস্যদের মধ্যেই ছিলেন তনুশ্রী দাস, চন্দ্রা মিত্র। তাঁদের চিঠি ধরানো হয় যাতে স্পষ্ট লেখা ছিল, যতদিন না তনুশ্রী তাঁর এই আচরণের, অভিযোগের বিশ্লেষণ করে চিঠি মারফৎ তা জানাচ্ছেন, ততদিন "সাংগঠনিকভাবে করা সকলপ্রকার কাজ হতে আপনাকে কর্মবিরতিতে থাকতে হবে।" সহজ করে বললে, ইন্ডাস্ট্রিতে হেয়ার স্টাইলিস্ট হিসেবে তারা কাজ করতে পারবেন না। তাহলে সংসার চলবে কীভাবে? পেট চলবে কীভাবে? সহজ উত্তর! ক্ষমতার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
এই কেশসজ্জা শিল্পীদের মধ্যে চন্দ্রা মিত্রর মা গুরুতর অসুস্থ ছিলেন, চন্দ্রা একজন সিঙ্গল মাদার। তিনি চিঠি লিখে ক্ষমা প্রার্থনা করেন যাতে তাঁর এই বহিষ্কার তুলে নেওয়া হয় আর তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হয়। চিঠির ভিত্তিতে কর্মবিরতি তুলে নেওয়া হয় ১৩ জুলাই। তবে 'কন্ডিশন অ্যাপ্লায়েড'! গিল্ডের তরফে বলা হয়, নিজেরা কোনও কাজ জোগাড় করতে পারবেন না। যে কাজ গিল্ড দেবে সেই কাজই তাদের করতে হবে। তনুশ্রী দাস দীর্ঘদিন ধরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন। ব্যক্তিগত পরিচয় থেকেই তাঁর কাজ পেতে সমস্যা হওয়ার কথা না। তিনি এই বহিষ্কার চলাকালীন মৈনাক ভৌমিকের সিনেমায় কাজ জোগাড়ও করেন। সেই ঘটনা জানতে পারা মাত্রই বলে দেওয়া হয়, কোনও কাজ তনুশ্রীকে দেওয়া যাবে না। গিল্ডের দেওয়া কাজ ছাড়া অন্য কোনও কাজ করার অনুমতিই নেই তনুশ্রীর। করলেই, ঝোলানো আছে সেই খাঁড়া। জীবিকাহীন ৯০ দিন কাটানোর লড়াই নিয়ে বেশি শব্দ খরচ করাই বাহুল্য!
চিঠিতে বলে হয়েছিল ‘সাংগঠনিকভাবে করা সকল প্রকার কাজ হতে আপনাকে কর্মবিরতিতে থাকতে হবে’। খুবই নিরামিষ কথা। আসলে শুধুমাত্র সাংগঠনিক কাজ থেকে তো বিরত রাখা হয়নি তাঁদের। এই পাঁচজন নির্বাচনেই অংশগ্রহণ করতে পারেননি। ফেডারেশনের মাথা স্বরূপ বিশ্বাস বলেছিলেন, কাউকে কাজ করা থেকে আটকানোই হয়নি। আটকানোই যদি না হয়, তাহলে ক্ষমা চাওয়ার পর ফের কাজ করার অনুমতিই বা দেওয়া হলো কীভাবে? এমনকী সেই চিঠিটি চন্দ্রা মিত্রকে হাতে দেওয়াও হয়নি। তাঁকে শুধুমাত্র সই করিয়ে নিজেদের কাছে রেখে দেওয়া হয়েছে যাতে সময়ে অসময়ে তা ব্যবহার করে এই নিগ্রহ আবারও করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন- যারা ফিতে কাটছে পারিশ্রমিক নিয়ে, বেশ করছে! শিল্পীদের সময়ের দাম আছে বইকি
