এক কামরায় ৮০ জন, পোকা দিয়ে ভাত! 'বাংলাদেশি নই' প্রমাণে ডিটেনশন ক্যাম্পে যেভাবে কাটে দিন
CAA-NRC and Detention Camp: ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দিদের সংখ্যা ২০১৪ সালের পরে ব্যাপক বেড়েছে।
কোনও কথা নেই, নোটিশ নেই, আগাম কোনও সতর্কতাও নেই। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরের এক সকালে বাড়ি থেকে রবীন্দ্র মল্লিককে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় অসম পুলিশ। কে রবীন্দ্র মল্লিক? অসমের হাজার হাজার বাংলাভাষী মানুষদের একজন তিনি যাদের, 'বিদেশি' ঘোষণা করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। অক্সিগুড়িতে তাঁর গ্রাম। সেখান থেকে ভারত-ভুটান সীমান্তের ৭০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে একটি ডিটেনশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয় রবীন্দ্র মল্লিককে। এর পরের চার বছর বাংলাদেশ থেকে অসমে অবৈধভাবে ঢুকে পড়ার অভিযোগে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল।
বাংলাদেশ থেকে ঢুকে পড়া মানুষরা অসমের রাজনীতির অন্যতম চালক ছিল বরাবরই। আর গত দশ বছরে মোদির শাসনে ভারতীয় জনতা পার্টি এই অভিবাসন ইস্যুকে সিএএ-এনআরসির ধুয়ো তুলে জাতীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আর এই রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠা রবীন্দ্র মল্লিকের মতো মানুষদের শেষ জীবন কেটে যাচ্ছে নিজের অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টায়।
২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি বিদেশি ট্রাইব্যুনাল রবীন্দ্র মল্লিককে 'বিদেশি বলে ঘোষণা করে। স্ক্রোল ডট ইনের এক প্রতিবেদনে রবীন্দ্র জানান, তিনি বাংলাদেশের নন। তাঁর বাবা কোচবিহারের ছিলেন। তবে, অসমের অক্সিগুড়ি গ্রামের ১৯৬৬ এবং ১৯৭০ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৬৬ সালে তাঁর বাবার বয়স ছিল ২৬ বছর। তাহলে ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় তাঁর বাবার নাম থাকলে কীভাবে তিনি 'বিদেশি' হলেন?
আরও পড়ুন- মতুয়ারা হাসছেন, অসম ফুঁসছে! কেন বিজেপি শাসিত অসমে CAA-র তীব্র বিরোধিতা?
রবীন্দ্র মল্লিকের বয়স এখন ৬১। জ্বালানি কাঠ বিক্রি করে কোনওমতে অনিশ্চিত জীবন কাটান। মাটি, বাঁশ ও টিনের চালের ছোট্ট ঘরে থাকেন। তাও এই বিদেশি ট্রাইব্যুনালের মামলাকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন রবীন্দ্র মল্লিক। আর তা করতে গিয়েই বুঝেছিলেন, গরিব মানুষের মামলা লড়া বড় বালাই। আইনের প্যাঁচ পয়জার বোঝাও তাঁর মতো দরিদ্রের পক্ষে সম্ভব নয়। তাঁর ছোট ভাই খগেন্দ্র মল্লিক বলেছিলেন, দুইবার নোটিশ পেয়েছিলেন তারা কিন্তু দারিদ্র্য ও অশিক্ষার কারণে সেসবের বক্তব্য বুঝতে পারেননি। তারা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি ওই নোটিশগুলি না মানলে এবং মামলা না লড়লে ডিটেনশন ক্যাম্পে জীবন শেষ হয়ে যাবে। হাইকোর্টে সে মামলা খারিজও হয়ে যায়।
প্রায় চার বছর ডিটেনশন ক্যাম্পে কাটান রবীন্দ্র মল্লিক। ক্যাম্পের ভয়াবহ পরিবেশে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ভেঙে যায় আরও। একসঙ্গে ৫০ থেকে ৮০ জন মানুষ এক কামরাতে বন্দি। “আমাদের পোকামাকড় দিয়ে ভাত খেতে হতো," বলছেন রবীন্দ্র। কাজ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন এখন তিনি। ২০২০ সালে সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশের ফলে মুক্তি পান রবীন্দ্র। দেশের শীর্ষ আদালত নির্দেশ দেয়, ডিটেনশন ক্যাম্পে তিন বছরের বেশি বন্দি অবস্থায় কাটিয়েছে এমন মানুষদের মুক্তি দিতে হবে। তবে শর্ত একটাই। সেই ব্যক্তিকে সপ্তাহে একবার থানায় রিপোর্ট করতে হবে।
