হাসিনার দেশে কাদের গুম করে রাখা হতো কুঠুরিতে! কী এই রহস্যময় আয়নাঘর?
Aynaghar Bangladesh: ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৫ জন গুম হয়েছেন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে একটি আয়নাঘর রয়েছে। শব্দটা যতখানি আদুরে, আয়নাঘরের বাস্তবতা ততখানিই ভয়াবহ। সম্প্রতি, শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর সেনাবাহিনী জানায়, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে। তারপরেই আয়নাঘরের বন্দিদের মুক্তি দেওয়ারও দাবি উঠেছে। কী এই আয়নাঘর? আয়নাঘরে বন্দি করে রাখা হয় কাদের? শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পরে, বাংলাদেশে বিগত দীর্ঘ বছর ধরে গুম হয়েছেন অনেকে। এদের মধ্যে অধিকাংশই আওয়ামী লীগের বিরোধী মতের মানুষ। আয়নাঘরে বন্দি রাখা হয়েছে সেনার বহু প্রাক্তন কর্মকর্তাদেরও। কেউ কেউ পরে মুক্তি পেয়েছেন, অনেকেরই কোনও খোঁজখবর নেই আজও। তবে হাসিনা সরকারের পতনের পর একে একে মুক্তি পাচ্ছেন অনেকেই। আয়নাঘর আসলে গোয়েন্দা সংস্থার এক গোপন বন্দিশালা। ঠিক কী ঘটে তবে?
গাজীপুরের শেখ মহম্মদ সেলিমের কথাই ধরা যাক। মালয়েশিয়াতে থাকতেন। বাংলাদেশে ফিরেছিলেন বিয়ে করতে। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মে মাসে দিনেদুপুরে সেলিমকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আর তাঁর কোনও হদিস পায়নি পরিবার। এই ঘটনার কয়েক মাস পর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ জানায় জঙ্গিদের সঙ্গে যোগসূত্রতার অভিযোগে সেলিমকে আটক করা হয়েছে। এর বেশ কিছুকাল পর সেলিমকে ছাড়া হয়, জেল থেকে বেরিয়ে মালয়েশিয়ায় ফিরে যান তিনি।
আরও পড়ুন- যাঁদের জন্য লেখিকাকে নির্বাসন, তাঁদের হাতেই দেশছাড়া হাসিনা! কী বলছেন তসলিমা?
সেলিম ওই আয়নাঘরের বন্দি। তিনি জানিয়েছিলেন, সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার এক গোপন আস্তানায় তাঁকে এবং আরও বহুজনকেই আটকে রাখা হয়েছিল। এই গোপন আস্তানার নামই ‘আয়নাঘর’ যেখানে বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া মানুষদের বন্দি রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬০৫ জন গুম হয়েছেন বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ১০ বছর ধরে অজ্ঞাত স্থানে আটক করে রাখা ৮৬ জনের তালিকা প্রকাশ করেছিল সেবার। গুম হওয়ার তালিকায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা-কর্মী ও অরাজনৈতিক মানুষদের নামও ছিল। কেউ কেউ গুম হয়েও ফিরে এসেছিলেন। তাঁদের অনেককেই জঙ্গি হিসেবে আটক করা হয়েছিল বলে দেখানো হয়। যারা ফিরেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আর সেই অন্ধকার পর্ব নিয়ে কোনও তথ্যই জানাননি। তবে সেলিম জানিয়েছিলেন। তাঁর দেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশের এই গোপন 'ডিটেনশন ক্যাম্প' এর ঘটনা প্রকাশ্যে আসে।
গুম হওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সেলিম জানিয়েছিলেন, ওই গোপন বন্দিশালার দেওয়ালে অনেক মানুষের বিভিন্ন তথ্যসংবলিত বার্তা তিনি দেখতে পেয়েছেন। অনেকেই ফোন নম্বর লিখে রেখেছিলেন। সেলিমের আগে থেকে যারা বন্দি ছিলেন, তারা সেলিমের কাছে আকুতি জানিয়েছেন তাঁদের এই গুম হওয়ার তথ্য বাড়িতে জানাতে। চোখে কাপড় বেঁধে উপরে একটি টুপি পরিয়ে মাইক্রোবাসে করে নাকি তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেলিমকে। কিছুক্ষণ পরে তিনি জানতে পারেন তাঁকে 'আয়নাঘর' নামে একটি অবৈধ কারাগারে বন্দি করা হবে, যেটির দায়িত্বে আছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর, ডিজিএফআই। সেই গোপন কারাগারটিতে জলখাবারে দেওয়া হতো বিস্কুট, জলের বোতল। দিন-রাত গাঁক গাঁক শব্দে এগজস্ট ফ্যান চলত। মাঝে মাঝেই নাকি বিমানের ওঠা নামার শব্দও পেতেন সেলিম।
