জিজ্ঞাসাবাদের নামে সাধারণ মানুষকে হত্যা ভারতীয় সেনার! কাশ্মীরের 'অচ্ছে দিন' তবে এই?

Civilians Killed in Kashmir Military custody : ২০২০ সালেও ভারতীয় সেনাবাহিনী রাজৌরির তিনজন নাগরিককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছিল।

পুঞ্চে সেনাবাহিনীর যানবাহনে জঙ্গি হামলায় চারজন সেনা নিহত হয়েছিলেন কিছুদিন আগেই। এই ঘটনার পরেই সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পাণ্ডে নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন এবং নির্দেশ দেন জোরদার অপারেশন চালাতে। এই হামলার নেপথ্যে কারা? জিজ্ঞাসাবাদ করতেই স্থানীয় মানুষজনকে তুলে নিয়ে যায় সেনা। এতদূর অবধি ঠিকই ছিল। জঙ্গিদের সন্ধান করতে গিয়ে এই তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার ঠিক পরদিনই তিনজনের লাশ মেলে। সেনারা যে আটজন সাধারণ নাগরিককে তুলে নিয়ে গেছিল, তাঁদের মধ্যে তিনজনই মারা গেছেন এবং পাঁচজন গুরুতর আহত। আহতদের রাজৌরির সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের কথা ২৭ ডিসেম্বর থেকে রাজৌরি এবং পুঞ্চ সফর করার। এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনার পাশাপাশি এলাকার সৈন্য ও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলার কথা তাঁর। তাঁর এই সফরের আগেই তবে কি সেনার হাতে জিজ্ঞাসাবাদের নামে নিরীহ মানুষ হত্যার প্রসঙ্গ বিতর্কের বড় ক্ষেত্র হয়ে উঠবে? জম্মু কাশ্মীরের পুলিশ তিনজন সাধারণ নাগরিককে হত্যার অভিযোগে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই ডায়রি করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীও আবার আদালতের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। এই তদন্তে সেনাবাহিনীর দু'টি গাড়িতে জঙ্গি হামলার তদন্তও হবে যাতে চারজন সেনা নিহত হন।

আরও পড়ুন- কাশ্মীরের দুর্দশার জন্য দায়ী নেহরু, বলছেন অমিত শাহ! কী বলছেন কাশ্মীরে মানুষ?

সেনাপ্রধান মনোজ পাণ্ডে ওই এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে ধেরা কি গলিতে যান। রাজৌরিও যান, সেখানে চেইন কমান্ডারদের থেকে পুরো বিষয়টিও শোনেন। জেনারেল পান্ডে সিনিয়র কমান্ডারদের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। রাজৌরি এবং পুঞ্চ অঞ্চলে এই বছর একাধিক বড় জঙ্গি হামলা দেখা গেছে। মে মাসে রাজৌরির একটি জঙ্গলে বিস্ফোরণে পাঁচজন সেনা সদস্যের মৃত্যু হয়। ২০ এপ্রিল পুঞ্চে জঙ্গিদের এক ট্রাকে হামলায় পাঁচ সেনা নিহত হয়েছিলেন। গত সেপ্টেম্বরে, জেনারেল পান্ডে অপারেশনাল প্রস্তুতি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে রাজৌরি সেক্টরে এলওসি বরাবর সামনের অঞ্চলগুলি পরিদর্শন করে, সেখানে সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলেন। মে মাসে জেনারেল পান্ডে এবং কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এই অঞ্চলে বড় সামরিক হামলার পরে রাজৌরি সফর করেন। তারপর ডিসেম্বরের এই হামলা এবং জিজ্ঞাসাবাদের পরে ৩ সাধারণ মানুষের মৃত্যু।

নিহত তিনজনই গুজ্জর উপজাতীয় সম্প্রদায়ের মানুষ। পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই নিহত তিন ব্যক্তি হলেন- মহম্মদ শওকত (২২), সাফির হুসেন (৪৫) এবং শাবির আহমদ (৩২)। গত শুক্রবার সকালে পুঞ্চ জেলার পাহাড়ি টোপা পীর গ্রামে সেনাবাহিনী এদের আটক করে। তারপর ফিরে আসে লাশ। সাফির হুসেনের ভাই জানাচ্ছেন, সাফিরের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। সেনাবাহিনী সাফিরকে তাঁর স্ত্রী ও বাবা-মায়ের সামনেই তুলে নিয়ে যায়।

“সরকার আমাদের জন্য চাকরি ও ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছে। তবে আমরা বিচার চাই, যারা এই নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে তাদের শাস্তি হোক। আমার ভাইয়ের চার সন্তান আছে। পৃথিবীর কোনও টাকাই আমাদের কষ্টপূরণ করতে পারে না। সরকার আমাদের সবকিছুই দেবে কিন্তু আমাদের ক্ষত সারাবে না,” বলছেন সাফিরের ভাই নূর আহমেদ। "আমি ৩২ বছর ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি, বিনিময়ে এই পেলাম?” প্রশ্ন করেছেন নূর। রাজস্থান রাজ্যে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে কাজ করেন তিনি।

আরও পড়ুন- কাশ্মীর থেকে মণিপুর, ক্ষমতার হাতিয়ার যখন ‘ধর্ষণ’

নিহতদের পরিবার জানাচ্ছে, সেনার হেফাজতে মৃত্যু না হলে সরকার ক্ষতিপূরণ ও চাকরি ঘোষণা করত না। সেনা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চায় বলেই এত কিছু। ২০১৯ সাল থেকে কাশ্মীরে কোনও নির্বাচিত স্থানীয় সরকার নেই। সেই বছরই ভারতের এই মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলটির থেকে ৩৭০ ধারার বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নেয় কেন্দ্র সরকার এবং অঞ্চলটিকে দু'টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে - জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ।

আহতদের মধ্যে একজনের কন্যার দাবি, এই সাধারণ মানুষদের তুলে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়েছিল, গোপনাঙ্গে লঙ্কার গুঁড়ো ঢোকানো হয়েছিল, তাদের কোনও প্রশ্ন কিন্তু করা হয়নি। ২০২০ সালেও ভারতীয় সেনাবাহিনী রাজৌরির তিনজন নাগরিককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছিল। জঙ্গি হিসেবে দাগিয়ে দিলেও পরে তদন্তে জানা যায় এই হত্যার পিছনে সেনাবাহিনীই ছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ আদালত অন্যায় স্বীকার করে এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য একজন অফিসারকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। তবে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা নথিভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও অভিযুক্ত সেনাদের বিরুদ্ধে খুব কমই বিচার হয়েছে।

 

More Articles