এ আরেক যন্ত্রণা। রবীন্দ্র মল্লিক যেখানে থাকেন, সেখান থেকে থানা ২০ কিলোমিটার দূর। যেতে তাঁর খরচ ১০০ টাকা অন্তত। একবার ডিটেনশন ক্যাম্প, একবার থানা, রবীন্দ্রর আসলে কোনও মুক্তি নেই। এলোপাথাড়ি তাঁকে রাষ্ট্র গড়িয়ে দিচ্ছে কখনও এই নালায়, কখনও ওই নর্দমায়।
রবীন্দ্র মল্লিক বলছেন, বাঙালি হওয়াতেই এই নির্যাতন, যুগ যুগ ধরে চলছে এসব। শুধু বাঙালি মুসলমান এবং বাঙালি হিন্দুদেরই 'বহিরাগত' বা 'বিদেশি' বলা হয়েছে। অসমিয়ারা কিন্তু এই তালিকায় নেই। গত এক দশকে অসমে এই 'বিদেশি' বা 'বহিরাগত' বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক টানাপড়েন বেড়েছে। ২০১৮ সালে, অসমের সমস্ত বাসিন্দাদের নাগরিকত্ব যাচাই করার পরে একটি খসড়া জাতীয় নাগরিক রেজিস্টার প্রকাশিত হয়েছিল। সেই তালিকা থেকে বাদ পড়ে যান ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ।
আরও পড়ুন- নোটবন্দির স্মৃতি উস্কে দেশ জুড়ে চালু সিএএ আইন, কতটা ছাপ পড়বে ভোটবাক্সে?
ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দিদের সংখ্যা ২০১৪ সালের পরে ব্যাপক বেড়েছে। বেশিরভাগ বন্দিই অসমের বাসিন্দা যাদের বিদেশি ট্রাইব্যুনাল ডি-ভোটার বা 'সন্দেহজনক ভোটার' হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এরা ভিসা বা অন্য কোনও নথি ছাড়াই ভারতে প্রবেশ করেছিল।
২০১৪ সালে, অসমের হিন্দু বাঙালি ভোট চাইতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি দাবি করেছিলেন, তিনি এই ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি বন্ধ করে দেবেন। অথচ ২০১৬ সালেই রবীন্দ্র মল্লিককে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালিদের ভোট টানতে মোদি সরকার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নামে একটি নতুন আইন প্রবর্তন করেছে। যার ফলে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের অমুসলিম অভিবাসীরা ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। তবে তাতে রবীন্দ্র মল্লিকের চিন্তা কমে না। তিনি জন্মেছেন ভারতে, তাই নিজেকে বাংলাদেশি ঘোষণা করে কেনই বা নাগরিকত্ব চাইবেন তিনি? তিনি বলছেন, "বাংলাদেশের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। আমার জন্ম ভারতে। আমার পূর্বপুরুষরা কোচবিহারের লোক। আমি কেন CAA-এর অধীনে আবেদন করতে যাব?”
নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও এবং ভারতে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও কেন তাঁকে নিজেকে আগে বাংলাদেশি বলে প্রমাণ করতে হবে? আর যদি করেনও, কত বছর আর তিনি নিজের নাগরিকত্বের জন্য লড়বেন? তবে সবচেয়ে মজার বিষয় এখানেই। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই রবীন্দ্র মল্লিককে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তাও অসমের অনেক অনেক হিন্দু বাঙালির মতোই তাঁর পরিবার এখনও বিজেপিকেই সমর্থন করে চলেছে। "বিজেপি কে দিবোনা কাকে দিবো?", ভোট নিয়ে সহজ প্রশ্ন বৃদ্ধ রবীন্দ্র মল্লিকের। তিনি বিশ্বাস করেন, মোদি ভালোই চাইছেন, অসমের নানা গোষ্ঠীগুলির চাপে পারছেন না। তা ডিটেনশন ক্যাম্পে পোকা দিয়ে ভাত খেতে হোক না কেন, 'মোদিজি নে কিয়া হোগা তো সহি হোগা'।