শেয়ার বিনিয়োগে ভয়? এই তথ্য জেনে বিনিয়োগ করলে ঝুঁকি ছাড়াই লাখ টাকা আয়
লাগবে সঠিক পথ চিনে নেওয়া এবং সঠিক পরিকল্পনা। তবেই আপনি হয়ে উঠবেন কোটিপতি, যাকে স্টক মার্কেটের পরিভাষায় বলে 'বুল'।
স্টক মার্কেট হলো এমন একটি জায়গা যেখানে আপনি ৫,০০০ টাকা নিয়ে প্রবেশ করলেও আপনি একদিন হয়ে উঠতে পারবেন কোটিপতি আবার ৫০,০০০ টাকা নিয়ে প্রবেশ করে আপনি হয়ে যেতে পারেন ফকির। এই মার্কেটের সবটাই একটি নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা। আর সেই ছকের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে গেলে আপনাকেও জানতে হবে এই স্টক মার্কেটের কিছু বিশেষ টিপস। স্টক মার্কেটে সবটাই সময় এবং বুদ্ধির খেলা। মার্কেটে প্রবেশের প্রথম দিনেই যে আপনি কোটি টাকার মুখ দেখবেন, সেটা ভুলেও ভাববেন না। আসলে এই স্টক মার্কেট হলো একটি অত্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, যেখানে আপনি নানা চড়াই উৎরাই লক্ষ করবেন। কিন্তু, হাল ছাড়লে হবেনা। বিশেষ করে আপনি যখন স্টক মার্কেটে প্রথম প্রথম পা রাখার চেষ্টা করছেন, সেই সময়টা সবথেকে দরকারি। তাই সেই সময়ে আপনার লাগবে সঠিক পথ চেনা এবং সঠিক পরিকল্পনা। তবেই আপনি হয়ে উঠবেন কোটিপতি, যাকে স্টক মার্কেটের পরিভাষায় বলে 'বুল'।
তবে এই বিনিয়োগ শুরুর আগে আপনাকে জানতে হবে, স্টক মার্কেটে আপনি কেনো বিনিয়োগ করবেন। মূলত এই মার্কেটে টাকা লাগানোর দুটি বিশেষ কারণ রয়েছে, প্রথমটি হলো, নিজের বিনিয়োগে বেশি রিটার্ন পাওয়া, এবং দ্বিতীয়টি হলো, আর্থিক স্থায়িত্ব লাভ। বিগত শতাব্দী থেকেই বলতে গেলে ভারতে এই স্টক কালচার ভালোভাবে শুরু হয়েছে। ১৯৯১ সালে অর্থনীতির আগল খোলার আগে অবধি ভারতের স্টক মার্কেট সীমাবদ্ধ ছিল খুবই ছোট্ট পরিসরে। কিন্তু, তারপর থেকে অনেকটাই বদলেছে ভারতের স্টকের বাজার। বিদেশি স্টকের পাশাপাশি, ভারতীয় বিভিন্ন কোম্পানির স্টকও দর বাড়িয়েছে ধাপে ধাপে। মানুষও আকৃষ্ট হতে শুরু করেছেন এই স্টক মার্কেটের দিকে। স্টেট ব্যাংকের স্থায়ী আমানতের সেই গতে বাঁধা সুদের হার ছেড়ে মানুষ হাত বাড়িয়েছেন স্টক এক্সচেঞ্জের দিকে। ক্ষতি হয়েছে অনেকের, তবে যারা ঠিক করে পরিকল্পনা করে মাঠে নেমেছেন, তারা ফলন পেয়েছেন বেশ ভালই।
এই স্টক মার্কেট আসলে কী?
