ওয়ানাড় ধ্বংস হবে, ১৪ বছর আগেই জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা! কেন সতর্ক হয়নি সরকার?
Wayanad landslides: ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ওয়ানাড় জেলার ৬২ শতাংশ বনভূমিই উধাও হয়ে গেছে!
দু'দিনে মৃত ২৫৬! ওয়ানাড়ের এই মুহূর্তের ভয়াবহ পরিস্থিতি দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে ২০১৯ সালের মর্মান্তিক বন্যার কথা। ওই বন্যায় কেরলে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫০০-র কাছাকাছি মানুষ। গত মঙ্গলবার কেরলে ভারী বর্ষণ শুরু হয়। ভারী বৃষ্টিতে ওয়ানাড়ে একাধিক ভূমিধস শুরু হয়। এই ভয়াবহ বর্ষণ ও ধসের কারণে ২৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এখনও। বহু মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নীচেই চাপা পড়ে আছেন। ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়বে আরও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেরলের এই বিধ্বংসী ভূমিধসের নেপথ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, অত্যধিক খনন এবং এই অঞ্চলে বনভূমি ধ্বংসের মতো কারণ।
আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আগামী দুই দিনে কেরলের আরও কিছু জায়গায় আরও ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। ২০২৩ সালে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বা ইসরোর (ISRO) ন্যাশনাল রিমোট সেন্সিং সেন্টার প্রকাশিত ল্যান্ডলাইড অ্যাটলাস অনুযায়ী, ভারতের ৩০টি সবচেয়ে ভূমিধস-প্রবণ জেলার মধ্যে ১০টিই কেরলে। ওই তালিকায় ওয়ানাড় ১৩ তম স্থানে রয়েছে। এই ভূমিধসের কারণ একাধিক বলে মনে করেছেন বিজ্ঞানীরা। ওয়ানাড়ের এই ধারাবাহিক ভূমিধসের পিছনে বনভূমি ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অতিরিক্ত খননই দায়ী বলে মনে করেছেন তারা।
আরও পড়ুন- ধ্বংসের মুখোমুখি ওয়ানাড়! একদিনে মৃত ১৫৬! কেন প্রতি বর্ষায় কেরলে ঘটছে বিপর্যয়?
ভারতে ভূমিধস প্রবণ এলাকাগুলি নিয়ে ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, কেরলে মোট ভূমিধসের ৫৯ শতাংশই গাছপালা ছিল এমন এলাকায় ঘটেছে। ২০২২ সালে ওয়ানাড়ের ক্ষয়প্রাপ্ত বনভূমির উপর একটি সমীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা গেছে, ১৯৫০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ওয়ানাড় জেলার ৬২ শতাংশ বনভূমিই উধাও হয়ে গেছে!
ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ওয়ানাড়ের মোট এলাকার প্রায় ৮৫ শতাংশই ছিল বনভূমি। বনভূমি ক্ষয়ে যাওয়াতে মাটির ভঙ্গুরতা বেড়ে যায়। বিশেষ করে পশ্চিমঘাটের ভারী বৃষ্টিপাত প্রবণ এলাকায় প্রবল বর্ষণে মাটি আলগা হয়েই যায়। গাছের শিকড় সেই মাটিকে ধরে রাখে। গাছ নেই তাই মাটিকে আগলে রাখারও কেউ নেই।
কোচিন ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (CUSAT) অ্যাডভান্সড সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফিয়ারিক রাডার রিসার্চের বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেরল রাজ্যে অত্যন্ত ভারী এবং অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির কারণ হচ্ছে আরব সাগরের উষ্ণতা। গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব আরব সাগর ক্রমেই উষ্ণ হয়ে উঠছে। যার ফলে কেরলসহ এই অঞ্চলের উপরের বায়ুমণ্ডলের তাপ বাড়ছে, তা ভারসাম্য হারাচ্ছে।
আরও পড়ুন- ভয়াল স্মৃতি উস্কে ফের ফুঁসছে তিস্তা! যে ভয়াবহ দুর্যোগের মুখে সিকিম
বিজ্ঞানীরা আরব সাগরের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিশাল মেঘ তৈরির প্রবণতা লক্ষ্য করেছেন। এই মেঘ যখন সমুদ্রের উপর থেকে ভূখণ্ডে প্রবেশ করে, তা অল্প সময়ের মধ্যে অত্যন্ত ভারী বৃষ্টিপাত ঘটায়, ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ায়। ২০১৯ সালে কেরলে বন্যার পর থেকেই এই ধরনের বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
২০২২ সালে ক্লাইমেট অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের পশ্চিম উপকূলে ক্রমেই বৃষ্টিপাত বিষয়টি ভয়াবহ হয়ে উঠছে। অল্প সময়ের মধ্যে তীব্র বৃষ্টিপাতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চারপাশ।
পশ্চিমঘাট ইকোলজি এক্সপার্ট প্যানেল ২০১১ সাল থেকেই ওয়ানাড়ের পাহাড়ি এলাকাকে পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল ঘোষণা করার সুপারিশ করে। ওই প্যানেলটি জানায়, এই অঞ্চলটিকে পরিবেশগত সংবেদনশীলতার উপর ভিত্তি করে নির্দিষ্ট জোনে ভাগ করা দরকার। সবচেয়ে দুর্বল অংশগুলিকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা এবং এই এলাকায় ব্যাপক বাণিজ্যিক কার্যকলাপ বন্ধ করা একান্ত দরকার। পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল অঞ্চল ১-এ খনি, খননকার্য, নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং বড় আকারের বায়ু শক্তি প্রকল্প নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করে ওই প্যানেল। তবে রাজ্য সরকার, শিল্পপতি এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের প্রতিরোধের কারণে ১৪ বছর পরেও প্যানেলের সুপারিশ বাস্তবায়িত করা হয়নি। যার মাশুল গুনছেন সাধারণ মানুষই।