গাজার যুদ্ধে 'হ্যানিবাল' নীতি নিচ্ছে ইজরায়েল? কী এই বিতর্কিত হ্যানিবাল প্রোটোকল?
Israel’s Hannibal Directive : ১৯৮৬ সালে ইজরায়েলি তিন সৈন্যকে লেবানিজ জঙ্গি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বন্দি করে নেয়। তারপরই ইজরায়েলি সেনা কমান্ডাররা এই হ্যানিবাল নীতি নেয়।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল। ইজরায়েলের সামরিক বাহিনীতে কাটানো এই তিন বছরই ছিল তাঁর চাকরি জীবনে ইজরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘর্ষের সবচেয়ে হিংসাত্মক সময়। নাম, ইহুদা শাউল। সেই সময় বয়স ওই আঠারোর কাছাকাছি। আসলে ওই সময় চলছে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা (২০০০-২০০৫) বা ফিলিস্তিনের অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়। ইহুদা শাউল ছিলেন পদাতিক যুদ্ধ সৈনিক। পরে তিনি কমান্ডার পদে উন্নীত হন। জেরুজালেমে জন্ম ইহুদার, দুই বছর অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে কাজ করেছেন এবং তৃতীয় বছর লেবানন-ইজরায়েলের সীমান্তে কাজ করতেন তিনি। ইহুদার বয়স এখন ৪১। ইহুদা শাউল ইজরায়েলি এনজিও ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের সহ-প্রতিষ্ঠাতা। ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স ইজরায়েলি প্রাক্তন সেনাদের এক প্রথম এমন সংগঠন যা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক, পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা উপত্যকায় ইজরায়েলি দখলদারিত্বের অবসানের কথা বলে। লেবাননের সীমান্তে কাজ করার সময়ই ইহুদা শাউল প্রথমে হ্যানিবাল নির্দেশিকা সম্পর্কে জানতে পারেন।
হ্যানিবাল নির্দেশিকা এক প্রাক্তন বিতর্কিত ইজরায়েলি সামরিক নীতি যার লক্ষ্য শত্রু বাহিনীর হাতে ইজরায়েলি সৈন্যদের ধরা পড়াকে আটকানো - যে কোনও মূল্যে। সেনাবাহিনীর একটি ফাঁস হওয়া অডিও রেকর্ডিং থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালে গাজা যুদ্ধের সময় ইজরায়েল শেষবার এই হ্যানিবাল পন্থার সহায় হয়, যদিও সেনাবাহিনী তা অস্বীকার করে। এরপর ইজরায়েলি বোমাবর্ষণে বহু ফিলিস্তিনি নিহত হয়, ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সেবারও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ ওঠে। ইহুদা শাউলের কাছে কিন্তু সেই সময় একজন সৈনিক হিসাবে হ্যানিবাল নির্দেশিকার গুরুত্বই ছিল অন্য! কী এই নির্দেশিকা? ইজরায়েল দাবি করে, ২০১৬ সালে এই নির্দেশিকা স্থগিত করেছে তারা। কিন্তু গাজায় ইজরায়েল বর্তমানে যে বোমাবর্ষণ করছে, যাতে ৯,০০০ এরও বেশি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে তাতে কি এই হ্যানিবাল নির্দেশিকা ব্যবহৃত হয়নি?
আরও পড়ুন- ৯০০০ লাশ, শতাধিক গণকবর! যেভাবে কবরের শহর হয়ে উঠছে গাজা…
হ্যানিবাল নির্দেশিকা কি?
এই নির্দেশিকা হ্যানিবাল প্রসিডিওর বা হ্যানিবাল প্রটোকল নামেও পরিচিত। এটি একটি ইজরায়েলি সামরিক নীতি। একজন সৈনিককে অপহরণ করা হলে তাঁকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের কথাই বলে হ্যানিবাল প্রোটোকল। কোনও সৈনিক অপহৃত হলে, বা শত্রুর হাতে তাঁর হত্যা হওয়ার সম্ভাবনা আটকাতে কোনও বাধা ছাড়াই গুলি চালানোর কথা বলে এই নির্দেশিকা। অপহরণকারীদের উপর গুলি চালানোর পাশাপাশি, সৈন্যরা সেই সব জংশন, রাস্তা, হাইওয়ে এবং অন্যান্য পথেও গুলি চালাতে পারে যেখান দিয়ে প্রতিপক্ষরা একজন অপহৃত সৈনিককে নিয়ে যেতে পারে। ইহুদা শাউল জানাচ্ছেন, নির্দেশটি তাঁকে এবং অন্যান্য কমান্ডারদের মৌখিকভাবেই দেওয়া হয়েছিল। হ্যানিবাল নির্দেশিকার কোনও লিখিত পাঠ্য তিনি দেখেননি।
সশস্ত্র সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক আইনে বিশেষজ্ঞ এবং জেনেভা গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউটের সিনিয়র গবেষক ও আন্তর্জাতিক আইনজীবী অ্যানিসা বেল্লাল জানাচ্ছেন, হ্যানিবাল নির্দেশটি কখনই সরকারি নীতি ছিল না এবং তাই তা লিখিতরূপে প্রকাশিত হয়নি। আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে তাই এই নির্দেশটি খুব বিতর্কিত।
হ্যানিবাল নাম হলো কেন?
