ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধ! কীভাবে সংকট কাটাবে ভারত?

Trump : এর সঙ্গে মার্কিন কর্পোরেট লবির একটা অংশের স্বার্থ, অস্ত্র লবির চাপ তথা ভারতের কৃষি ও ডেয়ারি শিল্পকে মার্কিন কোম্পানিগুলির কাছে উন্মুক্ত করার দাবিও রয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের প্রভাব পড়বে ভারতীয় অর্থনীতিতে। প্রথমে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকৃত ভারতীয় পণ্যে ২৫% শুল্ক ও রাশিয়ার তেল কেনার দায়ে অনির্ধারিত জরিমানা এবং পরে সেটাকে বাড়িয়ে ৫০% করাটা শুধু অনৈতিক নয়, একই সঙ্গে এক নয়া সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। একথা প্রথমেই পরিষ্কার ভাবে বলে নেওয়া দরকার যে এটা কোনো মেগালোম্যানিয়াক রাষ্ট্রপ্রধানের ইচ্ছাপত্রের ফলাফল নয় বরং মার্কিন আধিপত্যের নীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। রাশিয়ার তেল একটা কারণ হলেও, তা একমাত্র কারণ নয়। এর সঙ্গে মার্কিন কর্পোরেট লবির একটা অংশের স্বার্থ, অস্ত্র লবির চাপ তথা ভারতের কৃষি ও ডেয়ারি শিল্পকে মার্কিন কোম্পানিগুলির কাছে উন্মুক্ত করার দাবিও রয়েছে।

সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের স্বার্থ রক্ষায় ব্যক্তিগতভাবে এই জরিমানার মূল্য চোকাবার কথা বলেছেন। এই কথা আসলে প্রধানমন্ত্রীর বহু অসত্য বচনের তালিকায় নতুন সংযোজন মাত্র। কারণ মূল্য চোকাবার বিষয়টি সোজাসুজি ভারতের অর্থনীতির ভালো-মন্দের সঙ্গে যুক্ত। একথা প্রধানমন্ত্রীর স্মরণে থাকা উচিত, একশো চল্লিশ কোটি মানুষের দেশ, কোনো রাষ্ট্রপ্রধানের পৈতৃক সম্পত্তি নয়। একই সঙ্গে একথা আরেকবার মনে করা প্রয়োজন- বর্তমান সরকার নির্বোধ পররাষ্ট্রনীতি, 'আব কি বার, ট্রাম্প সরকারের' মতো অবিবেক শ্লোগান, চিনকে বেকায়দায় ফেলার আকাঙ্খায় মার্কিন স্বার্থের ক্রীড়নক হয়ে ওঠা এবং অবশ্যই বচনবাগীশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সময় কূটনৈতিক বিশ্বে ভারতের ক্রমেই নির্বান্ধব হয়ে ওঠা মিডিয়া কল্পিত 'বিশ্বগুরু'র অবস্থাকে জটিল করে তুলেছে। এক সার্বভৌম দেশকে ট্রাম্প সকাল-বিকেল যেভাবে চমকাচ্ছে, তার তুলনা বিগত পঁচাত্তর বছরে বিরল। এই নিবন্ধ ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের প্রেক্ষাপট, অর্থনীতিতে তার সম্ভাব্য পরিণাম ও বিকল্প পথ কী হতে পারে সেই নিয়ে লেখা।

