দেবাংশু না অভিজিৎ, তমলুকে ভোটের লড়াইয়ে এগিয়ে কে?
Lok Sabha Election 2024: তদূর শোনা যাচ্ছে, তমলুক থেকেই আসন্ন নির্বাচনে দাঁড়াতে চলেছেন অভিজিৎ। যেখানে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ হতে চলেছেন তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য। সেখানে কি হতে চলেছে 'কাঁটো কা টক্কর'?
ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে ঘোষণা হয়ে যেতে পারে ভোটের দিনক্ষণ। আর এবার এ রাজ্যের ভোটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র সম্ভবত তমলুক। হবে না-ই বা কেন? একে তো দীর্ঘদিন ধরেই তমলুক অধিকারী পরিবারের গড়। কিন্তু গত বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই হিসেব নিকেশ সব গড়বড় হয়ে গিয়েছে। বহু বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে চলে গিয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী। শুধু গিয়েছেন তাই নয়, গত বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রামে খোদ মমতাকে হারিয়ে বঙ্গবিজেপির তিনি হয়ে উঠেছেন প্রায় সর্বেসর্বা। শুভেন্দুর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী অবশ্য এখনও তৃণমূলে, যিনি কিনা তমলুকের সাংসদ। তবে দলে থেকেও তৃণমূলে ইদানীং আর বিশেষ আস্থা রাখতে পারছে না অধিকারী পরিবার। এ বছর তৃণমূলের প্রার্থীতালিকা ছিল বেশ খানিকটা অপ্রত্যাশিত। তারকাপ্রার্থী থেকে শুরু করে বহু চেনা মুখই এবার টিকিট পাননি লোকসভা ভোটে। সেখানে দিব্যেন্দুকে যে দল নতুন করে ভোটে দাঁড় করাতে চাইবে না, তা এক রকম ভাবে প্রত্যাশিতই ছিল। হয়েওছে তেমনটাই। এবার তমলুক থেকে তৃণমূল দাঁড় করিয়েছে দেবাংশু ভট্টাচার্যকে।
তারুণ্যের প্রতীক দেবাংশু অনেক দিনের দলীয় কর্মী। তিনি আবার সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের আইটি সেলের ইনচার্জও। মুখে কথার খই ফোটে। সংবাদমাধ্যমের পরিচিত মুখ দেবাংশু স্বাভাবিক ভাবেই সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ জনপ্রিয়। গোড়া থেকেই দলের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছেন তিনি। এখনও আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা না হলেও, মোটামুটি যা শোনা যাচ্ছে, তাতে তমলুকে বিজেপি প্রার্থী করতে চলেছে প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কেই। ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগে সবচেয়ে বড় চমক ছিল বোধহয় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিজেপিতে যোগদান। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় প্রতারিত, বঞ্চিতদের 'মসিহা' হয়ে উঠেছিলেন তিনি কার্যত। সততার প্রতীক সেই অভিজিৎবাবু ভোট আসতে না আসতেই বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ঢুকে পড়লেন সংসদীয় রাজনীতিতে। যতদূর শোনা যাচ্ছে, তমলুক থেকেই আসন্ন নির্বাচনে দাঁড়াতে চলেছেন অভিজিৎ। যেখানে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ হতে চলেছেন তৃণমূলের দেবাংশু ভট্টাচার্য। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একটি অংশের দাবি, ২০২৪ লোকসভা ভোটে কার্যত কাঁটে কা টক্কর হতে চলেছে তমলুকে।
আরও পড়ুন: ভোটের ঠিক আগেই কেন CAA? কোন চাল বিজেপির?