এই সামরিক নির্দেশের নামের উৎপত্তি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিছু সূত্র অনুযায়ী, একজন কার্থাজিনিয়ান জেনারেলের নামে নামকরণ হয়েছে এই নির্দেশিকার। ১৮১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমানদের কাছে বন্দি হওয়ার পরিবর্তে নিজে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। ইজরায়েলের সামরিক কর্মকর্তারা অবশ্য বলেন, কম্পিউটারই নামটি তৈরি করেছে।
কেন এমন নির্দেশ তৈরি করা হয়েছিল?
১৯৮৬ সালে ইজরায়েলি গিভাতি ব্রিগেডের তিনজন সৈন্যকে সশস্ত্র লেবানিজ জঙ্গি গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বন্দি করে নেয়। তারপরই ইজরায়েলি সেনা কমান্ডাররা এই হ্যানিবাল নীতি নেয়। ইজরায়েল ১৯৮২ সালে লেবানন আক্রমণের পরে এক 'সুরক্ষা অঞ্চল' গড়ে। হিজবুল্লাহ এই অঞ্চলে টহলরত সৈন্যদের বন্দি করেছিল। ব্রিগেডের অন্য সদস্যরা হিজবুল্লাহ জঙ্গিদের তাঁদের সহকর্মী সেনাদের একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে দেখেও গুলি চালায়নি। এই 'ভুল' আর কখনও যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্য এই নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছিল।
১২৩ জন হিজবুল্লাহ সদস্যদের মৃতদেহ ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে ১০ বছর পর ১৯৯৬ সালে বন্দি সৈন্যদের মধ্যে যারা বেঁচেছিল, তাঁদের ইজরায়েলকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকেই ইজরায়েলের এই বিষয়ে অত্যন্ত কট্টরপন্থী অবস্থান।
আরও পড়ুন- ইজরায়েল গাজা যুদ্ধে ভারত কী চায়? উত্তর লুকিয়ে ৭৩ বছর আগের এই ঘটনায়…
কেন বন্দিদের অদলবদল করা হয় না?
২০০৬ সালে ইজরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিতকে হামাস ধরে নিয়ে যায়। পাঁচ বছর বন্দি থাকার পর, অবশেষে ১,০০০ এরও বেশি ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তির বিনিময়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ইজরায়েল নিজের একজন সৈন্যের জন্য এর আগে এত বন্দিকে মুক্তি দেয়নি কখনও। ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি দেওয়াকে রাষ্ট্রের অপমান এবং জাতীয় সম্মানের ক্ষতি হিসাবে দেখে ইজরায়ল। তাই ইজরায়েল যে কোনও মূল্যে সৈন্যদের অপহৃত হওয়া আটকাতে চায়, এমনকী সৈনিকের মৃত্যুর বিনিময়েও।
গিলাদ শালিত ফিরে আসার পর ইজরায়েল অপ্রাপ্তবয়স্ক সহ আরও বেশি ফিলিস্তিনিকে নির্বিচারে গ্রেফতার করতে শুরু করে যাতে পরে এমন কোনও বন্দি সৈনিককে মুক্তি দিতে ‘কাঁচামালের’ জোগান থাকে।
শেষবার হ্যানিবাল প্রোটোকল কখন প্রয়োগ করা হয়?
২০১৪ সালে গাজা উপত্যকায় ইজরায়েল টানা ৫০ দিনের বোমাবর্ষণ করে। ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী এর নাম দেয় অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ। হামাস জঙ্গিরা ইজরায়েলি অফিসার লেফটেন্যান্ট হাদার গোল্ডিনকে বন্দি করার পর শুরু হয় গুলিবর্ষণ। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ওই বছরের ১ অগাস্ট দিনটিকে 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' বলেছিল। এই মারাত্মক যুদ্ধে কমপক্ষে ১৩৫ জন সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু হয়। ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী পরে জানিয়েছিল হামাসের হাত থেকে বাঁচরে গোল্ডিন আত্মহত্যা করেছিলেন, তবে তার দেহ কখনও উদ্ধার করা যায়নি।
হ্যানিবাল নির্দেশিকাটি কখন প্রত্যাহার করা হয়?
২০১৬ সালে এই নির্দেশিকা প্রত্যাহার করা হয়ে বলে মনে করা হয়। তবে কী কারণে তা বাতিল করা হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়।
গাজায় ইজরায়েলের বর্তমান হামলায় কি ফের এই নীতিই নেওয়া হচ্ছে?
৭ অক্টোবর, হামাস ২০০ জনেরও বেশি ইজরায়েলিকে বন্দি করে। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনও বন্দি অবস্থায় রয়েছে বা গাজায় ইজরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছে বলে হামাস জানাচ্ছে। তবে যাদের আটক করা হয়েছে তাদের মধ্যে অনেকেই সাধারণ নাগরিক, তারা সৈনিক নয়। তাই এই নির্দেশ এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তবে গাজায় ইজরায়েলের এই যুদ্ধ ইতিমধ্যেই ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের মারাত্মক আক্রমণগুলিকেও ছাড়িয়ে গেছে। ২০০৮ সালে ২২ দিনে ১,৩৮৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। ২০১৪ সালে ইজরায়েল ২,২৫১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল। এবারের যুদ্ধে একমাসের মধ্যেই মৃত্যু প্রায় ১০ হাজার মানুষের!