শহরের ক্যাকাফোনি থেকে দিন তিনেকের মুক্তি, পুজো কাটান এবার 'ঘুটঘুটানন্দজি'-র ডেরায়

Weekend Trip to Kankrajhore: একটা সময় এই কাঁকড়াঝোরেই শুটিং হয়েছিল জনপ্রিয় সিনেমা চারমূর্তির। এই সব জঙ্গলেই অভিযান চালিয়েছিলেন টেনিদা, ক্যাবলা, প্য়ালা আর হাবুল। কাঁকড়া শব্দের অর্থ পাহাড় আর ঝোড় মানে জঙ্গল। তার থেকেই না...

হাতে অল্প সময়ের অবসর। বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা কার না হয়! তবে শহুরে ভিড় থেকে অল্প সময়ে এমন কোন জায়গা রয়েছে যা আপনাকে দেবে ক্ষণিকের শান্তি, কোথায় নিসর্গের সঙ্গে মিলবে নির্জনতাও! খুব বেশি দূরে নয়, 'ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া' কলকাতার কাছেই রয়েছে এমন স্বপ্নরাজ্য। তিলোত্তমা থেকে মাত্র ১৯৮ কিলোমিটার দূরে বেলপাহাড়ি, বেলপাহাড়ি থেকে ২৮ কিলোমিটার মতো পথ এগোলেই কাঁকড়াঝোড়। শহর বলতে যা বোঝানো যায়, তার চিহ্নমাত্র নেই আশপাশে। শাল-সেগুনের জঙ্গল আর পাহাড় ঘেরা নির্জন এই জায়গা কিন্তু হতেই পারে আপনার দিনকতকের ঠিকানা।

আরও পড়ুন: প্রতি পদে বিভূতিভূষণের স্মৃতি, সস্তার এই স্বর্গই হোক পুজো ডেস্টিনেশন

প্রত্যন্ত গ্রাম বললে যা বোঝানো যায়, কাঁকড়াঝোর ঠিক যেন তাই। এখানকার অধিকাংশ মানুষেরই বসবাস দারিদ্রসীমার নিচে। কোনও ক্রমে চাষ করে, কাঠ কেটে দিন যাপন করেন বাসিন্দারা। রাত্রি হলেই বাতাসে চেপে বসে মহুয়ার নেশা। বিনোদন বলুন বা অবসর, ওইটুকুই। পর দিন আলো ফুটতে না ফুটতে শুরু হয় ফের আরও একটা হাড় ভাঙা খাটুনির দিন। আশপাশে সব আদিবাসী ঘরবাড়ি, মাটির দেওয়ালে ফুল-পাখির নকশা, গ্রাম্য ছবি। গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছক ছাই না-পৌঁছক, রাজনীতির স্লোগান, দেওয়াল লিখন ঠিকই পৌঁছে যায়। ফলে ইতিউতি মাটির বাড়ির গায়ে রাজনীতির দেওয়াল লিখনেরও দেখা মিলবে।

এক সময় মাওবাদী অত্যাচারে এই সব এলাকায় পা রাখতেও ভয় পেতেন মানুষ। তবে এখন সেই দিন গিয়েছে। ফলে বেড়েছে পর্যটকদের যাতায়াত। পর্যটকেরা এলে দু-এক টাকা রোজগার বাড়ে। ফলে হাসি ফোটে গেঁয়োগুবরো মানুষগুলোর মুখেও। কাঁকড়াঝোর প্রত্যন্ত গ্রাম, দিনরাত খেটেও দুবেলার অন্ন সংকুলান কঠিন মানুষগুলোর পক্ষে। তাই বোধহয় পাহাড়,সবুজের সরলতা আজও অক্ষুন্ন। তাতে নাগরিক জীবনের ছাপ ততোটা পৌঁছয়নি। তবে ইদানীং টুকটাক সরকারি প্রকল্প, সুবিধা অল্পবিস্তর পৌঁছচ্ছে গ্রামে। তৈরি হয়েছে রাস্তা, স্কুলে মিডডে মিলের পাতে পড়ছে ভাত-ডাল।

