ধর্ষণকাণ্ডে শাস্তি ঘোষণা, রাতদখলের আন্দোলন অতীত এবার?
RG Kar Rape and Murder Case: বাসের চালক বা খালাসির বদলে যদি কোনও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ নির্ভয়ার ধর্ষক হতো, তাহলে আদৌ শাস্তি হত কি না, তা নিয়ে সংশয় জাগাচ্ছে অভয়া মামলা।
ইংরেজিতে ‘ক্লোজ়র’ বলে একটা কথা আছে। পরিসমাপ্তি, একটা পরিপূর্ণ সমাপ্তি। শব্দটিকে এখন এভাবেও সংজ্ঞায়িত করা যায়: ১৮ তারিখ ও ২০ তারিখ মিলে শিয়ালদহ কোর্ট আরজি কর মামলা বিষয়ে যে রায় দান করেছে, তাতে জনসাধারণের যে অনুভূতিটা হলো না, যা অধরা থাকল, সেটাকেই ইংরেজিতে ‘ক্লোজ়র’ বলে।
আমরা কি মনে করি সঞ্জয় দোষী? সিমেন ও রক্তের নমুনা যখন মিলেছে, তখন নিশ্চয় সে জনৈক দোষী৷ কিন্তু একজনই কি ছিল? তার চেয়ে বড় কথা, যারা প্রমাণ লোপাট করল, তাদের কি কোনও শাস্তি হবে না? সকলেই জানেন, প্রথমে শোনা গেছিল, মৃতার হাড়গোড় ভাঙা ছিল। অথচ পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হিসেবে আমরা যা পেলাম, তাতে এক্স-রে রিপোর্ট নেই৷ বস্তুত, চাপে পড়ে পোস্টমর্টেম হয়েছে, কিন্তু এই নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা উচিত ছিল পোস্টমর্টেমে, তার সবক'টি হয়নি, চিকিৎসকরাই এমন মতপ্রকাশ করেছেন। এক্স-রে তাদের মধ্যে একটি মাত্র। পোস্টমর্টেম কখন হয়েছে? ঘটনার পরদিন রাতে। রাতে পোস্ট মর্টেম করার নিয়ম নেই। দেহ আবিষ্কৃত হওয়ার পর সারাটা দিন সময় পেয়েও কেন তা করা হয়নি, এ প্রশ্নও ওঠে। শীর্ষ আদালতও দেহ খুঁজে পাওয়া ও পোস্টমর্টেমে পাঠানোর মধ্যে অস্বাভাবিক কালক্ষেপ লক্ষ্য করেছিল।
১০ অগাস্ট তারিখ সকালে অকুস্থলে মৃতদেহকে ঘিরে একাধিক সন্দেহজনক ব্যক্তির আনাগোনা ভিডিওতে ধরা গেছে, যারা দূরদূরান্ত থেকে হঠাৎ ভোরবেলা উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁরা চিকিৎসক, সরকারি স্নেহধন্য, অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ডান হাত-বাঁ হাত। অভিযোগ উঠছে, তাঁরা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণ লোপাট করতেই এসেছিলেন। যাঁরা মৃতদেহ চিরে মৃত্যুর কারণ খুঁজে বের করেন, তাঁরাই সবচেয়ে ভালো জানেন, কীভাবে সেই কারণকে মুছে দেওয়া যায়। আরও জানা যাচ্ছে, প্রথমে বাবা-মাকে ‘আত্মহত্যা’ বলে ডেকে পাঠানো হয়। জোর করে মৃতদেহ বের করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরকারি মদতে তাড়াতাড়ি দেহ পুড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে। এতগুলো অভিযোগ! অথচ কোনও অভিযুক্ত নেই?
আরও পড়ুন- ফাঁসি হলো না সঞ্জয় রায়ের! কেন আরজি কর ধর্ষণকাণ্ড বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা নয়?