দীর্ঘদিন ধরেই তমলুকে দাপট চলছে অধিকারী পরিবারের। ২০১৪ সাল থেকেই তমলুক কেন্দ্র দখলে রেখেছে অধিকারী পরিবার। ২০১৯ অর্থাৎ শেষ লোকসভা ভোটে সেখানে বাম, কংগ্রেস এবং বিজেপিকে পিছনে ফেলে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটই নিজের দখলে রেখেছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। সে বছর বিজেপির প্রার্থী সিদ্ধার্থশঙ্কর নস্কর পেয়েছিলেন মাত্র ৩৭ শতাংশ ভোট। এবার সেই শুভেন্দুই বিজেপিতে। ২০২১ বিধানসভা ভোটেও তমলুক ক্ষমতায় রেখেছিল তৃণমূলই। জয়ী হয়েছিলেন তৃণমূলপ্রার্থী সৌমেন কুমার মহাপাত্র। যদিও ওই বছর নন্দীগ্রামে খোদ তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হারিয়ে দিয়েছিলেন বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু। মঙ্গলবার অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে নন্দীগ্রাম ঘোরাতে নিয়ে গিয়েছেন শুভেন্দু। সেখানে অধিকারী পরিবারের ব্যাপক জনপ্রিয়তাই বলে দেয়, ২০১৯ ভোটে তৃণমূল নয়, জিতেছিলেন আসলে শুভেন্দু। ফলে শুভেন্দুর সমর্থন যার সঙ্গে রয়েছে, তমলুকে যে তাঁর ঝুলিতে কিছু বাড়তি নম্বর রয়েইছে, তা আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার হয় না।
এদিকে কম যান না তৃণমূলের তরুণ নেতা দেবাংশুও। দীর্ঘদিন ধরেই তৃণমূলের অতিপরিচিত মুখ তিনি। টিভি খুললেই, সংবাদমাধ্যমের অজস্র টকশোতে দেখা যায় তাঁকে। কথাটা তিনি ভালোই গুছিয়ে বলতে পারেন, তা অ্যাদ্দিনে রাজ্যবাসীর জানা। টিকিট পাওয়ার পর দেবাংশু নিজেই বলেছেন, বয়সে অভিজিৎ বড় হলে কী হবে, রাজনীতির ময়দানে তিনি নাতি অভিজিতের চেয়ে অনেকটাই প্রবীণ (সিনিয়র)। তা সে কথা কিন্তু নেহাৎ বেঠিক বলেননি দেবাংশু। ২০১৬ সালে প্রথম নোটবন্দি নিয়ে ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নজর কাড়েন দেবাংশু। এর পরে ২০১৮ সালে তাঁকে একটি জনসভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়, ভাষণ দেওয়ার জন্য। তারপর ২০১৯ সালে আনুষ্ঠানিক ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন দেবাংশু। এর পরেই তড়তড়িয়ে বিভিন্ন পদে অভিষিক্ত হতে শুরু করেন তরুণ এই নেতা। প্রথমে এআইটিসি-র মুখপাত্র, পরে যুব তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। তৃণমূলের বিখ্যাত 'খেলা হবে' স্লোগানের নেপথ্যেও কিন্তু ছিলেন এই দেবাংশুই। বাংলা সংবাদমাধ্যমের বাস্তুতন্ত্রের বাস্তুঘুঘু বললেও কম বলা হয় দেবাংশুকে। প্রায় সব ক'টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেই দুর্দান্ত বন্ধুত্বের সম্পর্ক দেবাংশুর। সেদিক থেকে দেখতে গেলে মিডিয়ার সমর্থনের অনেকটাই কিন্তু রয়েছে দেবাংশুর দিকে।
অন্যদিকে, বিচারপতি হিসেবে ইস্তফা দেওয়ার পরে পরেই সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছিলেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানে দক্ষতার সঙ্গেই সংবাদমাধ্যমকর্মীদের একের পর এক প্রশ্নের মোকাবিলা করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তবে পেশায় যতই তিনি আইনজীবী বা বিচারপতি হোক না কেন, দেবাংশুর মতো তরুণ নেতার কথাবার্তার সঙ্গে টেক্কা দিতে পারবেন তো অভিজিৎ? নাকি দেবাংশুর কথার প্রতিক্রিয়া দিতে দিতেই কেটে যাবে তাঁর গোটা লোকসভা ভোট। তবে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নিজেকে সততার মুখ হিসেবে তুলে ধরেছেন এতদিন ধরে। তার উপর মেদিনীপুরে চাকরি বঞ্চিতদের কাছেও বেশ জনপ্রিয় মুখ হয়ে উঠেছেন তিনি অ্যাদ্দিনে। তার কিছুটা সুফল ভোটবাক্সে আসবে বলেই মনে করছে অভিজ্ঞমহল।