আমদানিকৃত পণ্যের উপর যে শুল্ক চাপানো হয় তাকেই বলে আমদানি শুল্ক (import duty)। যিনি আমদানি করছেন, তিনি সেই দেশের সরকারকে এই শুল্ক দেন। স্বাভাবিকভাবেই পণ্যের চূড়ান্ত দাম স্থির করার সময় শুল্কও পণ্যের বিক্রয় মূল্যে যুক্ত হয়। এক কথায় সেটা শেষপর্যন্ত মেটাতে হয় ক্রেতাকে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সরকার প্রথম নির্দেশিকায় ভারতীয় পণ্যের উপর ২৫% শুল্ক ও রাশিয়ার তেল ও সামরিক যন্ত্রাংশ কেনার জন্য  অনির্ধারিত পেনাল্টির কথা বলেছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে আমদানি শুল্ক বেড়ে হলো ৫০% কিন্তু এর উপর জরিমানা আলাদা করে লাগবে কি না, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। এটা আশ্চর্যের। কারণ, ভারত ও মার্কিন দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কথাবার্তা চলাকালীন এক তরফাভাবে এই শুল্ক ঘোষণা করা হলো। একটা উদাহরণ দিয়ে বলা যায় যে আগে ভারতীয় বস্ত্রের উপর শুল্ক ছিল ৬-৯%, ট্রাম্পের নতুন নিয়মে সেটা হয়ে দাঁড়াল ৫৬-৫৯%। জরিমানা চাপালে শুল্ক আরও বাড়বে। ফলত একজন মার্কিন ক্রেতা আগে যে দামে ভারতের জামা-কাপড় কিনত, এখন সেই একই জামা-কাপড় কিনতে অনেক বেশি ডলার খরচ করতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ হলো, নয়া দিল্লি মার্কিন পণ্যের উপর অনেক বেশি শুল্ক আরোপ করে (ট্রাম্পের ভাষায় ভারত হল 'টারিফ কিং')। এই উচ্চ শুল্কের কারণে মার্কিন পণ্য ভারতে বাজার পাচ্ছে না। আমরা যদি ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের দিকে নজর ফেরাই তাহলেই হিসাবটা পরিষ্কার হবে। ২০২১-২৫ সময় পর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য সাথী। ২০২৪-২৫ আর্থিক বর্ষে এই দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৮৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রফতানি ও ৪৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আমদানি)। অর্থনীতির ভাষায় ভারত মার্কিন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে 'ট্রেড সারপ্লাস', অর্থাৎ আমরা আমদানি করি কম, রফতানি করি বেশি। এই সারপ্লাসের পরিমাণ ৪১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০২৪-২৫), ৩৫.৩২  বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০২৩-২৪), ২৭.৭ বিলিয়ন  মার্কিন ডলার (২০২২-২৩)। পরিষেবা ক্ষেত্রে ভারত বাৎসরিক রফতানি করে ২৮.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং আমদানি করে ২৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

আরও পড়ুন- ট্রাম্পের ফোন আসেনি, মাথা নত করেছিল পাকিস্তানই, বলছেন এস জয়শঙ্কর

২০২৪ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যে সমস্ত পণ্য রফতানি করে তার মধ্যে রয়েছে ওষুধ (৮.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), টেলিকম যন্ত্রপাতি (৬.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), দামি রত্ন (৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), পেট্রোলিয়াম পণ্য (৪.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), মোটর গাড়ি ও তার যন্ত্রপাতি (২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), সোনা ও অন্যান্য ধাতুর গয়নাগাঁটি( ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), সুতির পোশাক (২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)  ও লৌহ -ইস্পাতের যন্ত্রপাতি (২.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। ভারতে আমদানি করে মূলত অপরিশোধিত তেল (৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট (৩.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), কয়লা (৩.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), হীরক (২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি (১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার), এয়ারক্রাফট ও তার যন্ত্রপাতি (১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

ভারত কি সত্যি মার্কিন পণ্যের উপর বেশি শুল্ক ধার্য করে? এটা সত্যি নয়। সব দেশই তাদের দেশীয় শিল্পকে বাঁচাতে কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক বেশি রাখে। মার্কিন দেশও তাই করে। মার্কিন দেশে ডেয়ারি প্রোডাক্ট (১৮৮%), ফল ও সবজি (১৩২%), কফি, কোকো ও মশলা (৫৩%), দানাশস্য(১৯৩%), তৈলবীজ ও ভোজ্য তেল (১৬৪%), তামাকজাত পণ্য (১৫০%), খনিজ ও ধাতু (১৮৭%) এবং কেমিক্যালস (৫৬%) উচ্চ আমদানি শুল্ক দ্বারা সুরক্ষিত।

৫০% শুল্কের বোঝা ভারতের অর্থনীতিতে কি ধরণের প্রভাব ফেলবে তা বুঝতে আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে একটা কথা সহজবোধ্য, যদি একই পণ্য একাধিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করে, সে ক্ষেত্রে যে দেশের পণ্যের উপর আমদানি শুল্কের হার বেশি, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এখানে ভারত অবশ্যই সমস্যায় পড়বে। তবে যেহেতু এই শুল্ক চাপানোটা এক চাপের কৌশল, তাই ভবিষ্যতে কূটনৈতিক সম্পর্কের ওঠা-নামার উপরে শুল্কের হারের পরিবর্তন ঘটবে। ভারতের সমস্যা হলো যেখানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভুক্ত দেশ, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পাকিস্তানের উপর শুল্কের হার মোটের উপর ১৫-২০%, সেখানে ভারতের উপর ৫০%।

গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (GTRI) এক মূল্যায়ণ পত্র প্রস্তুত করেছে যাতে বলা হয়েছে প্রথমে ক্ষতিগ্রস্ত হবে শ্রমনিবিড় ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর। এই রিপোর্ট মোতাবেক ভারতের বস্ত্র রফতানির ৪৪% মার্কিন দেশে রফতানি হয়। এই পোশাকের দাম গড়ে ৫০% বাড়লে ভারতের বাজার চলে যাবে বাংলাদেশ (২০%), ভিয়েতনাম (২০%) এবং কম্বোডিয়ার (১৯%) মতো দেশের কাছে। ভারতের কার্পেট শিল্পের ৫৮.৬% রফতানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। নতুন শুল্কের ফলে ভারত বাজার হারাবে তুরস্ক (১৫%), মিশর(১০%) ও কানাডার (০%) কাছে। ভারতের রত্ন ও পাথর ব্যবসার ৪০% হয় মার্কিন দেশে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতীয় রত্ন ব্যবসায়ীরা উচ্চ শুল্ক হার এড়াতে তাদের উৎপাদন কেন্দ্র আরব আমিরশাহী ও মেক্সিকোতে তুলে নিয়ে যেতে চাইছে। ভারতের চিংড়ি ও সি-ফুড ব্যবসার ৩২% ক্রেতা আমেরিকা। নতুন শুল্ক হারের ফলে ভারতের বাজার চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে- থাইল্যান্ড(১৯%), ভিয়েতনাম (২০%) এবং ইন্দোনেশিয়াতে (১৯%)। এখনও পর্যন্ত ফার্মাসিউটিক্যালস ও স্মার্টফোন নতুন শুল্কের তালিকার বাইরে আছে কিন্তু ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন এই দুটো ক্ষেত্রে নতুন শুল্ক লাগু হওয়া সময়ের অপেক্ষা।

ট্রাম্পের শুল্ক-তোপের অনিশ্চয়তায় পড়ছে ভারতের শেয়ার বাজার। করোনা পরবর্তী সময়ে টানা দীর্ঘতম সাপ্তাহিক পতন সেনসেক্স-নিফটিতে। একদিকে বিদেশি লগ্নি কারকদের বিনিয়োগ সরানোর গতিবৃদ্ধি, অন্যদিকে ইতিমধ্যে কমে যাওয়া জিডিপির হারে আরও কমার আশঙ্কা।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় সংস্করণ (জানুয়ারি, ২০২৫) কোনো সহসা পরিবর্তন আনেনি বরং বিশ্বায়ন, নয়াউদারবাদ ও দক্ষিণপন্থার নবতর উত্থানের আলোকে বিবেচনা করতে হবে। এক অর্থে ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদির আসীন হওয়া এবং ২০১৬ সালে প্রথমবার ট্রাম্পের মার্কিন রাষ্ট্রপতি হওয়াকে বিশ্বজুড়ে দক্ষিণপন্থার বিজয় হিসাবেই দেখা হত এবং ট্রাম্প ও মোদি আদর্শগত, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত পছন্দের ক্ষেত্রে প্রায় কাছাকাছি ছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে তাদের বন্ধুত্ব এবং তার ভিত্তিতে ভারত- মার্কিন সম্পর্কের এক ন্যারেটিভ তৈরি হয় ও গোদি মিডিয়ার সৌজন্যে তার ব্যাপক প্রচার সম্ভব হয়।

তবে এই সম্পর্কের গল্পটা যে মার্কিন পলিসির স্বার্থের কাছে ভঙ্গুর তার ইঙ্গিত মিলেছিল ২০১৯ সালে যখন মার্কিন দেশের 'Generalised System of Preferences' থেকে ভারতের নাম সরিয়ে দেওয়া হয়। সেবার ভারতের বানিজ্যে সেরকম কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং মাঝে মাঝে ট্রাম্পের মুখে বিশ্বনেতা হিসাবে মোদির প্রশংসা শোনা যেত। কিন্তু দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বিষয়টা অন্যরকম হতে শুরু করে। বিশেষ করে অপারেশন সিঁদুরের শেষপর্ব মোদির জন্য শুধু অস্বস্তি ও সমালোচনা বয়ে আনেনি, একই সঙ্গে এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে ট্রাম্পের কাছে সামরিক দৃষ্টিকোণে পাকিস্তান ভারতের চেয়ে বেশি মূল্যবান। অথচ মার্কিন বিদেশনীতি ২০১৭ সাল থেকে যেভাবে 'ইন্দো-প্যাসিফিক' শব্দটিকে জনপ্রিয় করছিল তাতে মনে করা হয়েছিল বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী গণপ্রজাতন্ত্রী চিনকে দুর্বল করতে ভারত, আমেরিকার সেরা অস্ত্র হতে চলেছে। এই সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত- জাপান-অস্ট্রেলিয়া' নিয়ে এক নতুন জোট রাজনীতির (QUAD) কথা শুরু হয়। ভারত তার হিসেব মতো চিনকে ঠেকাতে ও পৃথিবীর ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হয়ে ওঠার আকাঙ্খায় এবং আঞ্চলিক রাজনীতির দাবি মেনে মার্কিন ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির চেষ্টা করে। কিন্তু মার্কিন-পাক বন্ধুত্বর কারণে সেভাবে ভারত, মার্কিন দেশের সঙ্গে কোনো স্থায়ী সামরিক জোটে যায়নি। এইসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপান, ফিলিপিন্স ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে আরেকটি জোট বানায় যা SQUAD নামে পরিচিত। ইতিমধ্যে পাক মিলিটারির উদ্যোগে মার্কিন সরকারের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়ে ইমরান খানের অপসারণ পাক-মার্কিন সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেয়।

