অবশেষে সূর্যকে ছুঁয়ে দেখলেন বিজ্ঞানীরা! যা জানা গেল 'টাচ দ্য সান’ অভিযান থেকে

Parker Solar Probe: সূর্যপৃষ্ঠের তীব্র উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য ৮ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট ৪.৫ ইঞ্চি পুরু কার্বন-কার্বন কম্পোজিট পদার্থের ঢাল ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি ১৩৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে।

চাঁদ, মঙ্গলের পর সূর্যকেও ছুঁয়ে ফেললেন বিজ্ঞানীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার পাঠানো সৌরযান, ‘পার্কার সোলার প্রোব’ গত ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সূর্যপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬১ লক্ষ কিলোমিটার দূরে করোনা অঞ্চল ছুঁয়ে গেছে। মনে হতেই পারে এ তো ঢের অনেক দূরত্ব? কিন্তু পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্বের সাপেক্ষে এ নেহাত সামান্য। বছর ছয়েকেরও বেশি আগে, ২০১৮ সালের ১২ অগাস্ট ভোর ৩টে ৩১মিনিটে ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালস্পেস ফোর্স স্টেশন থেকে শক্তিশালী ‘ডেল্টা-ফোর’ রকেটে চেপে মহাকাশে পাড়ি জমিয়েছিল অত্যন্ত দ্রুত গতির এই সৌরযান। এর সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘণ্টায় ৬ লক্ষ ৯২ হাজার কিলোমিটার, অর্থাৎ আলোর গতির প্রায় ০.০৬৪%, মানে সেকেন্ডেই কলকাতা থেকে বহরমপুর!

গত প্রায় ছয় দশক ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চেষ্টা করে আসছে সূর্যের কাছে যাওয়ার, কিন্তু সূর্যকে এত কাছ থেকে এর আগে কোনও মহাকাশযান পর্যবেক্ষণ করেনি। এমনকী ‘পার্কার সোলার প্রোব’-ও শেষ সাত বছরে কখনই সূর্যের এত কাছে আসতে পারেনি। কেন এত গুরুত্বপূর্ণ এই মিশন?

সূর্যের আলোই আমাদের জীবজগতের খাদ্য তৈরির অন্যতম রসদ। এত বিপুল পরিমাণ শক্তি সে পায় কোথা থেকে? এর নেপথ্যে আছে নিউক্লিয়ার সংযোজন। সূর্যের কেন্দ্রে উৎপন্ন এই অমিত শক্তি প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন অংশে। আর এ ব্যাপারে সাহায্য করছে সূর্যালোক, সৌরবায়ু ও প্রচণ্ড শক্তিশালী সৌর চুম্বকক্ষেত্র। এছাড়াও সূর্যের বায়ুমণ্ডলে আকস্মিক চুম্বকক্ষেত্রের পরিবর্তনের জন্য মাঝেমধ্যে তীব্র বিস্ফোরণ হয়। যার ফলে সৌর বর্ণালীর তীব্রতা হঠাৎ করে বদলে যায়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন 'সৌরশিখা' বা 'সৌর-প্রজ্জ্বলন'। এই প্রকাণ্ড বিস্ফোরণের সময় সূর্যের বাইরের করোনা অঞ্চল থেকে কিছু ইলেকট্রন, প্রোটন ও কিছু ভারী নিউক্লিও পদার্থগুলি প্রচণ্ড বেগে (প্রায় ৯০০ কিলোমিটার প্রতি সেকেন্ড) বেরিয়ে আসে। সূর্যের নিরিখে এই বিক্ষিপ্ত কণাগুলির ভর নেহাতই নগণ্য, কিন্তু আইনস্টাইনের 'ভর-শক্তির তুল্যতা' সূত্রানুযায়ী, সেই নগণ্য ভরই যে পরিমাণ শক্তি বহন করে তা কিন্তু নগণ্য নয়। সূর্যপৃষ্ঠে অবস্থিত উচ্চ তাপমাত্রা বিশিষ্ট প্লাজমা আবরণ থেকে তীব্র বেগে নির্গত এই তড়িদাহত কণার স্রোত মাঝেমধ্যেই তীব্র গতিতে ধেয়ে আসে পৃথিবীর দিকে, যার নাম ‘করোনাল মাস ইজেকশন’ বা ‘সিএমই’, যেটি কিনা পৃথিবীতে আঘাত করে ভূ-চৌম্বকীয় ঝড় সৃষ্টি করে। এই সমস্ত ঝড় পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের একেবারে বাইরে অংশ থেকে আয়নোস্ফিয়ার বা আয়নমণ্ডল, এমনকী তার নিম্নে অবস্থিত কিছু স্তরগুলিতেও প্রভাব বিস্তার করে। মহাজাগতিক এই ঝড়ের নাম 'সৌরঝড়' বা 'সোলার স্টর্ম'।