একটা সময় এই কাঁকড়াঝোরেই শুটিং হয়েছিল জনপ্রিয় সিনেমা চারমূর্তির। এই সব জঙ্গলেই অভিযান চালিয়েছিলেন টেনিদা, ক্যাবলা, প্য়ালা আর হাবুল। কাঁকড়া শব্দের অর্থ পাহাড় আর ঝোড় মানে জঙ্গল। তার থেকেই নাম কাঁকড়াঝোড়। বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর বা ঝাড়গ্রাম, সব দিক থেকেই চলে আসা যায় এই কাঁকড়াঝোড়। ঝাড়গ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরের বেলপাহাড়ি। বেলপাহাড়ি থেকে আরও ১০ কিমি যেতে তামাজুড়ি বাসপথে ভোলাবেদা। সেখান থেকে ১৮ কিমি হেঁটে বা সাইকেলে বা জিপে চেপে চলে যাওয়া যায় জঙ্গলের অন্দরে, কাঁকড়াঝোড়ে। যাওয়া যায় বাঁশপাহাড়ির দিক থেকেও। আশপাশে ছবির মতো সব ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর সব গ্রাম। চাকডোবা, কাশমোর, ছুরিমারা, ময়ূরঝর্না, কাশিডাঙা হয়ে পথ যাবে কাঁকড়াঝোড়। পথ বন্ধুর, চড়াই-উতরাই আছে, দু'পাশে গহীন বন। কুসুম, শাল, পিয়াল, সেগুন, মহুয়া, আকাশমণিতে ছেয়ে রেখেছে পথ, ভৈরব পাহাড় দিয়ে ঘেরা জঙ্গলে চড়তে দেখবেন বুনো শুয়োর, বনমুরগির ঝাঁক। সবচেয়ে ভালো ব্যাপার, প্রায়শই এখানে দেখা মেলে ময়ূরের। আমরা তো সাধারণ ভাবে বাঁধা ময়ূর দেখেই অভ্যস্ত। এখানে প্রায়শই জঙ্গলের পথে প্রায়শই দেখা মিলবে দেশের জাতীয় পাখির। তার কেকা রব ছিঁড়ে ফেলবে চরাচরের নিঃস্তব্ধতা।

একসময় কাঁকড়াঝোড় জঙ্গলের বড় ত্রাস ছিল মাওবাদীরা। পাল্লা দিয়ে ছিল হাতির উপদ্রব। কাঁকড়াঝোড়কে মাওবাদীমুক্ত করা গেলেও হাতির উপদ্রব আজও এখানকার বড় বিভীষিকা। দলমা থেকে যখনতখন নেমে এসে জনবসতিতে ঢুকে পড়ে হাতির দল। আসলে এই এলাকার উপর দিয়েই রয়েছে হাতির চলাচলের পথ। বহু এলাকাই ইলেকট্রিক ফেন্সিং দিয়ে ঘিরে রেখেছে প্রশাসন। তবু ভয় যায় না। সামান্য চাষবাস হয় বটে, তবে এখানকার মানুষের সব চেয়ে বড় জীবিকা হল কেন্দু পাতা। ওই কেন্দুপাতা দিয়ে বিড়ি বেঁধেই কোনও ক্রমে জীবনধারণ করেন গ্রামবাসীরা। সময়ে সময়ে পেকে ওঠে মহুয়ার ফুল। গন্ধে তখন উজার হয়ে যায় বনাঞ্চল। এখানে ঘরে ঘরে মহুয়া থেকে মদ তৈরি হয়। সেই মদ তৈরির প্রক্রিয়া সহজ নয়। তবে তাতে রীতিমতো পাকা হাত এখানকার বাসিন্দাদের। রাত বাড়লে সেই মহুয়া জঙ্গলের পাশাপাশি পাগল করে সারাদিন ধরে ক্লান্ত মানুষগুলোকেও। বসে আসর।

পাহাড়ি নদী চাঁদনী রাতে কুহকিনীর মতো বয়ে চলে। রাত বাড়লে শরীর শিরশির করে ওঠে হাওয়ায়। বরাবরই এই ধরনের পরিবেশ কাজু চাষের জন্য আদর্শ। তার সঙ্গেই ইদানীং কাঁকড়াঝোড়ে অল্পবিস্তর কফি ও কমলালেবু চাষ হয়। তাছাড়া সাবাই ঘাসের বন থেকে প্রায় প্রতিটি পরিবার দড়ি তৈরি করে। সে দড়ি সপ্তাশেষে বিকোয় কাঁকড়াঝোড়ের হাটে।