ট্রাম্পের দ্বিতীয় সংস্করণ চিনের বিরুদ্ধে ভারতকে ব্যবহারের পরিকল্পনা করলেও তার প্রধান লক্ষ্য ভারতকে এক অসম বাণিজ্য চুক্তিতে রাজী করানো ও অর্থনৈতিক শোষণের মাত্রা বৃদ্ধি করা। তাই বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে কথা চালু থাকা সত্ত্বেও এবং এ বছরের শুরুতে ভারতের দিক থেকে ডিজিটাল ট্যাক্সে ছাড়, নিউক্লিয়ার লায়েবেলিটি আইন, আরও বেশি তেল ও অস্ত্র কেনার প্রতিশ্রুতি এক তরফাভাবে দেওয়া হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

আমেরিকার প্রধান চাহিদা হলো ভর্তুকিপ্রাপ্ত মার্কিন কৃষি ও ডেয়ারি শিল্পের জন্য ভারতের বাজারকে উন্মুক্ত করা। ভারতের মতো দেশ যেখানে ৮৫% ক্ষুদ্র কৃষক, আট কোটি মানুষের জীবিকা আসে ডেয়ারি শিল্প থেকে এবং জিডিপির ৫% আসে ডেয়ারি শিল্প থেকে সেখানে সস্তা দানাশস্য, জিএম ক্রপস, ইথানল ও দুগ্ধজাত সামগ্রী নিয়ে মার্কিন কোম্পানিগুলো প্রবেশ করলে ভারতের এক বিশাল সংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা ধ্বংস হয়ে যাবে। একই সঙ্গে ট্রাম্পের লক্ষ্য ব্রিকস দেশগুলোকে আর্থিক ভাবে দুর্বল করা কারণ তারা বিশ্ব অর্থনীতিকে ডলারের প্রভাবমুক্ত (de-dollarise)  করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ট্রাম্পের 'রাশিয়া কার্ড' খেলার কারণ এটাই। এই মোডাস-অপারেন্ডি শুধু ভারতের ক্ষেত্রেই লাগু হচ্ছে না, এটাই আজ মার্কিন পলিসি। এজন্য সে নিজের তৈরি করা নানান প্রতিষ্ঠানকে ভাঙতে প্রস্তুত যাতে বিভিন্ন দেশের পিঠ দেওয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়। এটা অনিবার্য কারণ খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৭ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণজালে ডুবে আছে। এই পলিসির আনুষ্ঠানিক নাম 'Making America Great Again'। এই পলিসির মাধ্যমে ট্রাম্পরা চায় মার্কিন সামরিক খরচ, করছাড়, ঋণের ভার মেটানোর খরচ অসম বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে অন্যান্য দেশগুলো থেকে তুলতে। এই পলিসি ১৯২৯-৩০ সময় পর্বে মার্কিন রাষ্ট্রপতি হার্বাট হুভার প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন যা বিশ্ব বাণিজ্যে ধ্বংস ডেকে এনেছিল। সেই রিপাবলিকানদের উত্তরসূরী ট্রাম্প আজ সেই হুভার পরিকল্পনাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন।

আরও পড়ুন- পুতিন কাছে এলেন বলেই ট্রাম্প দূরে গেলেন?