আরও পড়ুন- মেঘ পাতলা করা, সূর্যরশ্মি আটকে দেওয়ার নামে যে বিপুল ক্ষতি করছেন জিও-ইঞ্জিনিয়াররা

শক্তিশালী সৌর-ঝড়ের সময়ে উদ্ভূত তীব্র তড়িৎচুম্বক বল বৈদুতিক ট্রান্সফর্মারের ওপর বাড়তি বল প্রয়োগ করে বৈদুতিক-গ্রিডকে নষ্ট করে দেয়। ফলত বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হয়। এমনকী বেতার ও যেকোনও টেলি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় এর জন্যই। পরিবেশের জন্যও এই ঝড় বেশ ক্ষতিকারক, কারণ এটি বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরকে ধ্বংস করে। গত শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে এই সৌরঝড়ের ফলে আমেরিকার টেলিভিশন ব্যাবস্থা পুরোপুরি নষ্ট হয়। আশির দশকের শেষে কানাডার কুইবেক শহরে সৌরঝড়ের কারণে বিদ্যুৎ-গ্রিড নষ্ট হয়ে এক বিস্তীর্ণ জনপদের ইলেকট্রিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এখন ইন্টারনেটের যুগে কী অবস্থা হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এই সৌরঝড়ের গতি, প্রকৃতি, সময় ভেদে করোনার তাপমাত্রার হেরফের (সৌর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, কিন্তু করোনার তাপমাত্রা কখনও কখনও তো দশ লক্ষ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়)— এই সব বুঝতে গেলে দরকার সূর্যকে কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করা। সেজন্যই ‘টাচ দ্যা সান’ অভিযান।

প্রায় ষাট বছর আগে সৌরবায়ুর অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন তরুণ বিজ্ঞানী ইউজিন পার্কার। এখনও পর্যন্ত তিনিই একমাত্র জীবিত বিজ্ঞানী, যাঁর সম্মানে নাসা এই সৌরযানের নামকরণ করেছে ‘পার্কার সোলার প্রোব’। এত উচ্চ তাপমাত্রায় পৌঁছনো সম্ভব হলেও টিকে থাকাটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নাসার বিজ্ঞানীদের কাছে। কারণ করোনা গহ্বর থেকে প্রতিনিয়ত নির্গত উচ্চগতির সৌরবায়ু ও বিকিরণ যেকোনও সময় প্রোবকে বিকল করে দিতে পারে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন নাসা। সূর্যপৃষ্ঠের তীব্র উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য ৮ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট ৪.৫ ইঞ্চি পুরু কার্বন-কার্বন কম্পোজিট পদার্থের ঢাল ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি ১৩৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। দু'টি কার্বন প্লেটের মধ্যে স্যান্ডউইচের মতো একটি কার্বন কম্পোজিট ফোম দিয়ে এই হিট শিল্ড বানিয়েছে জন্স হপকিন্স অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স ল্যাবরেটরি। এটির সূর্যের দিকে থাকা মুখে সাদা সেরামিক রংয়ের প্রলেপ দেওয়া হয়েছে, যাতে সূর্যের অধিকাংশ তাপ প্রতিফলিত করতে পারে। শুধু তাই নয়, এই ঢালের আড়ালে মিটার খানেক এগোলেই তাপমাত্রা কমে ২৯ ডিগ্রিতে নেমে যায়, মানে প্রায় আমাদের ঘরের তাপমাত্রা। ফলে পার্কার প্রোবের কাজ করতেও কোনও সমস্যা হয় না। এমনকী প্রোবের বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যে সোলার প্যানেল দু'টি ব্যবহার করা হয়েছে তাদের শীতল রাখার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির কুলিং সিস্টেম, যাতে তাদের তাপমাত্রা কখনও ১৬০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে না যায়।

আরও পড়ুন- কয়লা খনিজ তেল বাড়ন্ত! কেন পৃথিবীতে এক টুকরো সূর্য সৃষ্টি করতে চাইছেন বিজ্ঞানীরা

এই অভিযানে সাফল্যের প্রথম বাধা ছিল সূর্যের প্রচণ্ড মহাকর্ষ। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আকাশের দিকে ছোটার সময়, যাত্রাপথের শেষ দিকে বেগ যদি ঠিকমতো কমিয়ে না ফেলা যায়, তাহলে সূর্যের অভিকর্ষজ বলের টানে মহাকাশযানটি শেষ পর্যন্ত সূর্যের অভ্যন্তরেই ঝাঁপ দেবে। সেজন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন বৃহস্পতির অভিকর্ষের সাহায্য নেবেন। কিন্তু সেপথে বহু হ্যাপা! বারবার সূর্য থেকে বৃহস্পতি যাও, আবার এসো। সে সময় আরেক প্রযুক্তিবিদ প্রস্তাব দিলেন, বৃহস্পতির পরিবর্তে পৃথিবী ও শুক্রর যৌথ অভিকর্ষ বলকে কাজে লাগানোর জন্য। সেইমতো নতুন করে কক্ষপথের হিসাবনিকাশ শুরু করে দিলেন নাসার বিজ্ঞানীরা। বেশ ক'জন দিকপালের গণনা পাশ কাটিয়ে অবশেষে গৃহীত হলো ইয়ানপিং গুয়ো নামক এক বিজ্ঞানীর প্রস্তাব।