স্টক মার্কেট হলো এমন একটি জায়গা যেখানে ফাইন্যান্সিয়াল কোম্পানির ট্রেডিং করা হয়। এই ট্রেডিংয়ের তালিকায় যেমন আছে স্টক, বন্ড, তেমনি আপনি পাবেন কমোডিটি এবং মিউচ্যুয়াল ফান্ডের মত কিছু বিনিয়োগের বিষয়বস্তু। এই মুহূর্তে ভারতে দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ কাজ করে। একটি হলো ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ বা NSE। অপরটি হলো বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ বা BSE। এই মুহূর্তে ভারতের ৯০% ক্যাশ ট্রেডিং করা হয় এই ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমেই। এই দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ ছাড়াও ভারতে আরো কিছু স্টক এক্সচেঞ্জ আছে, যেমন - মাল্টি কমোডিটি এক্সচেঞ্জ বা MCX, ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জ বা IEX ইত্যাদি। এই সমস্ত স্টক এক্সচেঞ্জে যে সমস্ত ট্রেডিং হয়, তার সবটার রেজুলেশনের দায়িত্ব থাকে ভারতের সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড বা SEBI এর হাতেই।
তবে শুধুমাত্র কোম্পানি লিস্টিং নয়, এই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমেই ভারতীয় স্টক মার্কেটের বিভিন্ন সূচকও নির্ধারিত হয়। ভারতের স্টক সূচকগুলির মধ্যে সবথেকে বহুল প্রচলিত দুটি সূচক হল নিফটি এবং সেন্সেক্স। NIFTY মূলত ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে লিস্ট করা সব থেকে উপরে থাকা ৫০টি স্টকের একটি সমষ্টি। অন্যদিকে, SENSEX হলো বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে লিস্ট করা সব থেকে উপরে থাকা ৩০টি স্টকের সমষ্টি। সাধারণত এই দুটির উপরেই নির্ভর করে ভারতীয় স্টক মার্কেটের গতিপ্রকৃতি।
কী ভাবে বিনিয়োগ করবেন স্টক মার্কেটে?
আপনি সরাসরি গিয়ে স্টক মার্কেটে কখনোই শেয়ার কিনে নিতে পারবেন না। স্টক মার্কেটে শেয়ার কেনার জন্য আপনাদের প্রথমে স্টক ব্রোকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে অথবা যোগাযোগ করতে হবে বিভিন্ন স্টক মার্কেট বিনিয়োগের কোম্পানিতে। এর পদ্ধতিটা অত্যন্ত সহজ।
১. প্রথমে আপনাকে নিজের নামে একটি ট্রেডিং একাউন্ট তৈরি করতে হবে যার মাধ্যমে আপনি ব্রোকার অথবা স্টক ডিলারদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। এই ট্রেডিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মূলত আপনি স্টক কিনতে পারবেন অথবা এক্সচেঞ্জ করতে পারবেন।
২. যে স্টক মার্কেট কোম্পানির সঙ্গে আপনি যোগাযোগ করবেন তারা আপনার নামে একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট ওপেন করবে। এই ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট আপনার ফিনান্সিয়াল সিকিউরিটিকে সুনিশ্চিত করে থাকে।
৩. এরপর আপনার ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট এবং আপনার ডিম্যাট অ্যাকাউন্টকে আপনার ব্যাংক একাউন্টের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
৪. এই দুটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করার জন্য আপনাকে নিজের কেওয়াইসি ভালোভাবে ফিলাপ করতে হবে এবং যেকোনো একটি সরকারি পরিচয় পত্র আপনাকে দিতে হবে এর সাথে। সব থেকে ভালো হয় যদি আপনি প্যান কার্ড অথবা আধার কার্ড ব্যবহার করেন।
৫. এই মুহূর্তে যদি আপনি কোন একটি অনলাইন স্টক ব্রোকার প্লাটফর্মের মাধ্যমে স্টক মার্কেট বিনিয়োগ করেন তাহলে অনলাইন কেওয়াইসি ভেরিফিকেশনের সুবিধা পেয়ে যাবেন আপনি। সমস্ত কেওয়াইসি করা হয়ে গেলে আপনার অ্যাকাউন্ট যদি ঠিকঠাক থাকে তাহলে আপনি নিজের নামে স্টক মার্কেটে ট্রেডিং করতে পারবেন এই ডিম্যাট এবং ট্রেডিং অ্যাকাউন্ট এর মাধ্যমে।
শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করার চার্জ কেমন?