পশ্চিমে তার সীমানা টেনেছে ভৈরবী নদী, স্থানীয়রা বলেন ঘর্ঘরা নালা। ওই নালাটুকু পেরোলেই ঝাড়খণ্ড। একটু এগোলেই পৌঁছে যাবেন ঘাটশিলায়। ঝাড়গ্রাম থেকে কাঁকড়াঝোড়ের দূরত্ব ৭৯ কিলোমিটার আর বেলপাহাড়ি থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার। বেলপাহাড়ি থেকে একটু এগিয়ে বাঁ দিক থেকে ওদলচুয়ার রাস্তা ধরলেই পৌঁছে যাওয়া যায় কাঁকড়াঝোড়ে। মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম থেকেও বাস যোগাযোগ রয়েছে। এখান থেকে ঘাটশিলা হয়েও ঘোরা যায়। জঙ্গলে কিছুটা পথ হেঁটে কাশীদা, তারপর সেখান থেকে বাসে ঘাটশিলা যাওয়া যায়। ট্রেকিংয়ের ইচ্ছে থাকলে কাঁকড়াঝোড়কে কেন্দ্র করে ছোট ছোট ট্রেকও করা যায় অনায়াসেই। এদিকে কাঁকড়াঝোড় থেকে ঘুরে আসতে পারেন ঝিলিমিলি, বিষ্ণুপুর এমনকী মুকুটমণিপুরও।

কাঁকড়াঝোড় থেকে গাড়ির পথে কদমডিহা, বুরিঝোড়, শুষনিজীবি হয়ে সিঙ্গাডোবা গ্রাম। সেখান থেকে মোরাম পথে ২ কিলোমিটার এগোলেই কেটকি ঝর্না। দেখে আসতে পারেন তা-ও। পাহাড়ি ঝোরার জল আটকে এক বিস্তীর্ণ জলাশয়। ঝর্না অবধি পুরোটা গাড়ি যায়। তার জন্য অল্প হাঁটতে হবে পর্যটকদের। সেই পথটুকুও কিছু কম মায়াময় নয়।

আরও পড়ুন:সিকিমের নির্জনতম গ্রাম আপনার অপেক্ষায়! পুজোর ভিড় এড়াতে প্ল‍্যান করুন আজই

দিনে দিনে পর্যটনকে গুরুত্ব দিচ্ছে কাঁকড়াঝোড়। ফলে বাড়ছে হোমস্টে, ছোট ছোট হোটেল, রাত্রিবাসের ঠিকানা। রয়েছে মাহাতো লজ, চারমূর্তি হোমস্টে, কেকাবনীর মতো একাধিক সরকারি, বেসরকারি হোমস্টে। পাহাড় জঙ্গলের মাঝে আপনার দিন কাটতে বুড়ো সাদাম রিট্রিটেও। রাত্রি বাড়লে আপনার আশপাশে ভিড় করবে নানা রকম প্যাঁচা, ডেকে উঠবে ময়ূর। আপনার যদি পাখি দেখার নেশা থাকে তাহলে আপনার জন্য স্বর্গ হতে পারে কাঁকড়াঝোড়। হাঁটাপথে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেই আপনাকে ঘিরে ধরবে নানাবিধ পাখির ঝাঁক। ভিতরে বুড়ো শিবমন্দিরকে ঘিরে উঁকি মারবে সন্ধ্য়ের চাঁদ। এক অপূর্ব রাত্তির নেমে আসবে জঙ্গল জুড়ে। আর এই সব নৈসর্গিক অভিজ্ঞতার সাক্ষী থাকতে চাইলে এই পুজোয় আপনার গন্তব্য হতেই পারে বাড়ির কাছের এই একটু চেনা আর অনেকটা অজানা এই বনাঞ্চল। দিন তিনেকের জন্য সেরে আসতেই পারেন টেনিদার মতোই রোমাঞ্চকর কোনও অভিযান। কে বলতে পারে আপনারও দেখা হয়ে যাবে না কোন ঘুটঘুটানন্দের সঙ্গে!

More Articles