এই প্রবল চাপ, অনিশ্চিত জীবন, কাজ না থাকার যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেননি তনুশ্রী। তাঁর আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনা প্রথম প্রকাশ্যে আনেন অভিনেত্রী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। তনুশ্রী দাস তাঁর হাত ধরেই এসেছিলেন এই জগতে। সুদীপ্তা বলছেন, গিল্ড আর ফেডারেশনের কাজ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত সব মানুষের কল্যাণের দিকটি দেখা, তাঁদের অধিকার সুরক্ষিত করা। ন্যূনতম মজুরি যাতে মানুষ পায় তা নিশ্চিত করা, কত ঘণ্টার কাজ হবে তা নিশ্চিত করা, কোনও মানুষকে ঠকিয়ে, হকের পাওনা থেকে বঞ্চিত করে কাজ করানো হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা। কিন্তু ফেডারেশন ক্ষমতার বরাভয়ে 'চাপিয়ে' দেওয়ার জায়গায় চলে গেছে। কোনও শিল্পীই নিজের ইচ্ছেতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। তনুশ্রী যখন নিজের পরিচিতিতে কাজ করতে গেলেন, তাঁর কাজ কেড়ে নেওয়া হলো। গিল্ডের নিয়ম না মানলে কার্ড কেড়ে নেওয়া হবে। তিন মাস বসিয়ে দেওয়া হবে। তনুশ্রীকে তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ করতে দেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ করছেন সুদীপ্তা। "বিষয়টা অত্যন্ত অন্যায়ের দিকে যাচ্ছে। একা তনুশ্রী নন, এমন আরও অনেকে আছেন। তনুশ্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন বলে বিষয়টি সামনে এসেছে। ওর ভয়েস মেসেজ যখন পাই আমি, তাতে শুনি স্পষ্ট বলেছে আমি যদি কিছু করি তাহলে এই গিল্ডের বডিই দায়ী থাকবে," বলছেন সুদীপ্তা। তাহলে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে যাদের দায়ী করেছেন তনুশ্রী তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হলো? একজন মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অপরাধে কী বিচার হলো সেই মানুষদের?
সুদীপ্তা বলছেন, “গিল্ডের বিরুদ্ধেই তো অভিযোগ, গিল্ড আর কী ব্যবস্থাই বা নেবে! আমিই মাথা, আমার বিরুদ্ধে ছোটখাট একজন কর্মী অভিযোগ করছে তাতে কী এসে যায়! পুলিশে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। ফেডারেশনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফেডারেশনের মাথায় স্বরূপ বিশ্বাস, ফেডারেশন শাসকদলের ঘনিষ্ঠ! ফলে তদন্ত কেমন হতে পারে তা তো অনুমেয়!” পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদও কতখানি করেছে সেই সন্দেহ তাই থেকেই যায়। এই অভিযুক্তরা আগাম জামিনের আবেদন করে, আদালত সেই জামিন মঞ্জুরও করে। শর্ত দেয় যে কোনওভাবে অভিযোগকারিণীকে হেনস্থা করা যাবে না, কর্মবিরতিতে পাঠানো যাবে না, এই সব শর্ত না মানলে জামিন নাকচ হবে। সব আইন অনুযায়ী ঠিকই আছে। তবে টলিপাড়ার অন্দরমহল বলছে, নানা বৈঠকে শোনা যাচ্ছে এই অভিযুক্তদের কোনও ভয়-অনুশোচনাই নেই। তারা নাকি দাবিও করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া যাবে না কারণ তাদের মাথায় হাত আছে স্বরূপ বিশ্বাসের। তারা শাসকের ঘনিষ্ঠ!