নেত্র নিউজের তথ্য অনুযায়ী, ডিজিএফআই-এর কাউন্টার টেরোরিজম ইন্টিলিজেন্স ব্যুরো (সিটিআইবি) এই আয়নাঘর তৈরির দায়িত্বে ছিল। ২০১৬ সালের পর থেকে চার জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদার সামরিক কর্মকর্তা সিটিআইবির পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই একই সময়ে চার জন মেজর জেনারেল ছিলেন ডিজিএফআইয়ের মহাপরিচালক।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ওই ২০০৯ সালেই প্রথম কোনও বিশেষ অভিযান বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই সাধারণ মানুষদের গুম করার অভিযোগ ওঠে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। কী কারণে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাকে বিনা প্রমাণে মানুষকে গুম করার নির্দেশ দেওয়া হলো? মূলত এর লক্ষ্য আওয়ামী লীগ শাসিত বাংলাদেশকে বিরোধীশূন্য করা। তাই কখনও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত দেখিয়ে, কখনও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার আশঙ্কা দেখিয়ে গুম করে দেওয়া হয়েছে অজস্র মানুষকে।
গত শতকে আলজেরিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে ঔপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্স এরকম গুম করার পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিল। পরবর্তীকালে ফরাসিরা এই সংস্কৃতি দক্ষিণ আমেরিকায় রপ্তানি করে। এরপর গুয়াতেমালা, নিকারাগুয়া, এল সালভাদর, চিলি, আর্জেন্টিনায় গণহারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বামপন্থী বিপ্লবীদের গুম করা হয়। ওই সব দেশের সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা গণতন্ত্রপন্থীদের বিমানে করে নিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরে হাত-পা বেঁধে ফেলে দিতেন। ফরাসিরা ফেলে দিতেন ভূমধ্যসাগরে। গুম করার এই নির্মম পদ্ধতি ‘গোস্ট ফ্লাইট’ হিসাবে পরিচিত। গোস্ট ফ্লাইটের যাত্রীরা আরা কখনই ফিরে আসতেন না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রে এমন গুম হওয়ার ঘটনা তাই অবাক করে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে, এই বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম করে দেওয়ার বিষয়টি সরকারি দমনপীড়ন নীতির নিষ্ঠুর পন্থা হয়ে ওঠে।
আরও পড়ুন- বারবার জেগেছে বাংলাদেশ! অবাক করবে সে দেশের গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস
বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের এই গোপন কুঠুরি আয়নাঘরে মূলত 'হাই ভ্যালু' বন্দিদেরই আটক রাখা হয়। ঘটনাচক্রে সেলিম 'হাই ভ্যালু' বন্দি না হওয়াতেই মুক্তি পান। তাঁর সঙ্গেই বন্দি ছিলেন আরও একজন, হাসিনুর। আয়নাঘরের এই অন্য বন্দি হাসিনুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট কর্নেল। তিনি ছিলেন 'হাই ভ্যালু' বন্দি। তাঁকে আটক করা হয় ২০১৮ সালের ৮ অগাস্ট। দ্বিতীয়বার গুম হন তিনি। প্রথমবার গুম হয়েছিলেন ২০১১ সালের জুলাইয়ে। সামরিক বাহিনীর এই পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তা র্যাবের একটি ইউনিটের অধিনায়ক থাকাকালীন বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে ২৮ বছর চাকরি শেষে তাঁকে বরখাস্ত করা হয় এই অভিযোগে যে তিনি নিজেই জঙ্গিদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন! ২০১৮ সালের অগাস্টে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর হাসিনুর প্রায় ১৮ মাস নিখোঁজ ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
