ঘৃণা আর ভুয়ো খবরের দরজা খুলে দিলেন এলন মাস্ক? টুইটার কিনে আদতে যা চাইছেন তিনি
Elon Musk Twitter Deal: টাকার জোরে নীল টিক চিহ্ন পেয়ে, সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে ফেলে যদি প্রচলিত গণমাধ্যমে ভুয়ো খবর উঠে আসে এবং তা যদি মুখে মুখে বা মোবাইলের মাধ্যমে ছড়ায়, তার দায়িত্ব ধনকুবের এলন মাস্ক নেবেন তো?
“এই দেখো পেন্সিল, নোটবুক এ হাতে/ এই দেখো ভরা সব কিলবিল লেখাতে”
সুকুমার রায়ের এই পঙক্তিটিই এখন একমাত্র প্রযোজ্য, টুইটারের মালিকানা বদল কত দামে হয়েছে, তার হিসেব কষতে। ৪৪ লক্ষ বিলিয়ন ডলার মানে ভারতীয় মুদ্রায় কত টাকা হয় এবং তাতে ক’টা শূন্য বসাতে হবে, এই হিসেব যদি আমাকে কিংবা আপনাকে কষতে দেওয়া হয়, তাহলে মোটামুটি নাকের জলে চোখের জলে হওয়ার অবস্থাই হবে। কিন্তু নতুন মালিক এলন মাস্ক, নিশ্চিত আমাদের চেয়ে ভালো আঁক কষতে জানেন, না হলে টুইটার কেনার পর থেকেই তিনি কেন বলবেন, এই মুহূর্তে তাঁর কর্মী কমানোর প্রয়োজন! অতএব একটাই পন্থা- রাতারাতি কর্মী ছাঁটাই। সারা বিশ্বের নানান প্রান্ত সহ ভারতেও বহু কর্মীর হাতে ‘পিঙ্ক স্লিপ’ ধরানো হয়েছে। যদিও আবার শোনা যাচ্ছে, তিনি বরখাস্ত হওয়া কর্মীদের মধ্যে থেকে কাউকে কাউকে, তাঁর সংস্থায় ফিরে আসতে অনুরোধ করছেন। কিন্তু এরপরে যে তাঁর খামখেয়ালিপনার শিকার আবার তাঁরা হবেন না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?
বিশ্বের ধনীশ্রেষ্ঠ এলন মাস্ক নিজে একজন সফটওয়ার প্রযুক্তিবিদ হওয়ার সুবাদে একটা কথা খুব ভালো করেই বোঝেন যে, কীভাবে এই ধরনের একটি সংস্থার লভ্যাংশ বাড়াতে হয়। টুইটার কিনে প্রথমেই তিনি ঘোষণা করলেন, এবার নীল পাখিটা মুক্ত হলো! স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠল, তাহলে কি এতদিন নীল পাখি খাঁচায় বন্দি ছিল? যদি থেকে থাকে, তাহলে কে বা কারা তাকে বন্দি করে রেখেছিল? কী তাঁদের উদ্দেশ্য? এরপরেই তিনি আবার নিজের টুইটার প্রোফাইল থেকে ঘোষণা করেন, এখন থেকে আর কোনও ব্যবহারকারীকে আজীবনের জন্য নির্বাসিত হয়ে থাকতে হবে না। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায়, আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প, যাঁকে উস্কানিমূলক এবং উত্তেজনাপূর্ণ টুইট করার জন্য নির্বাসিত করা হয়েছিল, তাঁকে আবারও ফিরিয়ে আনার দাবি উঠতে শুরু করে।
আরও পড়ুন- যিশু ও মহম্মদ হিন্দু! সাধুদের উদ্ভট মন্তব্যের নেপথ্যে হিন্দু ধর্মের ভেতরের লড়াই?
এখানেই শেষ নয়, ভারতীয় ব্যবহারকারীদের মধ্যে অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাওয়াত, যিনি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য ‘বিখ্যাত’, যাঁকে নানান অভিযোগের ভিত্তিতে এতদিন নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল, তাঁকেও ফেরানোর দাবি উঠতে শুরু করে। তাহলে এই মুক্তির কথাই কি বোঝাতে চেয়েছেন টুইটারের নতুন মালিক? যার মধ্যে দিয়ে আবারও ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক বক্তব্য এবং ভুয়ো তথ্যের রমরমা হবে? তথ্য বলছে যে, ইতিমধ্যেই এই ধরনের বক্তব্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
এবার এলন মাস্ক বিজ্ঞাপনদাতাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, কোনও চিন্তা নেই নিশ্চিন্তে বিনিয়োগ করুন। নতুন রূপে টুইটার আরও বেশি বেশি করে বিজ্ঞাপনদাতাদের আকর্ষণ করার পদ্ধতি নেবে। কী করে সংস্থাকে লাভজনক করবেন, তারও একটা উপায় বাতলেছেন এই ধনকুবের। ভারতে যদিও টুইটার ব্যবহারকারীর সংখ্যা আনুমানিক ৪ কোটি এবং বিদেশেও খুব কম সংখ্যক মানুষই এই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করেন নিয়মিত কিন্তু এলন মাস্ক এটা জানেন, সারা বিশ্বের মতামতকে প্রভাবিত করতে পারে এই মাধ্যমটি। তাই তিনি একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন, এখন থেকে যাঁরা নীল টিক চিহ্ন দেওয়া অর্থাৎ আসল ব্যবহারকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে চাইবেন, তার জন্য তাঁদের মাসে বিশ ডলার দিতে হবে। পরে অবশ্য তাঁর মনে হয়েছে, সব দেশের মানুষের যেহেতু ক্রয়ক্ষমতা সমান নয়, তাই এই প্রক্রিয়ার জন্য বিশ ডলার নয়, মাসে আট ডলার দিতে হবে।
একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর সঙ্গে এই নীল টিক চিহ্নিত ব্যবহারকারীর তফাত কী? রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে রুপোলি পর্দার মানুষজন কিংবা সাংবাদিকরা বেশিরভাগই এই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন। একজন সাধারণ ব্যবহারকারী থেকে শুরু করে আজকের গণমাধ্যম সবার নজর থাকে এই নীল টিক চিহ্ন দেওয়া মানুষজন কী বলছেন তার উপরে। সেইখান থেকেই মূলত খবর সংগ্রহ হয়। এখন যে পদ্ধতির কথা এলন মাস্ক প্রস্তাব করেছেন, তাতে কী সুবিধা অসুবিধা তা বুঝে নেওয়া জরুরি। আমরা সবাই জানি, নির্বাচনী বন্ডের দৌলতে এই মুহূর্তে ভারতের শাসকদল বিজেপি সবচাইতে ধনী দল। তারা সোজাসুজি হোক বা অন্যভাবে সমস্ত ধরনের সামাজিক মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু টুইটার বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম থেকেই সমাজের মতামত সংগঠিত হয়, তাই দল যদি চায়, ইচ্ছে করলেই বেশ কিছু নীল টিক চিহ্ন দেওয়া ব্যবহারকারী বাড়িয়ে নিতে পারে। তারপর সেই ব্যবহারকারীরা যদি ভুল তথ্য এবং ধর্মীয় উস্কানিমূলক টুইট করেন, সেই টুইট যদি একজন সাধারণ ব্যবহারকারী দেখেন, তাহলে আরও সহজে তিনি প্রভাবিত হতে পারেন। প্রচলিত গণমাধ্যমগুলোও যদি এই ধরনের ব্যবহারকারীর বিষয়বস্তু দেখে প্রভাবিত হয়ে খবর করে, তাহলে সমস্যা বাড়বে বৈ কমবে কি? তখন কি অল্ট নিউজের মতো স্বাধীন তথ্য অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠানদের পক্ষে সম্ভব হবে খবরের সত্যতা যাচাই করবার?
এলন মাস্ক টুইটারের মালিক হয়ে তাহলে তো এই ভুয়ো খবর বন্ধ করার পরিবর্তে আরও বেশি করে দরজা খুলে দিলেন যাতে ঘৃণা ও ব্যক্তিকুৎসা বৃদ্ধি পায়। তিনি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধনী ব্যক্তি হতে পারেন কিন্তু তাঁর তো কিছু দায়িত্ব থাকার কথা। তাঁর খামখেয়ালিপনার শিকার অসংখ্য সাধারণ মানুষ হবেন না তো? এখনও কিন্তু প্রচলিত গণমাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস আছে। টাকার জোরে নীল টিক চিহ্ন পেয়ে, সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করে ফেলে যদি প্রচলিত গণমাধ্যমে ভুয়ো খবর উঠে আসে এবং তা যদি মুখে মুখে বা মোবাইলের মাধ্যমে ছড়ায়, তার দায়িত্ব ধনকুবের এলন মাস্ক নেবেন তো?
আরও পড়ুন- হাহাকার, মৃত্যু, কান্না! ফিরে দেখা নোটবন্দির বিভীষিকাময় দিনগুলো
এমনিতেই আমাদের দেশের সরকার বিরোধী কণ্ঠ বন্ধ করতে চাইছে, আইন আনছে যাতে এই ধরনের সামাজিক মাধ্যমগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সেই প্রক্রিয়াতে যদি তারা অসফল হয়, তাহলে তারা মিথ্যে বা ভুয়ো খবর ছড়িয়ে বিষয়কে আরও গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা যে করবে না, তা কি নিশ্চিত করে বলা যায়? অবশ্য আরও অনেক কিছু পরিবর্তন হয়তো এলন মাস্ক আনবেন আগামী দিনে। ততদিন আমাদেরও নজর থাকবে ওই দিকে কিন্তু এই মুহূর্তে সমস্যা যে ক্রমশ জটিল হচ্ছে, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
শেষ করা যাক, একজন টুইটারের কর্মীর অভিজ্ঞতা লিখে। আকাশ রায়না ভারতের একজন কর্মী ছিলেন, যাঁর কাজ ছিল ব্যবহারকারীদের বিষয়বস্তুর দিকে নজর রাখা। তাঁর রাতারাতি চাকরি যাওয়ার পরে, তিনি একটি টুইট করেন যে, তাঁর চাকরি গেছে। অনেকেই সেই বক্তব্যটি শেয়ার করা শুরু করেন। পরদিন দেখা যায়, টুইটার তাঁর অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করে দিয়েছে। আসলে কোনও মালিকই নিজের সংস্থার বিরুদ্ধে কথা শুনতে চান না, তা সে চটকল মালিকই হন বা আজকের নজরদারির সাম্রাজ্যবাদের জনকরাই হন। এলন মাস্ক যখন ব্যক্তি মানুষের বক্তব্য রাখার অধিকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার কথা বলেন, তিনি নিজের দিকটাই দেখেন। অন্য মানুষ যে তাঁর জন্য অসুবিধায় পড়তে পারেন, সে কথা তাঁর মাথায় থাকে কি?