ইজরায়েলি হামলায় নিহত ইরানের শীর্ষ জেনারেলরা! প্রত্যাঘাত অবশ্যম্ভাবী?

Israeli attack : ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা সূত্র জানিয়েছে, শুধু পারমাণবিক স্থাপনাই নয়, বরং ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যাটারি, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, অস্ত্রাগার, পরীক্ষাগার এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাসভবনও লক্ষ্যবস্...

শুক্রবার সকালের আলো ফোটার আগেই ইজরায়েল এক নজিরবিহীন সামরিক অভিযানে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনাগুলিতে ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছে। এই অভিযানে ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কর্পস (IRGC)-এর প্রধান জেনারেল হোসেইন সালামি-সহ অন্তত তিনজন শীর্ষ জেনারেল নিহত হয়েছেন। তেহরানের নিরাপত্তা এবং সামরিক কাঠামোর হৃদয়ে এই সরাসরি হামলা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক ও সামরিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে এবং একটি পূর্ণমাত্রার আঞ্চলিক যুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। ইজরায়েল এই হামলাকে একটি 'প্রি-এম্পটিভ স্ট্রাইক' হিসেবে বর্ণনা করেছে, যার মূল লক্ষ্য ছিল ইরানের সম্ভাব্য পারমাণবিক বোমা প্রস্তুতিকে রুখে দেওয়া।

ইজরায়েলি প্রতিরক্ষা সূত্র জানিয়েছে, শুধু পারমাণবিক স্থাপনাই নয়, বরং ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যাটারি, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি, অস্ত্রাগার, পরীক্ষাগার এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বাসভবনও লক্ষ্যবস্তু ছিল। এই অভিযানের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রেসিডেন্ট খামেনির পাঠ করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, 'ইসরায়েল নিজেকে এক বেদনাদায়ক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।' খামেনি স্পষ্ট ভাষায় প্রতিশোধের ইঙ্গিত দেন, যদিও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ করা এড়িয়ে যান। তবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করেছে, জানিয়েছে , 'এই হামলা ওয়াশিংটনের অনুমোদন ছাড়া সম্ভব হতো না।' নিহতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, ইরানের সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ। IRGC এক বিবৃতিতে সালামিকে 'জাতীয় প্রতিরক্ষার অগ্রভাগে থাকা এক মহান যোদ্ধা' বলে বর্ণনা করেছে। এই হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে যুক্ত কয়েকজন সিনিয়র বিজ্ঞানীও নিহত হয়েছেন বলে ইঙ্গিত দিয়েছে খামেনির বিবৃতি। হামলার পর মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক মানচিত্রে একরকম কম্পন অনুভূত হয়েছে।

ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে বলেন, 'আমাদের অভিযান সফল হয়েছে। যদি ইরান প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে আমাদের জনগণকে প্রস্তুত থাকতে হবে।' নেতানিয়াহুর এই বক্তব্যের পর ইজরায়েলের জনজীবনে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। সাধারণত সাব্বাথের প্রাক্কালে সরব বাজার ও রাস্তা ছিল ব্যতিক্রমীভাবে ফাঁকা। খাদ্যসামগ্রী ও জ্বালানির দোকানগুলিতে ভোরের আগে থেকেই ভিড় দেখা গেছে। অন্যদিকে জর্ডান, ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যবর্তী রাষ্ট্র হিসেবে, আকাশসীমা সাময়িকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে। দেশটির বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আঞ্চলিক উত্তেজনার কারণে তারা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।

গত বছর ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র জর্ডানের আকাশ দিয়ে ইজরায়েল অভিমুখে যাওয়ায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বজুড়ে তাৎক্ষণিক কাঁপন অনুভূত হয়েছে অর্থনৈতিক মঞ্চেও। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম এক ঘণ্টার মধ্যেই ৯ শতাংশ বেড়ে প্রতি ব্যারেল ৭৮ ডলারে পৌঁছেছে। বিনিয়োগকারীদের আশঙ্কা, এই বৃদ্ধির ধারা বজায় থাকলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি তীব্র হবে, বিশেষত তেল আমদানিনির্ভর দেশগুলিতে। এই হামলা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে ওমানের মাধ্যমে পারমাণবিক আলোচনার সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা চলছিল।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ফক্স নিউজকে জানিয়েছেন ইজরায়েলের হামলার পরিকল্পনার বিষয়ে তিনি আগে থেকেই জানতেন, হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্বের অনুপস্থিতিকে কূটনৈতিক আলোচনার নতুন সুযোগ বলে উল্লেখ করেন। তবে, ওমান এই হামলাকে 'বিপজ্জনক ও বেপরোয়া' বলে সমালোচনা করেছে এবং তা কূটনৈতিক পথ রুদ্ধ করে দিতে পারে বলে সতর্ক করেছে। ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঘনিষ্ঠ সূত্রের বরাতে জানিয়েছেন, তিনি রবিবার ওমানে ইরানি প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনায় বসার পরিকল্পনা করছেন। কিন্তু হামলার ফলে এই পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই হামলা ইজরায়েল ও ইরানের দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধকে এক নতুন, অনেক বেশি প্রকাশ্য ও বিস্ফোরক পর্যায়ে নিয়ে গেছে। অতীতে ইজরায়েল একাধিকবার গোপন অপারেশনের মাধ্যমে ইরানি বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাদের হত্যা করলেও, এই ধরনের সরাসরি ও বিস্তৃত আক্রমণ নজিরবিহীন। এটি শুধু ইরানের সামরিক কাঠামোর উপর সরাসরি আঘাত নয়, বরং এক ধরনের রাজনৈতিক বার্তা— যা স্পষ্টভাবে বলছে, ইজরায়েল আর অপেক্ষা করবে না। পরিস্থিতি কোনদিকে মোড় নেবে, তা এখন নির্ভর করছে ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপের উপর। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এই সংকট নিরসনে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছেন, কিন্তু যুদ্ধ যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে এর প্রভাব শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বকেই নাড়া দিতে পারে— বিশেষত জ্বালানি, খাদ্য, আন্তর্জাতিক পরিবহন এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের দিক থেকে।

More Articles