তিনি বললেন, সোলার প্রোবটি সূর্যের নিরক্ষবলয়ের কাছ বরাবর ২৪বার উড়ে যেতে যেতে ২০০০ ঘণ্টার বেশি সময় কাটাবে সূর্যের করোনা অঞ্চলের মধ্যে, আর প্রতিবার পরিভ্রমণের সঙ্গে সেটি ক্রমশ সূর্যের আরও কাছে পৌঁছতে থাকবে। সৌরযানের এই বিশেষভাবে ওড়াকে মহাকাশ বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘ফ্লাই-বাই’, যেটি নাসার এই সৌরাভিযানকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। পার্কার সোলার প্রোবের ভিতরে মোট চারটি উল্লেখযোগ্য যন্ত্র রয়েছে। ‘ফিল্ডস এক্সপেরিমেন্টস (FIELDS)’, ইন্টিগ্রেটেড সায়েন্স ইনভেস্টিগেশন অফ দ্য সান (IS☉IS), ওয়াইড-ফিল্ড ইমেজার (WISPR) এবং সোলার উইন্ড ইলেকট্রনস আলফ্যাস অ্যান্ড প্রোটনস (SWEAP)। এদের মধ্যে FIELDS দিয়ে সূর্যের বায়ুমণ্ডলের তড়িৎক্ষেত্র ও চুম্বকক্ষেত্র পরিমাপ করা হয়। অপরদিকে IS☉IS এর কাজ হলো সৌরঝড়ের জন্য দায়ী উচ্চশক্তি সম্পন্ন ইলেকট্রন, প্রোটন ও বিভিন্ন আধান পর্যবেক্ষণ করা। আর WISPR হলো একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ, যেটি করোনা অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় ছবি তোলে। সৌরঝড়ে থাকা ইলেকট্রন, প্রোটন ও হিলিয়াম আয়নের বিভিন্ন ধর্ম, যেমন বেগ, ঘনত্ব প্রভৃতি পরিমাপ করে SWEAP। এছাড়া হিটশিল্ডের ছায়ার বাইরে ছিল চারটে অ্যান্টেনা ও ‘সোলার প্রোব কাপ’, যেটিকে ‘ফ্যারাডে কাপ’-ও বলে। সৌরবায়ুতে থাকা আয়ন ও ইলেকট্রন কণিকার ঘনত্ব মাপে ওই ‘কাপ’। সূর্যের দিকে থাকার ফলে তার গায়ে এসে পড়ে সৌরবায়ুর ঝাপ্টা। সেই ঝাপ্টা সামলাতে মলিবডেনামের সংকর টাইটানিয়াম-জারকোনিয়াম-মলিবডেনাম দিয়ে বানানো হয়েছে ‘হিট শিল্ড’, যার গলনাঙ্ক ২৩৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কী কী জানা গেল এই মিশন থেকে? বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে ‘কসমিক ডাস্ট’ বা ‘মহাজাগতিক ধূলিকণা’। এই প্রথম দেখা গেল, সূর্যের কাছাকাছি এমন জায়গাও রয়েছে, যেখানে টিঁকে থাকার সাহস পায় না মহাজাগতিক ধূলিকণারাও। সূর্যের তাপে জ্বলে, পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যায় তারা। অর্থাৎ ‘ডাস্ট-ফ্রি জোনের’ সন্ধান পেলেন বিজ্ঞানীরা। এর আগে ধারণা ছিল, সৌরবায়ু একমুখী, অর্থাৎ সূর্য থেকে বেরিয়ে সৌরমণ্ডলের বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু পার্কার সোলার প্রোবই প্রথম দেখাল, সৌরবায়ু উল্টোমুখীও হয়। বিজ্ঞানীরা এটাকে বলছেন ‘সুইচব্যাক’। এছাড়া সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হচ্ছে, সূর্যপৃষ্ঠের চেয়ে করোনা অঞ্চল সূর্যের কেন্দ্র থেকে এত দূরে অবস্থান করলেও তাপমাত্রা কেন মিলিয়নের ঘরে? সেজন্যে আমাদের তাকিয়ে থাকতে হবে সৌর পদার্থবিদদের দিকে— পার্কার সোলার প্রোব থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে তাঁরা কত তাড়াতাড়ি আমাদের কৌতূহল মেটান!

More Articles