প্রকাশ্যে নজিরবিহীন দ্বন্দ্ব! ট্রাম্প-জেলেনস্কির তর্কে এবার ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী?

Trump-Zelensky Clash: তর্কাতর্কির জেরেই ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই রাষ্ট্রনেতার চুক্তি সম্ভব হলো না।

দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে সাক্ষাৎ, বৈঠক নতুন ঘটনা নয়। তবে সব সাক্ষাতই যে সৌজন্যের নয় তা সদ্য প্রমাণ হয়ে গিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সামনাসামনি আলোচনায়। দুই দেশের দুই নেতার সাক্ষাতে গণমাধ্যমের সামনেই যে এমন নজিরবিহীন বাগবিতণ্ডার ঘটতে পারে, কল্পনাতীত ছিল তা। এই চরম উত্তেজনাপূর্ণ তর্কাতর্কির পর, ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে আবারও প্রশ্ন উঠছে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী? উল্লেখ্য, ট্রাম্পের সঙ্গে এই তর্কাতর্কির পর ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ নিয়ে আমেরিকার সঙ্গে যে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল তা বাতিল হয়ে যায়।

বিষয়টি আর শুধু ইউক্রেন আমেরিকার তর্কে থেমে নেই। ন্যাটোর ইওরোপিয় সদস্যদের সঙ্গে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বড় সঙ্কট দেখা দিতে পারে এর পরে। কারণ এই বাগবিতণ্ডার পরে স্বাভাবিকভাবেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাইবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হোক।

ইউক্রেনের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ভ্লাদিমির ফেসেঙ্ক বলছেন, "ইউক্রেনকে নিয়ে মার্কিন মনোভাব কী হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে ভালো কিছু হবে সেমন কিছু ধারণা করাও ঠিক হবে না। শোনা যাচ্ছে ট্রাম্পের সঙ্গে জেলেনস্কির বাকবিতণ্ডার পর মার্কিন প্রশাসন হয়তো ইউক্রেনকে সামরিক সহযোগিতা কমিয়ে দিতে পারে"। অর্থাৎ রাশিয়াকে ঠেকাতে এবার কিছুটা দুর্বল হবে ইউক্রেন। রাশিয়া যদি আমেরিকাকে পাশে পায় তাহলে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সুখবই কিছু ভাবাই দুষ্কর। আর আমেরিকা এবং ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কে ভাঙনের দিকে যত এগোবে ন্যাটোর সদস্য দেশগুলোর সঙ্গেও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বড় সঙ্কট তৈরি হতে পারে।

আরও পড়ুন-ঝাঁ চকচকে হবে ধ্বংসস্তূপ! গাজাকে নিয়ে যা পরিকল্পনা ডোনাল্ড ট্রাম্পের

ন্যাটোর সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক কেন সংকটে?

ন্যাটো বা নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন আসলে একটি সামরিক জোট। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জোটের সদস্য সংখ্যা বর্তমানে ৩২টি। জো বাইডেনের শাসনপর্বে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেনকে গত তিন বছর ধরে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিয়ে এসেছে আমেরিকা। অর্থাৎ এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পাশেই থেকেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের জয়ের পর, জেলেনস্কির সঙ্গে এই বাগবিতণ্ডার পরেই পরিষ্কার হয়ে গেছে, ট্রাম্প আসলে কী চাইছেন। একটি তর্কাতর্কির জেরেই ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই রাষ্ট্রনেতার চুক্তি সম্ভব হলো না।

ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভলোদিমির জেলেনস্কির সম্পর্ক আগেও সুখের ছিল না। আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে 'স্বৈরশাসক' বলেছেন। বলেছেন, একটি মিথ্যার ওপর ভিত্তি করে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করেছে ইউক্রেন। অর্থাৎ ট্রাম্প তাঁর পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট করেছেন আগেই। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে ওয়াশিংটন-কিয়েভ সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলন, তা শুক্রবারের ঘটনায় ভেঙে পড়েছে। ইউক্রেনের বাইরে ইওরোপের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। ট্রাম্প ১৯৪৯ সালে প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন আদৌ? ওই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, ন্যাটোর কোনও সদস্য রাষ্ট্রের ওপর হামলা হলে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর হামলা হিসেবে গণ্য হবে। ন্যাটোর প্রতিষ্ঠাতাকালীন চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোনও সদস্য রাষ্ট্রের উপর আক্রমণ করা হয়, তবে তা সামগ্রিক জোটের ওপর আক্রমণ হিসেবে গণ্য হবে এবং অন্য সদস্য দেশগুলো সেই রাষ্ট্রের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে ইউক্রেনের উপর বড় ধরনের চাপ বাড়াচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে ইউক্রেনের নিরাপত্তা এখন অনেকটা নিচে নেমে গেছে। এই তর্কের পরে ইওরোপিয় দেশগুলোও তাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। আসলে বিষয়টা শুধু খনিজসম্পদ বিষয়ক চুক্তি সই না হওয়াতে আটকে নেই। ইউক্রেন যদি পুতিনকে প্রতিহত না করতে পারে তাহলে তাঁদের জাতীয় অস্তিত্বই বিপন্ন। পুতিনকে ঠেকাতে জেলেনস্কি বারবার মার্কিন নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন।

আরও পড়ুন-ট্রাম্পের পরিবারই ‘অনুপ্রবেশকারী’! কেন অভিবাসীদের নিয়ে কড়া আমেরিকা?

এই দ্বন্দ্বের পরে কি আমেরিকা আর ইউক্রেনকে অস্ত্র সাহায্য করবে না?

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া যখন ইউক্রেনে হামলা করে, তারপর যুদ্ধসাহায্য হিসেবে ইউক্রেনকে আমেরিকার লক্ষ কোটি ডলারের সাহায্য পাঠানোর ঘোর বিরোধী ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।ট্রাম্প নিজের নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলেই দ্রুত রশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটাবেন।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসেন তিনি। এরপর ১২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন ট্রাম্প। যুদ্ধালোচনায় ইউক্রেনকে বাদ দেওয়া নিয়ে ইওরোপিয়ান দেশগুলি অবাকই হয়। এরপর থেকেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি এবং ওয়াশিংটনের ইওরোপিয় বন্ধুরা ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ট্রাম্পকে অনুরোধ করতে থাকেন। ট্রাম্প অবশ্য সেসবে কোনও আমল দেননি।

জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকের এক পর্যায়ে ট্রাম্প এবং তাঁর ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স অভিযোগ করেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকা ইউক্রেনকে এত সাহায্য করলেও জেলেনস্কি পর্যাপ্ত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেননি। এই দুই তরফে তীব্র বাগবিতণ্ডার পর জেলেনস্কি ও তাঁর প্রতিনিধি দলকে হোয়াইট হাউস থেকে চলে যেতে বলা হয়। উত্তেজনাপূর্ণ বৈঠকের পর এক্স-এ জেলেনস্কি লেখেন, "যুক্তরাষ্ট্র রুশ নেতার সঙ্গে আলোচনায় যেতে চায় তা বোঝাই যাচ্ছে।"

এখানে উল্লেখ্য, সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও পুতিন তাঁদের প্রতিনিধিদের সৌদি আরব ও ইস্তানবুলে আলোচনায় অংশ নিতে পাঠান। কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠন নিয়ে আলোচনা হলেও তাতে বাদ রাখা হয়েছিল ইউক্রেনকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই প্রকাশ্য বিরোধ পূর্বপরিকল্পিত রাজনৈতিক কৌশল। মেরিকার কৌশলই ছিল এমন এক পরিস্থিতি তৈরি করা যাতে হয় জেলেনস্কিকে আমেরিকার শর্ত মানতেই হবে, নচেৎ নতুন করে কোনও ঝামেলা হলে তার জন্য জেলেনস্কিকে দায়ী করা হবে। ইউক্রেনের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলছেন, স্পষ্টত এখন আমেরিকা রাশিয়ার সঙ্গে মিলে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

More Articles