দুর্নীতি-অসততা নিয়ে সতর্ক করেন যাঁরা, এদেশে শাস্তি পান তাঁরাই!
Whistleblower's Protection: হুইসেলব্লোয়ার'স প্রোটেকশন অ্যাক্ট এবং ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আসলে পরস্পরবিরোধী। “সরকার তথ্য গোপন রাখার জন্য অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের উপর নির্ভর করে কারণ 'তথ্যই শক্তি'।
২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে, টাটা মোটরস ইন্স্যুরেন্স ব্রোকিং অ্যান্ড অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের (TMIBASL) কলকাতার সিনিয়র ম্যানেজার পীযূষ কান্তি রায় হঠাৎ আবিষ্কার করেন যে, তাঁর কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (CEO), তরুণ কুমার সামন্তকে উত্তরপ্রদেশের মিরাটের চৌধুরী চরণ সিং বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভুয়ো ডিগ্রির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়েছে। ভারতীয় বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (IRDAI) কর্তৃক প্রণীত নিয়ম অনুসারে, TMIBASL-এর মতো একটি বীমা ব্রোকারিং ফার্মের 'প্রিন্সিপাল অফিসার’-এর স্নাতক হওয়া বাধ্যতামূলক।
পীযূষ কান্তি রায় কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং তারপর টাটা গ্রুপের প্রধান সাইরাস মিস্ত্রি এবং রতন টাটাকে মেল করে বিষয়টি জানান (সেই মেলের প্রমাণ লেখকদের কাছে রয়েছে।)। ২০১৬ সালের ৫ অগাস্ট, 'অবাধ্যতার' কারণে পীযূষ কান্তি রায়কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তিনি তাঁর অভিযোগের আইনি প্রতিকার চেয়েছিলেন। অথচ প্রতিকারের বদলে নিয়োগকর্তার প্রতিশোধ স্পৃহার শিকার হয়ে গেলেন।
২০১৮ সালের মে মাসে, TMIBASL-এর প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (CFO) ভানু শর্মা পীযূষ কান্তি রায়ের বিরুদ্ধে সাইবার-জালিয়াতির অভিযোগ এনে দাবি করেন যে, তিনি আসলে তরুণ কুমার সামন্তের সুনাম নষ্ট করার জন্য ভুয়ো মেল আইডি তৈরি করেছিলেন। ২০১৮ সালের ২১ মে পীযূষ কান্তি রায়কে গ্রেফতার করা হয় এবং ৫১ দিনের জন্য জেলে পাঠানো হয়।
একাধিক মেলে পীযূষ কান্তি রায় বারেবারেই নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং যুক্তি দেন যে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলি সর্বার্থেই 'মনগড়া' কারণ তিনি তাঁর প্রাক্তন বসের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। আমরা তরুণ কুমার সামন্তের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। তিনি এখন একটি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া আউটসোর্সিং (BPO) কোম্পানির উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য।
এই প্রতিবেদনের একজন লেখকের সঙ্গে ফোনে কথোপকথন হয় তাঁর। তরুণ কুমার সামন্ত এই সম্পর্কে কোনও মন্তব্যই করতে চাননি। ইংরেজিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরেও, হোয়াটসঅ্যাপে তাঁকে পাঠানো প্রশ্নাবলীর কোনওটিরই উত্তর তিনি এখনও দেননি।
টাটা গ্রুপের প্রধানদের কাছে পাঠানো মেলে পীযূষ কান্তি রায় অভিযোগ করেছিলেন যে, তাঁর বিরুদ্ধে আনা 'মিথ্যা অভিযোগ’-এর কারণে তিনি এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা 'মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন' এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন, কলকাতা, মুম্বই, দিল্লি এবং উত্তরাখণ্ডের রুরকি আদালতে চলা আইনি মামলার কারণে তিনি দেউলিয়া হয়ে গেছেন। পীযূষ কান্তি রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে, তিনিও বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলি বিচারাধীন এবং তিনি এই নিয়ে আমাদের কিছু বলতে চান না।
TMIBASL থেকে পীযূষ কান্তি রায়কে বরখাস্ত করার এক বছর পর, ২০১৭ সালের মে মাসে, ভারতীয় বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (IRDAI) নিশ্চিত করে যে তরুণ কুমার সামন্তের ডিগ্রি অবৈধ এবং তাঁকে অবিলম্বে কোম্পানি থেকে অপসারণের নির্দেশ দেয়।
২০২৫ সালের ১৫ মে, আমরা টাটা মোটরস ইন্স্যুরেন্স ব্রোকিং অ্যান্ড অ্যাডভাইজরি সার্ভিসেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এম রবিচন্দ্রনকে একটি বিস্তারিত প্রশ্নপত্র মেল করেছিলাম। এরও কোনও উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন- বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার! দুর্ঘটনাগ্রস্থ বিমানটি আদৌ যাত্রী পরিবহণের যোগ্য ছিল?