তনুশ্রীর পর্ব থেকে আরও কয়েক মাস পিছিয়ে যাওয়া যাক। ২৭ ফেব্রুয়ারি ফেডারেশনের অফিসে একটি বৈঠক ডেকে লেখক-পরিচালক পারমিতা মুন্সিকে ৯০ দিনের জন্য সাসপেন্ড করা হয়। কেন? অভিযোগ, তিনি ফেডারেশনের নিয়ম মেনে শুটিং করেননি। তাই কর্মবিরতি। চাপানো হয় একাধিক শর্ত! জানিয়ে দেওয়া হয়, এই ৯০ দিন তিনি কোনও চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না, এমনকী কোনও চিত্রনাট্যও প্রকাশ করতে পারবেন না, এবং যদি পারমিতার চিত্রনাট্যের উপর কোনও চলচ্চিত্র কোনও পরিচালক তৈরি করতে থাকেন তিনিও সেই শুটিং করতে পারবেন না! পারমিতা না হয় ফেডারেশনের নিয়ম না মেনেই শুটিং করেছেন, তা বলে তাঁর চিত্রনাট্য থেকে অন্য পরিচালকও কাজ করতে পারবেন না এমন একুশে আইন ফেডারেশন কোন আইনে আনল? পারমিতা মুন্সি এই প্রশ্নটিই করেছিলেন। উত্তর আসেনি। ইনস্ক্রিপ্টকে পারমিতা বলেছেন, "সংগঠনের মধ্যে থাকতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হয়। আমি শুরুর থেকেই সব নিয়ম মেনে চলেছি। ১৫ দিন শুটিং হয়েছে। ৭০-৮০ জন করে টেকনিশিয়ান নিতে হয়েছে। একদিন হঠাৎ করে কম টেকনিশিয়ান নিচ্ছি, তার নিশ্চয়ই কারণ আছে! শুটিং সাউথ সিটির মধ্যে হয়। ৫ জন মাত্র টেকনিশিয়ান কম ছিলেন, আর ফেডারেশনের গাড়ি ছিল না।" এইটুকুর জন্য ৯০ দিনের শাস্তি! প্রোডাকশন ম্যানেজার পারমিতার নামে নালিশ করেন। ফেডারেশনের মাথা স্বরূপ বিশ্বাসকে ফোন করেছিলেন পারমিতা। পারমিতা জানিয়েছেন, ফোনে স্বরূপ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন পারমিতা ডিরেক্টর্স গিল্ডের মেম্বার কিনা। পারমিতা জানান তিনি রাইটার্স গিল্ডের সদস্য! স্বরূপ চমৎকৃত হয়ে প্রশ্ন করেন, রাইটার্স গিল্ডের লোক কীভাবে চলচ্চিত্র নির্দেশনা দিচ্ছেন?
চিত্রনাট্য লেখক পরিচালনা করতে পারবেন না, বা শব্দগ্রাহক ক্যামেরা করতে পারবেন না এমন বিধিবদ্ধ নিয়ম তো চলচ্চিত্র জগতে কস্মিনকালেও ছিল না। যাই হোক, সেই ফোনালাপের পর শুরু হয় 'থ্রেট কালচার'! পারমিতার সঙ্গে থাকা টেকনিশিয়ানদের 'থ্রেট' দেওয়া হয়। পরের শুটিংয়ের কলটাইম বাতিল করে দেওয়া হয়। শুটিং বন্ধ হয়ে যায়। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, অর্থাৎ পারমিতা মুন্সি, তাঁকে না ডেকেই ২৭ ফেব্রুয়ারি মিটিং ডাকে ফেডারেশন ও গিল্ড। সূত্রের খবর, সেখানে আর্ট ডিরেক্টরকে কেন পারমিতার সঙ্গে নিয়ম ভেঙে কাজ করেছেন বলে হুমকি দেওয়া হয়। ৯ জন সিনিয়র টেকনিশয়ানকে সাসপেন্ড করা হয় যার মধ্যে রয়েছেন প্রোডাকশন বয় থেকে শুরু করে ফোকাস পুলার, আজাদ আহমেদের মতো বিখ্যাত মেকআপ আর্টিস্ট! অর্থাৎ কলকাতায় কাজ করে পেটের ভাত জোগাড়ের জায়গাটি বন্ধ করে দেওয়ার বন্দোবস্তে সিদ্ধহস্ত ফেডারেশন।