উল্লেখ্য, আগে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে, এ ছাড়াও ধর্ষিতার সঙ্গে পুলিশ বা ডাক্তারের অসহযোগিতা নিয়ে বিশেষ ধারা ছিল ধর্ষণ আইনে। সে ধারায় শাস্তি পেয়েছিল বিলকিস বানো কাণ্ডের পুলিশ ও বিলকিসের ধর্ষণোত্তর মেডিক্যাল টেস্ট করা ডাক্তার। সেই সব ধারা নতুন ন্যায় সংহিতায় উধাও। তবু, ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ‘ক্রিমিনাল কনস্পিরেসি’ আর ‘ট্যাম্পারিং অফ এভিডেন্স’-এর জন্য তো ধারা আছে! তাহলে? আরও উল্লেখ্য, ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় ট্রান্স মানুষদের যৌন নির্যাতন থেকে সুরক্ষার জন্য তো যথেষ্ট আইনই নেই।
আমরা কি সঞ্জয়ের ফাঁসি হলে খুশি হতাম? শুনলাম, রাজ্য সরকার নাকি রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সঞ্জয়ের ফাঁসি চেয়ে আদালতে গেছে। এটা একদিকে গিমিক, অন্যদিকে অসচেতনতা। ধর্ষকের ফাঁসি নয়, ভারতে নারীসুরক্ষার জন্য যা দরকার, তা হলো শাস্তির নিশ্চয়তা। শাস্তির প্রাবল্যের চেয়ে জরুরি শাস্তির ধারাবাহিকতা। প্রতিজন ধর্ষক শাস্তি পাবে, প্রতিজন প্রমাণ লোপাটকারী শাস্তি পাবে— এই হলো মেয়েদের সামান্য দাবি। তার বদলে ঘটছে কী? একমাত্র সেই ধর্ষকদেরই শাস্তি হচ্ছে, যাদের তাবড় সব উকিল লড়িয়ে কেস জেতার ক্ষমতা নেই। বাসের চালক বা খালাসির বদলে যদি কোনও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিবর্গ নির্ভয়ার ধর্ষক হতো, তাহলে আদৌ শাস্তি হত কি না, তা নিয়ে সংশয় জাগাচ্ছে অভয়া মামলা। আর ধর্ষক বা প্রমাণ লোপাটকারীরা যদি সরকারের প্রসাদধন্য হয়? তাহলে তো কথাই নেই! তাই হাহাকারের মতো ধ্বনিত হচ্ছে মৃতার বাবা-মায়ের আর্তনাদ: "সন্তান যতই কৃতী হোক, মেধাবী হোক, বাবা-মা হিসেবে আমরা তো প্রভাবশালী নই, তাই মেয়েটা বিচার পেল না।" যে বাবা-মা সন্তান হারিয়েছেন, তাঁরা আমৃত্যু জানতেও পারবেন না, আপাত-নিরীহ, সাতে-পাঁচে না থাকা, কর্তব্যপরায়ণ, ডিউটিরত ডাক্তার মেয়েটার সঙ্গে সে রাতে কী হয়েছিল— এইটা ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়।
১৪ অগাস্টের রাত দখল করে যে নতুন লিঙ্গরাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার কী হবে? বিস্ফোরণ এক-আধবার ঘটে। ১৪ অগাস্ট ছিল বিস্ফোরণের রাত। মেয়ে, ট্রান্স ও ক্যুইয়ার মানুষদের জমে থাকা ক্ষোভে সেদিন ঘি পড়েছিল৷ তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পথে নেমেছিলেন কিন্তু ধিকিধিকি আগুন জ্বালিয়ে রাখা আন্দোকনকারীর কাজ, সংগঠকের কাজ৷
যাঁরা নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষের জনপরিসরে মর্যাদা ও অধিকার প্রশ্নহীনভাবে সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলাম, আর সেই কারণে ‘রাতদখলের’ ভাবনার সূত্রটি ধরেছিলাম, তাঁরা জানতাম, এই আন্দোলন থামতে দেওয়া হবে না অভয়ার ন্যায় বিচার ছিনিয়ে নেওয়ার পরেও৷ এখনও তো একজন অভয়াই সম্পূর্ণ বিচার পায়নি! সব অভয়াদের জন্য গণপরিসর সুরক্ষিত করা তো বাকি বটেই! তাই আন্দোলন থামানোর প্রশ্নই ওঠে না।
ভারতবর্ষে দৈনিক প্রায় আশিটি ধর্ষণ হয়। মানে, নথিভুক্ত ধর্ষণ৷ এছাড়া, ভারতে ধর্ষিতার প্রতি সামাজিক মনোভাব, নিপীড়িতাকে দোষারোপের প্রবণতা খতিয়ে দেখলে বোঝা কঠিন নয় যে, অনেক ধর্ষণ ধর্ষিতারা লজ্জায় ভয়ে নথিভুক্তই করেন না৷ এছাড়া আনাচে-কানাচে অহোরাত্র কত যে যৌন নির্যাতন ঘটে যাচ্ছে! তারা চরম পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে না বলে তাদের আমরা ‘ধর্ষণ’ বলছি না কিন্তু তাদের মধ্যেই আছে আগামী ধর্ষণের বীজ। এবার, এই নথিভুক্ত ধর্ষণগুলোর মধ্যেই শাস্তির হার মাত্র ২৭-২৮% (২০১৮-২০২২ সময়কালের এনসিআরবি রিপোর্ট অনুসারে)। প্রতিনিয়ত আমরা শুনি, ‘মেয়েদের পক্ষে আইন।’ কিন্তু আইনের বাস্তবায়ন? তার চিত্র ওই ২৭-২৮% -এ আটকে। আইনের বাস্তবায়ন আসলে পিতৃতান্ত্রিক রাষ্ট্রের হাতে। এই যদি হয় শাস্তির হার, তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে, ভারতে যৌন নির্যাতন করার সময় নির্যাতক প্রায় নিশ্চিত জানে যে ৭৫-৮০% ক্ষেত্রে তার কোনও শাস্তিই হবে না? এতে তার নির্যাতক প্রবণতাকে আস্কারাই দেওয়া হয়৷
আরও পড়ুন- রাত দখল শুধু শহুরে মেয়েদের? আজও ডাইনি সন্দেহে খুন হওয়া মহিলাদের কথা বলবে কে?
