চরিত্র বিচার করার অধিকার সমাজ পেল কোথা থেকে?

Character of a women: মেয়ে সন্তান জন্মালেই তাঁকে মেরে ফেলা, বাল্য বিবাহের মতো উদাহরণ তো বাস্তব বটেই; কিন্তু তার সঙ্গে-সঙ্গেই চলে প্রতিটি মুহূর্তে এক অদৃশ্য সার্টিফিকেট প্রদান; কিসের?

সমাজের বহুক্ষেত্রেই আমরা কিছু অলিখিত নিয়ম খুঁজে পাবো। এই প্রত্যেকটিই শ্রুতি তথ্য হিসেবে আমাদের জীবনে প্রদান করা হয়। চুরি করা মহাপাপ, কখনও মিথ্যে কথা বলতে নেই, গুরুজনদের (অর্থাৎ বড়দের) শ্রদ্ধা করতে হয়, ইত্যাদি। এরকম কিছু নিয়ম মহিলাদের ক্ষেত্রেও বানানো হয়েছে - শুধু তফাৎটা হচ্ছে যে সেগুলির সবকটিই তাঁদের "হাতের মুঠোয়" রাখার জন্য।

একজন মেয়ে জন্ম নেওয়ার পর থেকেই এত ধরণের পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, যে ক্লান্তি বা রাগ হওয়া খুবই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হয়ে ওঠে; কিন্তু আসলে এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে, অর্থাৎ পুরুষই হর্তা-কর্তা-বিধাতা মানা মানবকুলে, মহিলারা এখনও 'মানুষ' হিসেবে পরিচিতি পেয়ে ওঠেননি কিনা, তাই এই প্রতিক্রিয়াগুলি তাঁদের ক্ষেত্রে 'অশ্লীলতার' নিদর্শন।

মেয়ে সন্তান জন্মালেই তাঁকে মেরে ফেলা, বাল্য বিবাহের মতো উদাহরণ তো বাস্তব বটেই; কিন্তু তার সঙ্গে-সঙ্গেই চলে প্রতিটি মুহূর্তে এক অদৃশ্য সার্টিফিকেট প্রদান; কিসের? ওই যে, ক্যারেক্টারের অর্থাৎ চরিত্রের।

আরও পড়ুন- অনুপর্ণাকে নিয়ে কেন চুপ মেইনস্ট্রিম মিডিয়া?

আগের বছরের রাত দখল আন্দোলনের সময়ে বহু স্বর উঠেছিলো এই ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটের মাপকাঠির বিরুদ্ধে। এক মেয়ে কখন বাড়ি ঢুকছে, কাদের সঙ্গে কথা বলছে, কতক্ষণ কী কী কাজ করছে, চাকরি করছে কিনা, ঝগড়া করছে কিনা, মুখ নামিয়ে চোখ বুজে চলাফেরা করছে কিনা, আর সবথেকে আগে যেটা দেখেই প্রথম টিক মার্কটা পড়ে- সেটা হলো কোন পোশাক পরে সে বিচরণ করায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে।

ভারতের মতো দেশে, নানান সম্প্রদায়, নানান খাবার, নানান রীতিনীতি, নানান বেশভূষা রয়েছে- মহিলাদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু শাড়ি যদি বাদ গেছে তো এক মহিলা ভারতীয় হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বেন। কিছু কিছু "খোলামনের" মানুষ রয়েছেন অবশ্য, যাঁরা সালওয়ার কামিজকে খানিক জায়গা করে দিয়েছেন, কিন্তু ওইটুকুই। বাকি পোশাকগুলো এখনও পিতৃতন্ত্রের অল ইন্ডিয়া এক্সাম ক্লিয়ার করতে পারেনি।

নিছক যদি ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রবণতা থাকতো, তাহলে হয়ত কালে কষ্মীনে সেটি নির্মূল করে দেওয়াও যেতো; কিন্তু এর ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে মহিলাদের উপর যে কোনো অপরাধ ঘটলে প্রথমেই তিনি কী পরেছিলেন সেটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করা। এমনকি, পোশাকটি বিশ্লেষকদের মনঃপূত না হলে সেই ঘটনাকে স্বীকৃতি দেওয়া, অবশ্যম্ভাবী ব্যক্ত করা।

আরও পড়ুন- অনুষ্কা কী পরবেন! কে ঠিক করবেন?

কাজ করতে গিয়ে শুনেছি, "ছোট ছোট জামা পড়লে তো ওরকম হবেই"; "আজকালকার মহিলারাও খুব বাড় বেড়েছে বলুন? ওই গুলো জামা?!"; "যাই বলুন, মহিলারা হচ্ছেন ঘরের লক্ষ্মী, এরকম পোশাক পরলে পরিবারের মানসম্মান নষ্ট হয় না?"- এরকম আরও কত কিছু।

আচ্ছা, বলুন তো, পোশাকই যদি মূল কারণগুলির একটি হতো, তাহলে একটি ৩ মাসের বাচ্চা বা এক ৯০ বছরের বৃদ্ধা ধর্ষিত হচ্ছেন কেন? বেশিরভাগ মহিলাদের নির্যাতনের ঘটনাগুলি চেনা/পারিবারিক/বন্ধুমহলের মানুষদের থেকে কেন সহ্য করতে হচ্ছে? কেন স্কুলে ধর্ষিত হতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের? কেন কর্মস্থলে নির্যাতিত হচ্ছেন মহিলারা?

অনুষ্কা শঙ্করের বিকিনি থেকে শুরু করে অনুপর্ণা রায়ের শাড়ি- আপনি যদি তাঁদের জীবনের মূল্য তাঁদের পোশাক দিয়ে বিচার করার কথা আগে ভাবেন, তাহলে নিজেকে এই কয়েকটি প্রশ্ন করে নেবেন; উত্তর যদি পোশাক না হয়, তাহলে শপথ নেবেন, যেমন আপনি কী পোশাক পরবেন সেটি বিচার করার স্বাধীনতা আপনার রয়েছে, সেরকমই যে কোনো মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য।

নির্যাতন ঘটে মানসিকতার কারণে এবং এই ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দেওয়ার প্রবণতাও তার একটি অংশ।

More Articles