পারমিতা সহ এই বিনোদন জগতের বিক্ষুব্ধদের অনেকেরই অভিযোগ, স্বরূপ বিশ্বাস ইন্ড্রাস্টির কেউ নন। অর্থাৎ বিনোদনের কাজের কোনও অভিজ্ঞতাই তাঁর নেই, অথচ তিনিই ফেডারেশনের মাথা ক্ষমতাবলে। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। বিশেষ করে শেষ চার বছরে এই হুমকির সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, যত মানুষজনকে গিল্ডের মেম্বারশিপ দেওয়া হয়েছে, অধিকাংশেরই কোনও যোগ্যতা নেই। ফেডারেশন এদের কার্ড দিচ্ছে আনুগত্য বাড়ানোর জন্য, শাসকের ভোট বাড়ানোর জন্য। অভিযোগ আছে, টালিগঞ্জ অঞ্চলে অটো ইউনিয়নের বহু কর্মী আবার গিল্ডেরও সদস্য। কাজের অভিজ্ঞতা না থাকলেও কাজ পান তারা কারণ তারা ওই অঞ্চলের ভোটার আর শাসক ভোট কেনার সমস্ত ছলাকলাতে দড়! টালিগঞ্জ-গড়িয়া অটো ইউনিয়নের কর্মীরা কেন টেকনিশিয়ানের কাজ পান? কারণ এই ইউনিয়নেরও মাথা স্বরূপ বিশ্বাস। অভিযোগ, ১ লাখ টাকার বিনিময়ে এই মানুষদের কার্ড দেওয়া হয়েছে। মাসে ১০/১২ দিনের নিশ্চিত কাজ দেওয়া হয়। প্রতি শিফটে ১০০০-১২০০ টাকা মজুরি। হিসেব কষলেই মাসের অতিরিক্ত আয়ের জায়গাটি পরিষ্কার। এই অতিরিক্ত আয়ের বদলে একটি ভোট নিশ্চিত, পরিবারের ভোটও নিশ্চিত, যা শাসকের হয়ে বেআইনিভাবে করে চলেছে ফেডারেশন, অভিযোগ বিক্ষুব্ধদের। টালিগঞ্জ সিনেপাড়ার অন্দরের খবর, আগে ৪০০০-এর মতো টেকনিশিয়ান কাজ করতেন, এখন সংখ্যা ৮০০০! আসলে সংখ্যাটা ১১ হাজারের কাছাকাছি বলেও দাবি করেছেন অনেকে।
আরও পড়ুন- ভিড়, ভক্ত, ফাংশান, উন্মাদনা! উত্তমকুমারকে যেভাবে আগলে রাখতেন এই মস্তানরা
টালিগঞ্জের ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ানস ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার মূল দু'টি ভাগ আছে, ওয়ার্কিং ও এক্সিকিউটিভ কমিটি। ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস। এই কমিটির সদস্য পরিচালক সুদেষ্ণা রায়। ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সম্পাদক সুদেষ্ণা রায় বলছেন, কতজনকে নিয়ে শুটিং হবে এই নিয়ে বিশাল সমস্যা চলছে এখনও। স্বাভাবিকভাবেই যে সিনেমার বাজেট বেশি, আর যে সিনেমার বাজেট খুব কম দুইয়ের শুটিং ভিন্ন ভিন্ন হবেই। এবার কোনও শুটিংয়ের দিনে হয়তো কোনও কেশসজ্জাশিল্পী, পোশাকের শিল্পী, বা বেশি অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের কোনও দরকারই নেই। শুটিং হবে রাস্তাঘাটে, নেওয়া হবে আকাশ, জল, ফুলেদের শট! অথচ সেখানেও ফেডারেশনের নিয়ম মেনে হেয়ার ড্রেসার, মেকআপ আর্টিস্টকে শুটিংয়ে রাখতেই হবে। তা না করে যদি কেউ অল্প লোকে কাজ সেরে নেন তাহলেই অভিযোগ উঠছে 'গুপি শুটিং' করা হচ্ছে। মানে সেই পরিচালকের উপর খাঁড়া, অন্য কর্মীদের উপর খাঁড়া। ছত্রে ছত্রে অদ্ভুত সব নিয়ম। নিয়ম না মানলেই বহিষ্কার। এই নিয়মের জাল ফেডারেশনের তৈরি। দেশের আইন কিন্তু বলছে, জোর করে কাউকে কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া যায় না। ফেডারেশন তো এক ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন। তারা তো কর্মীকে কাজ দিচ্ছে না। কাজ করার সময় যাতে একজন কর্মীর অধিকার, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয় তা দেখাই কাজ ফেডারেশনের। তাহলে কাজ কেড়ে নেওয়ার জায়গায় ফেডারেশন এল কীভাবে?