হাসিনুর সামরিক বাহিনীর ভেতরকার লোক হওয়াতে এই গোপন বন্দিশালার অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ও নিখুঁত বর্ণনা দিতে পেরেছিলেন। নেত্র নিউজকে হাসিনুর জানিয়েছিলেন, “উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং, দক্ষিণে মেস বি, তার মাঝখানে হলো একটা মাঠ, মাঠের মাঝখানে এই কারাগার — এর ঠিক পূর্ব পাশে লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টার, স্টেশন হেড কোয়ার্টার, এবং ইএনসির (প্রধান প্রকৌশলী) অফিস, পশ্চিম পাশে এমটি শেড, ডিজিএফআইয়ের এমটি শেড, এবং উত্তর-পূর্ব কোণে ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। এই গুম হাউজটার ছদ্মনামই আয়নাঘর।” হাসিনুর রহমানের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই পরে নেত্র নিউজ কারাগারটির অবস্থান বের করে। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি অনুযায়ী দেখা যায় ওই ভবনটির ছাদ ত্রিপল দিয়ে ঢাকা।
বন্দিশালায় ৩০টি সেল রয়েছে। কয়েকটি সাউন্ড-প্রুফ রুম আছে যেখানে বন্দিদের নির্যাতন করা হয়। হাসিনুর জানিয়েছিলেন, এই ভবনে দু'টি অংশ আছে — পুরনো অংশে আছে ১৬টি ঘর; আর নতুনটিতে ১০টি। হাসিনুর রহমান ও শেখ মহম্মদ সেলিম একে অপরকে চিনতেন না। তারা এই একই সময়, একই কারাগারের বন্দিও ছিলেন না। সেলিম গুম হয়েছিলেন ২০১৬ সালে; হাসিনুর ২০১৮ সালে। তবু পরবর্তীতে দেখা যায় দু'জনের বর্ণনা মিলে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- জলের গান ব্যান্ডের রাহুল আনন্দের বাড়ি ভাংচুর! কেন বাংলাদেশে আক্রান্ত শিল্পী?
এতকাল পরে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর এই আয়নাঘরের বন্দিদের মুক্তির দাবি আরও প্রকট হয়। ধীরে ধীরে মুক্তিও পাচ্ছেন অনেক বন্দিই। দীর্ঘ আট বছর পর গোয়েন্দা সংস্থার গোপন বন্দিশালা থেকে মুক্ত হয়েছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (বরখাস্ত) আবদুল্লাহিল আমান আযমী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান)। আযমী জামায়াতে ইসলামীর প্রাক্তন নেতা, মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত গোলাম আযমের (বর্তমানে মৃত) ছেলে। ব্যারিস্টার আরমানও জামায়াতে ইসলামীর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক নেতা মীর কাসেম আলীর পুত্র। ২০১৬ সালের ৯ অগাস্ট মিরপুরের বাড়ি থেকে ব্যারিস্টার আরমানকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
গুম হওয়া মানুষের স্বজনেরা বাকিদের মুক্তির দাবিতে আয়নাঘরের সামনে জড়ো হতে থাকেন, মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে অংশ নেন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাইফুল ইসলামের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার। ২০১৩ সালের ২৭ নভেম্বর রাতে হরিশ্চর এলাকা থেকে তাঁকে র্যাব পরিচয়ে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। এরপর আর খোঁজ মেলেনি।
মুক্তি পেয়েছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সংগঠন ইউপিডিএফের মুখপাত্র মাইকেল চাকমাও। বহুকাল থেকেই মাইকেল চাকমাকে অবিলম্বে তাঁর পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠন ও কয়েকটি বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতারা। ২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে মাইকেল চাকমা নিখোঁজ হয়েছিলেন। যত বন্দি ছাড়া পাবেন, ততই ধীরে ধীরে ফাঁস হয়ে যাবে আয়নাঘরের রহস্য।