কেন অভয়া কাণ্ডের পরও তৃণমূল কংগ্রেস ধাক্কা খেল না?

WestbengalBy-election2024:দ্রোহের সময় কেন তৃণমূল কংগ্রেস ধাক্কা খেল না?গ্রাম বাংলার মানুষ অবধি কি সেভাবে পৌঁছতেই পারেনি অভয়া আন্দোলন?লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাওয়া থেকেই কি বদলানো গেল না পরিস্থিতি?

পশ্চিমবঙ্গের ৬টি আসনেই উপনির্বাচনের ফল ছিল আজ। বেলা গড়াতে বোঝা গেল তৃণমূল জিতছে। অভয়া কাণ্ডের পর পশ্চিমবঙ্গে এই প্রথম নির্বাচনের সুযোগ এসেছিল। অনেকের কৌতূহল ছিল এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে। উপনির্বাচনের ফল বলে দিচ্ছে আরজি কর কাণ্ড প্রত্যাশিত দাগ কাটতে পারল না। শেষ হাসি হাসল রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। ৬টি আসনেই তাদের জয়জয়কার। প্রথমবার আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট বিধানসভা আসনে তৃণমূল কংগ্রেস জয়ী হয়েছে। আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট কেন্দ্রে ২৮১৬৮ ভোট ব্যবধানে জয়প্রকাশ টোপ্পো, কোচবিহারের সিতাই কেন্দ্রে ১৩০৬৩৬ ভোট ব্যবধানে সঙ্গীতা রায়, পশ্চিম মেদিনীপুরের মেদিনীপুর কেন্দ্রে ৩৩৯৯৬ ভোট ব্যবধানে সুজয় হাজরা , উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ায় ১৩১২৮৪ ভোট ব্যবধানে শেখ রাবিউল ইসলাম এবং নৈহাটি কেন্দ্রে ৪৯২৭৭ ভোট ব্যবধানে সনৎ দে ও বাঁকুড়ার তালডাংরা কেন্দ্রে ৩৪০৮২ ভোট ব্যবধানে ফাল্গুনী সিংহ বাবু জয়ী হয়েছেন।

গত কয়েক মাসে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল বঙ্গ রাজনীতি। অস্বস্তিতে পড়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। আরজি করের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অভয়া আন্দোলন, সম্পূর্ণ ভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন ছিল না। কোনো রাজনৈতিক দলের ঝান্ডার তলায় নয়, মানুষ বেড়িয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। কিছু মাস ধরে নাগরিকদের ব্যাপক রকম বিক্ষোভ প্রতিদিন হয়ে গিয়েছে। দিন-রাত জুনিয়ার ডাক্তারদের বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন সাধারণ মানুষ। এই ঘটনা কিন্তু এর আগে কখনও হয়নি।

১৪ ই অগস্টের রাত দখল, তারপর ৪ সেপ্টেম্বর, ৯ সেপ্টেম্বর এবং দ্রোহের কার্নিভালের দিন যা হল তা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর পার্ক স্ট্রিটের একটি দামী রেস্তোরাঁয় ৯ মিনিট ধরে কোনো খাবার পরিবেশন করা হয়নি, কফি হাউসেও নিষ্প্রদীপ করে রেখে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছিল, দলে দলে মানুষ এসে বিক্ষোভ করেছিল। এখানে কোনো দল ছিল না, কোনো ঝান্ডা ছিল না। একটা সময় পর আন্দোলনের রাশ চলে যায় ডাক্তারদের হাতে। অনেকেই দাবি করেছেন, মূল দাবি থেকে ডাক্তাররা সরে যাচ্ছেন। কিন্তু এও ভুলে গেলে চলবে না যে ডাক্তাররা গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন প্রকাশ্যে এনেছেন।

এখন এই নাগরিক আন্দোলন প্রায় থিতিয়ে গিয়েছে। অভয়া আন্দোলনের সময় স্বাধীন মতের বিস্ফোরণ দেখা গিয়েছিল। অভিযোগ, মিটিং-মিছিল-সমাবেশে আক্রমণও চালিয়েছিল শাসকদলের ঘনিষ্ঠরা। তবুও আন্দোলন থামেনি আরও জোরালো হয়েছিল। অনেকেই বলেছিলেন, এটার একটা নেতিবাচক দিকও আছে। তাদের মত ছিল, কোনো একটি রাজনৈতিক ঘটনার পরিবর্তন আনতে চাইলে রাজনৈতিক অভিমুখ থাকা উচিত। এই গণ-আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক অভিমুখ ছিল না। তাহলে, তার জন্যই কি এই আন্দোলন বিরাট কোনো টার্ন নিতে পারল না?

বলে রাখা ভাল, আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ চলতে চলতেই রাজ্যে আরও ধর্ষনের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু কলকাতার বেশিরভাগ নাগরিক মিছিলেই স্লোগান 'জাস্টিস ফর আরজি কর' এই আটকে ছিল। যদি ১০% মানুষের মধ্যে স্লোগান উঠত 'জয়নগর টু আরজিকর', বাকি ৯০%-র মুখেই ছিল 'জাস্টিস ফর আরজি কর'। স্লোগানেই খানিক আন্দাজ করা যায় যে, একই ঘটনা শহরে এবং মফস্বলে ঘটলেও, শহরের ঘটনাটির মতো অভিঘাত মফস্বলের ঘটনা তৈরি করতে পারেনি। তাই জয়নগররের মতো মফস্বল এবং গ্রাম বাংলার ঘটনা প্রত্যাশিত আলোড়নও তৈরি করতে পারেনি। অনেকেই মনে করছেন, এর জন্য যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক দুই প্রেক্ষাপটই রয়েছে।

এই নির্বাচনকে কাটাছেঁড়া করে দেখলে বোঝা যাবে তৃণমূল কংগ্রেস ৬টা আসনই পেয়েছে অবশ্যই। কিন্তু সেই নির্বাচনী ফলাফলের গভীরে কী লুকিয়ে আছে? ৬টি আসনের মধ্যে নৈহাটি ও মেদিনীপুর শহরাঞ্চল। এখানে কিছু পঞ্চায়েত এলাকা থাকলেও তা শহরঘেঁষা। আর বাকি ৪কেন্দ্র সিতাই, মাদারিহাট, তালড্যাংরা এবং হায়োড়া গ্রামাঞ্চল। নির্বাচনী ফলাফলে এর কোনো প্রভাব গ্রাম বাংলায় দেখা যাচ্ছে না। অনেকেরই মত ছিল এই আন্দোলন ছিল নগরকেন্দ্রিক। গ্রামাঞ্চলে এই আন্দোলনের স্বতস্ফূর্ততা দেখা যায়নি। অন্যদিকে, লক্ষীর ভাণ্ডার, বিনামূল্যে রেশন, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী মতো প্রকল্প চলে রাজ্যে। নির্বাচনী প্রচারে তৃণমূল কংগ্রেস বার বার এই কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। তবে, বিরোধীরা এই যুক্তিও দিচ্ছে যে বাংলায় স্বচ্ছ ভোটপ্রক্রিয়া হয় না।

দ্রোহের সময় কেন তৃণমূল কংগ্রেস ধাক্কা খেল না? অভয়া আন্দোলন শুধু শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল বলে? গ্রাম বাংলার মানুষ অবধি কি সেভাবে পৌঁছতেই পারেনি অভয়া আন্দোলন? প্রশ্ন এও থাকছে যে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাওয়া থেকেই কি বদলানো গেল না পরিস্থিতি?

More Articles