গত জুলাই মাসে পরিচালক রাহুল মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে আবারও ফেডারেশনের 'দাদাগিরি' স্পষ্ট হয়। ফেডারেশনের নিয়ম না মেনে বাংলাদেশে গিয়ে শুটিং করার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। ফেডারেশনের চাপ দিয়ে ডিরেক্টর্স গিল্ডকে দিয়ে রাহুল মুখোপাধ্যায়কে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করে। পুজোর সিনেমার পরিচালনা থেকে বাদ পড়ে যান রাহুল। সিনেমার পরিচালককে করে দেওয়া হয় ক্রিয়েটিভ প্রোডিউসর আর সিনেমার পরিচালনার ভার পান সৌমিক হালদার। পরিচালকদের অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। বিষয়টি যে বেআইনি তা প্রমাণসহ দেখানো হয়। কিন্তু ফেডারেশন জানায় বহিষ্কার তুলে নিলেও ফেডারেশন রাহুল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করবে না। রাহুলের শুটিং শুরু হওয়ার দিন দেখা যায়, কোনও টেকনিশিয়ান আসেননি। পরিচলকরা প্রতিবাদে দু'দিন কাজ বন্ধ রাখেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেন গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় এবং দেব। মুখ্যমন্ত্রী কর্মবিরতি তুলে নিতে বলেন। একটি কমিটি গঠন করার কথা বলেন, যারা নাকি সমস্ত সমস্যা খতিয়ে দেখে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিপোর্ট দেবে। সেই কমিটির কোনও নোটিফিকেশন আজ অবধি হয়নি বলেই ইনস্ক্রিপ্টকে জানিয়েছেন সুদেষ্ণা।
সুদেষ্ণা বলছেন, “ডিরেক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার দাবি হচ্ছে, নিয়মগুলো ঠিক করতে হবে। পরিচালকদের কাণ্ডারী হওয়ার কথা। কিন্তু ফেডারেশনই এখানে পরিচালকদের নিয়ন্ত্রণ করছে বেশি। নিয়ম যদি শিল্পের ক্ষতি করে, কাজের ক্ষতি করে তাহলে সেই নিয়ম বদলানোই সময়ের দাবি। আর সারাক্ষণ এই কাজ কেড়ে নেওয়ার ভয়েই অনেকে মুখ খুলতে চাইছেন না। আমাদের ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস তো কোনওদিন শুটিং করেননি। শুটিং কীভাবে হয়, কী সমস্যা হয় বাস্তবে এই নিয়ে তাঁর তো অভিজ্ঞতাই নেই! কীভাবে বুঝবেন তিনি!”
তাহলে অভিজ্ঞতাহীন স্বরূপ কীভাবে মাথা হলেন? কীভাবে টেকনিশয়ানদের সংখ্যাবৃদ্ধি করলেন? কীভাবে কাজ কেড়ে নেওয়ার হুমকিকে টালিগঞ্জের সংস্কৃতি করে তুললেন? রাতারাতি তো নয়। স্বরূপ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠছে তা নতুন নয়। তবে এর শিকড় খুঁজতে গেলে আগে জানতে হবে স্বরূপের উত্থানের আখ্যান।
(পরবর্তী কিস্তিতে)
লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ- madhurima.dutta@nexval.com