আপনি যদি শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করেন তাহলে আপনাকে কয়েকটি বিশেষ চার্জের ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে। এই সমস্ত চার্জের মধ্যে রয়েছে ট্রানজাকশন চার্জ, ডিম্যাট চার্জ, এবং অন্যান্য কিছু ট্যাক্স। যে প্লাটফর্মের মাধ্যমেই আপনি এই স্টক এক্সচেঞ্জ করবেন তাদের আলাদা আলাদা চার্জ থাকতে পারে। তবে ডিম্যাট চার্জের একটি সাধারণ রেঞ্জ আছে। আপনার অ্যাকাউন্টের এই ডিম্যাট চার্জ মোটামুটি ৭৫০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যেই ঘোরাফেরা করবে। এ ছাড়া আপনাকে লং-টার্ম ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ও শর্ট-টার্ম ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স দিতে হবে।
স্টক মার্কেটে কোথায় কোথায় বিনিয়োগ করতে পারেন?
স্টক মার্কেটের বিশেষ কিছু ইনভেস্টমেন্ট এর জায়গার মধ্যে রয়েছে ইকুইটি শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড ও এক্সচেঞ্জ ট্রেড ফান্ড।
১. ইকুইটি শেয়ার - কোম্পানির তরফ থেকে এই শেয়ার অফার করা হয়ে থাকে। এই শেয়ার যদি আপনি গ্রহণ করেন তাহলে সেই কোম্পানির লভ্যাংশ ডিভিডেন্ড আকারে নির্দিষ্ট সময় অন্তর আপনার কাছে আসবে।
২. বন্ড - শুধুমাত্র কোন স্বাধীন কোম্পানি নয় সরকারের তরফ থেকেও শেয়ার মার্কেটে এই বন্ড বিক্রির জন্য ছাড়া হয়। বন্ড আদতে এক ধরনের ঋণ, যা সেই নির্দিষ্ট কোম্পানি বা সরকারের ওই নির্দিষ্ট দপ্তর গ্রহণ করে। এই বন্ডের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সুদের হার থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমাও থাকে। এর ফলে বন্ড খুব একটা বেশি ঝুঁকিবহুল বিষয় নয়। লাভের পরিমাণ খুব একটা বেশি হয় না এই বন্ডের ক্ষেত্রে, তবে আপনার ঝুঁকি অনেকখানি কমে এবং আপনি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা প্রত্যেক মাসে আয় করতে পারেন। কেউ যদি বন্ড ক্রয় করতে চান, তাহলে তিনি সরকারি বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক থাকেন।
৩. মিউচুয়াল ফান্ড - মিউচুয়াল ফান্ড এবং ইকুইটি শেয়ার প্রায় একই রকম হলেও এ দুটির মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে আগে বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী থেকে একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা সংগৃহীত হয় এবং তারপর সেই টাকা কোন একটি কোম্পানি যেকোনো একটি ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউশনে বিনিয়োগ করে। সেই বিনিয়োগ থেকে উঠে আসা টাকার লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আনুপাতিক হারে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় গণনা করা হয় এই বিনিয়োগের নেট অ্যাসেট ভ্যালু বা NAV। এই ফান্ডের পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন প্রশিক্ষিত একজন ফান্ড ম্যানেজার।
৪. এক্সচেঞ্জ ট্রেড ফান্ড - এই ধরনের ফান্ড আগে খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও বিগত কয়েক বছরে এক্সচেঞ্জ ট্রেড ফান্ড ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে। এই ফান্ড সাধারণত NIFTY অথবা SENSEX এর মত কিছু ইন্ডেক্সের উপরে নির্ভর করে চলে। উদাহরণস্বরূপ ধরে নেওয়া যাক, NIFTY র এক্সচেঞ্জ ট্রেড ফান্ড আপনি গ্রহণ করছেন। সেক্ষেত্রে নিফটির ৫০টি স্টকের মধ্যে আপনি একটি ছোট্ট অংশ গ্রহণ করলেন ফান্ড হিসাবে। এই ধরনের ফান্ডকে সাধারণত প্যাসিভ প্রোডাক্ট বলা হয়ে থাকে এবং এর খরচ সাধারণ মিউচুয়াল ফান্ডের থেকে কিছুটা কম হলেও রিস্ক এবং রিটার্ন প্রোফাইল অনেকটা সেই ইনডেক্সটির মতোই।
বিনিয়োগের নিশ্চয়তা পাবেন কী ভাবে?