তারও পরে বাকি থাকে চেতনার বদল। ধর্ষণ-সংস্কৃতির খুঁটিনাটিকে বারবার প্রশ্ন করে যাওয়া। কেবল কিছু সচেতন ঘেরাটোপে ‘রেপ কালচার’, ‘রেপ রেটরিক’, ‘ভিক্টিম ব্লেমিং’ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা নয়, এ ভাবনার প্রসার ঘটানো সর্বত্র, সর্বস্তরে। আমাদের ঠিক এভাবেই ভাবতে বাধ্য করেছিল ১৪ অগাস্টের রাত। গৃহবধূর সঙ্গে ট্রান্স মেয়ের হাত মিলে যেতে দেখে, মেয়ে ডাক্তারের সঙ্গে মেয়ে মিড ডে মিল রাঁধুনির গলা স্লোগানে মিলতে দেখে, শাঁখা-পলার সঙ্গে হিজাবকে হাঁটতে দেখে, আমাদের মনে হয়েছিল— তাহলে নির্দিষ্ট ‘ঘেটো’-র বাইরে লিঙ্গরাজনীতি চর্চা সম্ভব! এটাই কি তার সময় নয়?
সেই পথ চলার একটি পদক্ষেপ হিসেবে আমরা আমাদের দাবি সনদ জমা দিয়েছি আইন দফতরে, যাকে আমরা ‘স্পর্ধার দাবি’ নামে ডেকেছি। আরেকটি পদক্ষেপ হিসেবে জীবনে প্রথমবার নারী আন্দোলনে বা যে কোনও আন্দোলনে আসা মেয়েদের শিখিয়ে দিতে চাইছি লিঙ্গরাজনীতি বিষয়ে আমরা যা জানি, আর শিখতে চাইছি তাদের অভিজ্ঞতা থেকে, যাকে ‘স্পর্ধার চিন্তন’ নামক কর্মশালা বলছি। আন্দোলন এখন বহতা নদী। ‘চরৈবেতি’ গেয়ে তার চলা সবে শুরু।
১৮ আর ২০ জানুয়ারির রায় কি আমাদের হতাশ করেছে? হতাশ হওয়ার বিলাসিতা এখন আমাদের মানায় না বলেই আমরা হতাশ নই। নাহলে তো হতাশার ১০৮ কারণ লিখে ফেলা যেত। আমরা, সাধারণ মেয়ে ও প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষরা মনে করছি, এই রায় আমাদের ক্ষেত্রে ভয়ানক সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি করবে। ধর্ষক ও প্রমাণ লোপাটকারীরা ভাববে, যৌননির্যাতনমূলক অপরাধ করে বা প্রমাণ লোপাট করে ছাড়া পাওয়াই স্বাভাবিক, সেটাই দস্তুর। রাষ্ট্রব্যবস্থা যখন ধর্ষককে আড়াল করে, তখন রাষ্ট্রই ধর্ষক হয়ে ওঠে। আবার তখনই লিঙ্গরাজনৈতিক আন্দোলনের আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠা সম্ভব। পিছোতে পিছোতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে, মানুষ তো ঘুরে দাঁড়াবেই।