দশভুজা নয়, ঠুঁটি দেবী! এই আশ্চর্য দুর্গার রহস্য আজও গা ছমছমে

Bankura Thuto Maa: মহাষ্টমী পুজোর শেষে একটি দশ বছরের মেয়ে দেবীর মন্দিরে সন্ধ্যা প্রদীপ দেখাতে যায়। তারপর থেকেই তাকে আর পাওয়া যায়নি

SD

'ঠুঁটি মা'। এমন এক দেবী, যার কাহিনির পরতে পরতে নানা রোমাঞ্চ থাকলেও, আজও তা বহু মানুষের অজানা। এমন এক দেবী, যার পুজো আর মূর্তি নিয়ে আজও নানা কাহিনি, লোককাহিনি ও রহস্য ঘুরে বেড়ায় গ্রামজুড়ে। শুধুমাত্র রহস্যময়ী প্রতিমা নয়, লোকবিশ্বাসে তা এক বিশেষ শক্তির প্রতীক। বসন্তের সকাল, এক কাপ চা, প্রিয় পত্রিকা আর এই কাহিনি – যে কোনও থ্রিলারকে হার মানাতে পারে।

বালসি গ্রাম এবং ঠুঁটি মা-এর ইতিহাস

বাঁকুড়া জেলার এক ঐতিহাসিক এবং প্রসিদ্ধ গ্রাম বালসি, বিষ্ণুপুর শহর থেকে মাত্র পনেরো মাইল দূরে অবস্থিত। এই গ্রামের আয়তন অনেক বড়, যেখানে দু'টি পঞ্চায়েত এবং বাইশটি পাড়া রয়েছে। গ্রামের মধ্যে রয়েছে একাধিক প্রাচীন মন্দির, দিঘি। গ্রামে এক বাগধারা অতি প্রচলিত– "বালসি গ্রাম তিনটি জিনিসের জন্য বিখ্যাত: ঠাকুর, পুকুর আর কুকুর।" ঠুঁটি মা যেন এক মায়াবী শক্তির প্রতীক। উনিশ শতকের শেষদিকে, যখন গ্রামটি আরও সমৃদ্ধি লাভ করতে শুরু করেছিল, তখন থেকেই ঠুঁটি মায়ের পুজো আড়ম্বরপূর্ণভাবে শুরু হয়। বিশ্বাস যে, এই দেবী এক বিশেষ রহস্যময়ী প্রতিমা, যিনি গ্রামবাসীদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন এবং তাদের জীবন সমৃদ্ধ করেন।

আরও পড়ুন- ৪০০ বছর ধরে বাংলায় হয় কালো দুর্গার পুজো! কোন ইতিহাস লুকিয়ে আড়ালে

কাহিনি অনুযায়ী, আনুমানিক ১১২০ খ্রিস্টাব্দে, এক স্নেহশীল এবং ধর্মপ্রাণ বিধবা বৃদ্ধা নাকি গ্রামে শ্রী বিষ্ণুর পূজা করতেন। গ্রামে যেসব সাধু-সন্তরা আসতেন, তারা সকলেই তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নিতেন এবং তিনি তাদের সেবা করতেন। এমন এক সময়ে, এক যোগসিদ্ধ সাধু বৃদ্ধার সেবায় অত্যন্ত তুষ্ট হয়ে তাঁকে দেবতার মূর্তি দেওয়ার কথা বলেন। সেই রাতেই নাকি স্বয়ং নারায়ণ বৃদ্ধার স্বপ্নে উপস্থিত হন এবং জানান, সাধুর জটার ভিতরে এক বিশেষ লক্ষ্মী-নারায়ণ মূর্তি লুকানো রয়েছে। এটি নিয়ে তার পুজো করার নির্দেশ দেন বৃদ্ধকে।

কয়েকদিন পর, সেই সাধু বৃদ্ধার কাছে এলে স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী বৃদ্ধা মূর্তিটি নিতে চান। সাধু স্মিত হেসে মূর্তিটি তাঁকে দান করেন। বৃদ্ধা এবং তাঁর নাতি মোহন নন্দী তা গ্রহণ করেন। এই মোহন নন্দী পরে চৌধুরী জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা হন। ১১৫৯ সালে লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির স্থাপন করা হয়। তারপরেই তিনি বিশেষ ধনসম্পত্তি ও অনেক খ্যাতি লাভ করেন এবং তৎকালীন বিষ্ণুপুরের রাজা তাঁকে 'চৌধুরী' উপাধি দেন।