এখন প্রশ্ন হলো ভারতের অর্থনীতি কীভাবে এই মার্কিন চাপ সামলাবে? এবং অতিরিক্ত মার্কিন নির্ভরতা কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে? প্রথম সমস্যাটা হলো গত দশ বছরে আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টর বা পণ্যের থেকে পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধি অনেক বেশি। আমরা যা রফতানি করি তার ৪৪% হলো পরিষেবা এবং বেশিটাই যায় মার্কিন দেশে। যদিও সরকারি তথ্য সুলভ নয় তবে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিবেদন থেকে মনে করা হয় যে আইটি ফার্মগুলোর আয়ের ৬০-৭০% আসে মার্কিন দেশ থেকে। এখন এটাই একমাত্র ক্ষেত্র যেটা এই নয়া উদারবাদী অর্থনীতিতে আমাদের আয় দেয়। এখানে বিপুল কর বা অন্য কোনো নিষেধাজ্ঞা আমাদের রফতানি বাণিজ্যের ভারসাম্যকে নষ্ট করে দিতে পারে। আবার সেবির হিসাব অনুযায়ী, আমাদের ফরেন পোর্টফোলিও ইনভেস্টরস দের ৩৯.২% আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এবং মার্কিন-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটলে সেখানেও প্রভাব পড়বে। এগুলো চিন্তার  বিষয় কারণ নয়া উদারবাদী জমানায় আমরা ধীরে ধীরে আমাদের অর্থনীতিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখাপেক্ষী করে তুলেছি। আরেকটি প্রচলিত ধারণা- যদি আমরা ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হয়ে উঠতে পারি তবে আমাদের প্রধান ক্রেতা হবে মার্কিনীরা। আরও মনে করা হয়, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের জন্য (এফডিআই) আমাদের প্রধান ভরসা। এটাও একটা ভুল ধারণা কারণ শেষ পাঁচ বছরে এফডিআই-এ আউটফ্লো বেশি করেছে চিন ও জাপান।

এখন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশি বিনিয়োগ ধারাবাহিক ভাবে কমছে। ২০২৩ সালে যা ছিল ৩৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা ২০২৪ সালে কমে হয়েছে ২৬৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর 'মাগা' প্রকল্পের লক্ষ্যই হল মার্কিন কোম্পানিগুলোকে নিজের দেশে বিনিয়োগের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্পের নিশানায় রয়েছে আরও অনেক দেশ। কিন্তু এর মধ্যে অনেকেই এই আগ্রাসনকে প্রতিহত করেছে। গণ প্রজাতন্ত্রী চিনের উদাহরণ বহু আলোচিত। আভ্যন্তরীন বাজার, গ্লোবাল সাপ্লাই চেনের একটা বড়ো অংশিদারী, সামরিক ক্ষমতা ও রেয়ার আর্থের সম্ভারকে বাজি রেখে জিনপিং ট্রাম্পের বহুঘোষিত ১৪৫% শুল্ক ঘোষণাকে কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছেন। দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নিও অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্থনি আলবানেস আমেরিকার চাপের কাছে মাথা নত না করার ফলে নিজের দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। এমনকি স্বৈরাচারী আয়োতোল্লা খোমেইনি সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় যেভাবে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইরানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা সেদেশে এক জাতীয়তাবাদী সমর্থনের জোয়ার তৈরি করেছে। ট্রাম্পের 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতি যায় সমস্ত বহুদেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবলুপ্তি। ভারতকে আজ সেই জোটের রাজনীতিতে ভরসা করতে হবে। এক্ষেত্রে রাশিয়া, চিন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলকে নিয়ে তৈরি ব্রিকসকে সচল করতে হবে।

একথা সবার জানা যে মোট অর্থনীতির নিরিখে জি সেভেন দেশগুলোর সঙ্গে ব্রিকসের পার্থক্য বেশি নয়। ভারতকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যে উদ্যোগী হতে হবে। কারণ সেখানে কিছুদিন আগে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে যার নাম রিজিওনাল কমপ্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ। একই সঙ্গে উদ্যোগী হতে হবে সার্ককে বাঁচিয়ে তোলার। আর মনে রাখতে হবে মার্কিন ক্রীড়নক হিসাবে নয়, আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজের স্বার্থ বিচার করে চিনের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। তবে সবার আগে দরকার আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে জনমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার। ১৪০ কোটি মানুষের দেশে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়লে, অর্থনীতির গতি বৃদ্ধি পায়, দেশও স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। আমাদের অর্থনীতি আদানি-আম্বানিদের স্বার্থরক্ষার বদলে জনগণের স্বার্থরক্ষায় গুরুত্ব দিলে মার্কিন নির্ভরতার ছবি পাল্টাতে পারে।

More Articles