চার বছরের শিশুর গলায় ছিল গতজন্মের গুলির ক্ষত! সত্যিকারের জাতিস্মরদের শিহরণ জাগানো গল্প

জাতিস্মরের অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? বিশ্বাস-অবিশ্বাসে মোড়া এই প্রশ্নের উত্তর।

শাহরুখ-সলমন অভিনীত বলিউডের সেই বিখ্যাত 'করণ অর্জুন' সিনেমার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। যেখানে দুই ভাইকে হত্যা করা হলেও তারা পুনরায় জন্ম নিয়ে তাদের হত্যাকারীকে শাস্তি দিয়েছিল। আবার সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাকাহিনি 'সোনার কেল্লা' আর তা অবলম্বনে সিনেমা, যেখানে এক মধ্যবিত্ত বাড়ির ছোট্ট ছেলে মুকুল একদিন বলেই ফেলল তার বাড়ি রাজস্থানের জয়সলমেরের সোনার কেল্লায়। আবার ২০১৪ সালে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবি 'জাতিস্মর', যেখানে একজন লাইব্রেরিয়ান তার আগের জন্মের কথা মনে করতে পারে। সে নাকি তার আগের জন্মে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিল।

এই জাতিস্মর, পুনর্জন্ম নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। কিন্তু এই কৌতূহল কিন্তু এমনি এমনি আসেনি। এসেছে কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা থেকে, আর সঙ্গে এনেছে কিছু প্রশ্ন।

কারা এই জাতিস্মর? এই পুনর্জন্ম কি আদৌ সত্যি? মৃত্যু মানেই কি জীবনের শেষ? মৃত্যুর সত্যি আসলে কী? এই নিয়ে নানা গবেষণা চলেছে, হয়েছে নানা ব্যাখ্যাও, কিন্তু আসল সত্যি কেউ জানে না। আবার অনেকে বলেন, একজন মানুষ কতবার এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়? ইসলাম বা খ্রিস্টধর্মে পুনর্জন্ম এবং জাতিস্মর না মানলেও আমাদের এই হিন্দু ধর্মে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী, আমরা প্রতিটি মানুষ জন্মান্তরের শিকলে বন্দি। মানুষ তার কাজ অনুযায়ী ফল লাভ করে। মানুষের জন্মান্তরের কথা স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ বলে গেছে। প্রচলিত আছে, গৌতম বুদ্ধও নাকি তাঁর আগের জন্মের কথা বলতে পারতেন।

আরও পড়ুন: ভ্রাতৃহত্যা আটকেছিলেন মহামায়া স্বয়ং, কোচবিহার রাজবাড়িতে আজও কিংবদন্তির হাতছানি

জাতিস্মর কী? জাতিস্মর সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যাদের পূর্বজন্মের কথা মনে রাখার ক্ষমতা আছে। পৃথিবীর অনেক জায়গায় এমন কিছু শিশু আছে, যারা তাদের আগের জন্মের কথা বা বলতে গেলে পূর্বজন্মর ২০% তথ্য নিখুঁত ভাবে বলতে পারে। এদের বয়স প্রধানত ২-৭ বছরের মধ্যে হয়। এবার কিছু ঘটনার সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক, যেখানে পুনর্জন্মের ঘটনা আবিশ্ব তোলপাড় করেছিল।

শান্তির পুনর্জন্ম
ভারতের প্রথম পুনর্জন্মর ঘটনা ঘটে দিল্লিতে। সারা পৃথিবীতে এটিই এমন একটি ঘটনা, যা সকলে মেনে নিয়েছেন এককথায় এমনকি মহাত্মা গান্ধী নিজেও এই ঘটনাকে মান্যতা দিয়েছিলেন। গল্পের শুরু ১৯০২ সালে মথুরায়। লুকদি নামে এক শিশুকন্যার জন্ম হয় মথুরায়। ধীরে ধীরে লুকদি বড় হয়ে ১০ বছর হলেই তাকে এক কাপড় ব্যাবসায়ীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ২৩ বছর বয়সে দ্বিতীয় সন্তান জন্মের ৯ দিন পর লুকদি মারা যায়। এর ঠিক ১ বছর ১০ মাস ৭ দিনের মাথায় ১৯২৬ সালে দিল্লিতে মাথুর নামে জনৈক ব‍্যক্তির বাড়িতে এক শিশুকন্যার জন্ম হয়। বাড়িতে সকলেই খুশি। কিন্তু দেখা গেল শিশু কন্যাটি কোনও একটা কারণে ৪ বছর পর্যন্ত পুরো চুপচাপ থাকত। কিন্তু ৪ বছর পার করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখে বুলির ফোয়ারা। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যায় তার কথায় মথুরার ভাষার টান। প্রথমে সকলে ভয় পেলেও পরে শান্তির মুখ থেকে সব শুনে, চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেইভাবে কাজ করেছিলেন। আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এই ঘটনা। গান্ধীজির কাছে খবর গেলে তিনি নিজে শান্তির সঙ্গে দেখা করে যান।