এর কিছুদিন পর সেই যোগসিদ্ধ বাবার আবির্ভাব হয় হাতির পিঠে চড়ে। সেই সাধু মোহন নন্দীকে আদেশ দেন দুর্গার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে। আদেশ মেনে মহাধুমধামে পূজা শুরু করেন মোহন নন্দী, যা ছিল ওই গ্রামে প্রথম দুর্গাপুজো। পুজোর জন্য পূজারি ও মিশ্র বংশের লোকদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

আরও পড়ুন- মৃৎশিল্পীর ভুলে দেবী হয়ে গেলেন নীল, কৃষ্ণনগরের দুর্গাপুজোর ইতিহাস আজও বিস্ময় জাগায়

ঠুঁটি মায়ের মূর্তির রহস্য

গল্পের সবচেয়ে রহস্যময় অংশ হলো ঠুঁটি মায়ের মূর্তির গঠন এবং পূজা পদ্ধতি। প্রথমে দুর্গার দশভুজা মূর্তিই প্রতিষ্ঠা করা হয় কিন্তু এক রহস্যময় ঘটনা বদলে দেয় সমস্ত গ্রামের ইতিহাস! একবার মহাষ্টমী পুজোর শেষে একটি দশ বছরের মেয়ে দেবীর মন্দিরে সন্ধ্যা প্রদীপ দেখাতে যায়। তারপর থেকেই তাকে আর পাওয়া যায়নি, চারিদিক তল্লাশি চলতে থাকে কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। পরের দিন, পুজোর সময় পুরোহিতরা লক্ষ্য করেন দেবীর মুখে একটি কাপড়ের টুকরো রয়েছে, যা সেই মেয়েটির পরনে ছিল। সমস্ত পরিবার ও গ্রামবাসী ভীত, সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

এর পর থেকেই দশভুজা রূপের পরিবর্তন করা হয় এবং ঠুঁটি মায়ের মূর্তির আবির্ভাব হয়। এই রূপে দেবীর মুখপট ছাড়া আর কোনও অঙ্গ নেই! তাই নামকরণ হয় ঠু্ঁটি মা। মূর্তি তৈরির উপাদানও বেশ অদ্ভুত। মূর্তির জন্য কোনও মাটি বা কাঠ ব্যবহৃত হয় না। পরিবর্তে, মূর্তি তৈরি হয় পাটকাঠি, কঞ্চি, তিনটি বেল, নবপত্রিকা এবং হলুদ কাপড় দিয়ে। দেবীর মাথার অংশ হলো একটি বেল, যা এই প্রতিমার অন্যতম আকর্ষণ।

প্রতি বছর দুর্গাপুজো উপলক্ষ্যে ঠুঁটি মায়ের পুজো অনুষ্ঠিত হয়। চৌধুরী বংশের চতুর্দশতম বংশধররা এখনও এই পুজোর আয়োজন করেন এবং তা একেবারে প্রাচীন নিয়ম মেনেই। গ্রামবাসী ও দূর-দূরান্তের মানুষ মিলিত হন এই মহাযজ্ঞে। বলা হয়, দেবী ঠুঁটি মায়ের অশেষ কৃপায় একাধিকার গ্রামবাসীরা নানা সমস্যার সমাধান পেয়েছেন। আজও বালসি গ্রামের ঠুঁটি মায়ের পুজো নিয়ে নানা কাহিনি বহমান। গ্রামের বিশ্বাস ঠুঁটি মায়ের পুজোর মধ্য দিয়ে যেন একটি অদৃশ্য শক্তি গ্রামবাসীদের জীবনকে সুরক্ষিত রাখে। 

বালসি গ্রামের ঠুঁটি মা শুধুমাত্র এক দেবীপ্রতিমা নয়, এক জীবন্ত রূপকথা। ঠুঁটি মায়ের গল্প কেবল ইতিহাস নয়, এক রহস্যকল্পও যা আজও টেনে আনে বহু মানুষকে, অখ্যাত এই গ্রামে।

More Articles