স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে গেলে ঝুঁকির পরিমাণ অন্যান্য বিনিয়োগের থেকে অনেক বেশি। তাই বিনিয়োগে নিশ্চয়তা পেতে গেলে আপনাকে কিছু বিষয়ের উপরে নজর রাখতে হবে।
১. রিস্ক ফ্যাক্টর
প্রথমত আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে রিস্ক ফ্যাক্টরের বিষয়টা। মনে রাখবেন, আপনার বিনিয়োগের ঝুঁকি নির্ভর করবে আপনার বিনিয়োগের সময়সীমা, আপনার টার্গেট এবং আপনার ক্যাপিটাল এর উপর। যদি আপনি স্বল্প সময়ের জন্য কোন একটি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করেন, তাহলে আপনার ঝুঁকি বেশি থাকতে পারে। তাই যদি আপনি আপনার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হন, তাহলে একেবারে প্রথমেই শর্ট টার্ম বিনিয়োগ না করাই ভালো। তবে একেবারে ঝুঁকিবিহীন বিনিয়োগ করতে গেলে একটু লার্জ ক্যাপিটাল স্টকে বিনিয়োগ করুন, ইকুইটি শেয়ারের দিকে বিনিয়োগের মাত্রা কমান। চাইলে আপনি ডেট বন্ডেও বিনিয়োগ করতে পারেন। এক্ষেত্রে আপনার লাভের পরিমাণ কম হলেও ঝুঁকির পরিমাণ অত্যন্ত কম।
২. নিয়মিতভাবে বিনিয়োগ করুন
আপনার কাছে যদি এই মুহূর্তে একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকে, তাহলে নিয়মিতভাবে বিনিয়োগ করা শুরু করুন। নিজের একটি বাজেট তৈরি করুন এবং সেই বাজেটের নিরিখে শুরু করুন বিনিয়োগ। স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে হলে একসাথে পুরো টাকা বিনিয়োগ করে দেবেন না। তার পরিবর্তে একটি সিস্টেমেটিক ইনভেষ্টমেন্ট প্ল্যান বা SIP গ্রহণ করুন। SIP গ্রহণ করলে আপনি প্রতি মাসে একটাই নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বিনিয়োগ করবেন এবং বিনিয়োগকৃত টাকার উপরে আপনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে।
৩. ভালো পোর্টফোলিও তৈরি করুন
একটি ভালো পোর্টফোলিও তৈরি করতে হলে আপনাকে বিভিন্ন প্রকৃতির এবং বিভিন্ন কোম্পানির স্টকে আপনাকে বিনিয়োগ করতে হবে। সব সময় শুধু একটি কোম্পানির স্টকে বিনিয়োগ করে গেলে আপনার পোর্টফোলিও ভালোভাবে তৈরি হবে না এবং আপনার কিছু কিছু বিনিয়োগ ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
বিভিন্ন ধরনের মার্কেট ক্যাপিটাল এবং একাধিক ধরনের কোম্পানিতে বিনিয়োগ করুন। ঝুঁকি গ্রহণের ক্ষমতা থাকলেই শুধুমাত্র যে ইকুইটি শেয়ারেই বিনিয়োগ করে যাবেন, এটা সমাধান নয়। পরিবর্তে, বিভিন্ন ধরনের স্টকে বিনিয়োগ করুন। গ্রহণ কোন কিছু মিউচুয়াল ফান্ড এবং সরকারি ও বেসরকারি বন্ড, বিনিয়োগ করুন ট্রেড ফান্ডে। এতে হয়তো আয়ের পরিমাণ কিছুটা কমে যেতে পারে, তবে SIP ব্যবহার করে এই সমস্ত ফান্ডে বিনিয়োগ করলে আপনার ঝুঁকি অনেকটা কম থাকবে।