তমলুকের মাটিতে লড়তে চলেছেন প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। খোদ শুভেন্দুর গড় তমলুক। আর ২০২৪ ভোটের আগে তাই অভিজিৎবাবুকে সব দিক থেকে গাইড করছেন শুভেন্দুরাই। মঙ্গলবার হাত ধরে নন্দীগ্রাম সফরে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে রাজনৈতির পরামর্শ, সব কিছুই পাচ্ছেন প্রাক্তন বিচারপতি। নন্দীগ্রাম যাওয়ার আগেই তমলুকে তাঁকে ঘুরিয়ে আনেন শুভেন্দু। তমলুকে পৌঁছনোর পর অভিজিৎকে ঘিরে বিজেপি কর্মী, সমর্থকদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিকে বিরোধীস্বরও যে রয়েছে পুরোমাত্রায়, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে তমলুক জুড়ে পড়া অভিজিৎ-বিরোধী পোস্টারেই। ‘লোভী’ বলে তোপ দাগা হয়েছে অভিজিতকে সেখানে। যদিও এ ব্যাপারে অভিজিতের বক্তব্য, “কেউ কেউ বিরোধিতা করবেন। তাঁদের বিরোধিতা করতে দিন। তবে সারা বাংলায় এটা ছড়িয়ে দিতে হবে যে, তৃণমূলকে একটিও ভোট নয়।” অভিজিত আরও বলেন, “লোকসভা নির্বাচনে দেশের সরকার প্রতিষ্ঠা হবে। তবে এরই পাশাপাশি এই রাজ্য থেকে তৃণমূলকে পুরোপুরি উৎখাত করতে হবে। তার জন্য আমাদের এখন থেকেই জোটবদ্ধ হতে হবে।” এলাকার জমি চেনাতেই সম্ভাব্য কেন্দ্রে অভিজিতের এই সফর বলে মনে করা হচ্ছে। যেখানে তার ফ্রেন্ড-ফিলোজফার এবং গাইড অবশ্যই সেখানকার ভূমিপুত্র শুভেন্দু অধিকারী।
তবে শুভেন্দু যতই চেষ্টা করুন না কেন, তমলুক কিন্তু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পীঠ। মাতঙ্গিনী হাজরার মতো সংগ্রামীর রক্ত লেগে রয়েছে সেই মাটিতে। ফলে তমলুকের মানুষ যথেষ্ট রাজনীতি-সচেতন। তার জন্য অবশ্য দায়ী খানিকটা সেখানকার ভূমির ইতিহাস। দেখা গিয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সময়েও সেই সচেতনতাবোধ কাজ করেই। তাদের ঘরবাড়ি, জীবনযাপনেই মেলে তার ছাপ। সেদিক থেকে দেখতে গেলে তৃণমূলের তরুণ মুখ দেবাংশুর থেকে একটু বেশি নম্বর যেন পেয়ে বসে রয়েছে অভিজিৎ। প্রাক্তন বিচারপতি শিক্ষিত, ভদ্র, বিবেকবান। সেখানে দেবাংশু কি একটু বেমানান? তবে এরই মধ্যে বেশ কিছু আলটপকা মন্তব্য করে নেগেটিভ পয়েন্ট ঝুলিতে পুরেছেন প্রাক্তন বিচারপতি তথা বিজেপি নেতা অভিজিৎও।
আরও পড়ুন: তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা: বিজেপিকে সুবিধা করে দিতেই দুর্বল প্রার্থী?
বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে পরেই একটি সাক্ষাৎকারে অভিজিৎকে প্রশ্ন করা হয়েছিল গান্ধি না গডসে? তার উত্তরে অভিজিৎ জানিয়েছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর তিনি এখনই দিতে পারবেন না, কারণ তাঁকে ভাবতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল তাঁর সেই জবাব। ব্যাপারটা নিয়ে বেশ হইচই পড়ে যায়। গান্ধিকে গুলি করেছিল যেই গডসে, সেই গডসেকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য কেন দু'বার ভাবতে হয়েছিল অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে, সে নিয়ে বেশ বিতর্ক বেঁধে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রশ্ন উঠেছে, এই ধরনের ভাবনার পৃষ্ঠপোষক যিনি, তাঁকে গিয়ে তমলুক মেনে নেবেন নিজেদের নেতা হিসেবে। গান্ধীর ডাকে 'ভারত ছাড়ো আন্দোলনে' সাড়া দিয়ে শহিদ হয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। তমলুকের ভূমিকন্যা তিনি। সেই জায়গা থেকে অভিজিৎকে কি মেনে নেবেন তমলুকবাসী। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।