গুলি খেয়েছিল অস্ট্রিয়ান
এরপরের ঘটনা এডওয়ার্ড অস্ট্রিয়ানের। ৪ বছরের এই খুদের ভয় ছিল মেঘলা দিন নিয়ে। অন্ধকার ভয় পেত সে। আর প্রায়ই তার গলায় অদ্ভুত সমস্যা হয়। গলায় প্রচণ্ড ব্যথা হয়, আর সে বলে তার গলায় নাকি গুলি আটকে আছে। তারপর তার টনসিল অপারেশন করানো হয়। তার মাকে সে প্রায়ই বলত, সে নাকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একজন সৈনিক হিসেবে কাজ করেছিল। তাকে গলায় গুলি করে মেরে ফেলা হয়। সে এই ঘটনার এত নিখুঁত বিবরণ দিত, যে অবিশ্বাস করার উপায় নেই। এদিকে, টনসিল অপারেশন করার সময় ডাক্তার সত্যি সত্যি তার গলায় একটা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা কীভাবে এল, তার কোনও ব্যাখ্যা নেই।

সীমান্তরক্ষী হিউম
ইংল্যান্ডের বার্মিংহামের বাসিন্দা পিটার হিউম একদিন স্বপ্ন দেখেন, তিনি পৌঁছে গেছেন ১৬৪৯ সালে এবং তিনি একজন স্কটিশ সীমান্তরক্ষীর দায়িত্ব পালন করছেন। স্বপ্নের এই সূত্র ধরে সাইকিয়াট্রিস্ট দ্বারা তাঁকে সম্মোহন করা হলে তিনি তাঁর পূর্বজন্মর সব কথা বলতে সক্ষম হন। কোথায় তাঁর বিয়ে হয়েছিল, তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে তিনি কোথায় কোথায় যেতেন সব কিছু।

পরমানন্দ থেকে প্রমোদ শর্মা
প্রমোদ শর্মা ১৯৪৪ সালে ভারতে জন্ম নেন। যখন তাঁর ২ বছর বয়স তখন থেকেই সে তার মাকে বলত, ‘মা তোমাকে রান্না করতে হবে না। তোমার বউ রান্না করছে।' সে আরও বলত যে, তার স্ত্রী নাকি মোরাদাবাদে থাকে। সেখানে মোহন ব্রাদার্স বলে একটি দোকান আছে, যেখানে জল আর বিস্কুট পাওয়া যায়, যা শুরু করার পর থেকে খুব লাভজনক ব্যবসা ছিল। সে দই খেত না, কারণ সে নাকি আগের জন্মে দই খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ত। আর স্নানও করত না, কারণ বাথ টবেই নাকি তার মৃত্যু হয়। এইসব শোনার পর প্রমোদের মা-বাবা তাকে মোরাদাবাদ নিয়ে গেলে সব সত্যি সামনে এসে উপস্থিত হয়।

তাহলে জাতিস্মরের অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? পরিষ্কার উত্তর, না। বিজ্ঞান একে মান্যতা দেয় না। বিজ্ঞানের ভাষায়, যেখানে আত্মার নিজের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই, সেখানে পুনর্জন্ম বিষয়টি সোনার পাথরবাটির মতো অবাস্তব। আর যদি বাস্তবে সত্যি জাতিস্মর বলে কিছু থাকত, তাহলেও তার স্মৃতি মনে রাখা অসম্ভব। যেখানে আমরা এক সপ্তাহ আগে কী ঘটেছে তাই মনে করতে গিয়ে হা-হুতাশ করি, সেখানে পূর্বজন্ম তো দূর অস্ত। আমাদের স্মৃতি সঞ্চিত থাকে মস্তিষ্কের কোশে, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তারও কোনও অস্ত্বিত্ব থাকে না। তাই জাতিস্মর বা পুনর্জন্ম মানুষেরই এক মানসিক ধারণা বলা যেতে পারে।

 

More Articles