হুইসেলব্লোয়ারদের শাস্তি দেওয়া
পীযূষ কান্তি রায়ের ঘটনাটি ভারতের বিশিষ্ট কোম্পানিগুলির হুইসেলব্লোয়ারদের কাছ থেকে পাওয়া তিনটি ঘটনার মধ্যে একটি যা নিয়ে আমরা তদন্ত করেছি। এই গল্পগুলি থেকে ক্রমেই প্রকাশ হয়ে যায় যে, সংশোধন করার জন্য ব্যবহৃত কর্পোরেট সিস্টেম আদতে অসদাচরণ ফাঁস করে দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় — আর আইন এর কোনও সুরক্ষাই দেয় না।
তিনটি গল্প কর্পোরেট ভারতের একটি অদ্ভুত প্রবণতার ছবি তুলে ধরছে। প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, দুর্নীতি ফাঁসকারী হুইসেলব্লোয়াররাই শাস্তি পাচ্ছেন, অথচ দোষীদের কোনও শাস্তিই হচ্ছে না।
দেখা গেছে, তিনজনই সেই সংস্থাগুলির দুর্নীতি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন যেখানে তাঁরা কাজ করতেন। ফলস্বরূপ হয় তাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছে বা শাস্তিমূলক বদলির নির্দেশ এসেছে, আইনি হয়রানি হয়েছে এবং সম্মানহানি তো হয়েইছে। অথচ বিশ্বজুড়ে এবং ভারতে তো অবশ্যই, হুইসেলব্লোয়াররাই কর্পোরেট অপকর্ম প্রকাশ এবং প্রাতিষ্ঠানিক অখণ্ডতা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
দ্য ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, ২০২৫ সালের ১৫ মে, ইন্ডাসইন্ড ব্যাংক পূর্বের কিছু হিসেব সংক্রান্ত গোলযোগের অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করেছে। একজন হুইসেলব্লোয়ার ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক এবং ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে একটি চিঠি পাঠিয়ে প্রথম বিষয়টি নিয়ে অবহিত করেছিলেন।
ওই হুইসেলব্লোয়ার ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ থেকে সুদের আয় গণনায় ত্রুটি, একজন ঊর্ধ্বতন কার্যনির্বাহী এবং একজন কর্মচারীর মধ্যে অনুপযুক্ত সম্পর্ক, সুদের আয়ে ৬০০ কোটি টাকার অসঙ্গতির অভিযোগ তুলে ধরে দাবি করেন যে ব্যাংক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের আয় বৃদ্ধি করেছে। ইন্ডাসইন্ড ব্যাংকের ওই হুইসেলব্লোয়ারের অভিযোগের ভিত্তিতে এখন ফরেনসিক অডিটর এবং অন্যান্য সংস্থাগুলি তদন্ত করছে।
সততা বজায় রাখার জন্য এবং দুর্নীতি প্রকাশের জন্য প্রশংসিত হওয়ার বদলে, ভারতীয় হুইসেলব্লোয়ারদের অনেকেই প্রতিশোধস্পৃহা, আইনি হেনস্থার মুখোমুখি হন এবং পেশাগত জীবনও তাঁদের তছনছ হয়ে যায়।
জালিয়াতির সত্যতা
বরখাস্ত হওয়ার নয় বছর পর, পীযূষ কান্তি রায়ের মামলাটি ২০১৯ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনে (সিআইসি) পৌঁছয়। TMIBASL-এর প্রাক্তন কর্মচারী বিকাশ নারায়ণ তরুণ কুমার সামন্তের শিক্ষাগত ডিগ্রির বৈধতা সম্পর্কে স্পষ্টতা চেয়ে আদালতে আপিল করেন।
IRDAI-এর কাছে তথ্য জানার অধিকার (আরটিআই) আইনের অধীনে দায়ের করা একটি প্রশ্নের মাধ্যমে স্বচ্ছ তথ্য পেতে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছিল বিকাশ নারায়ণকে, তারপর তিনি সিআইসির কাছে আবেদন করেন। পীযূষ কান্তি রায়কে পুনর্বহাল করার পরিবর্তে, TMIBASL এবং তরুণ কুমার সামন্ত বম্বে হাইকোর্টে পীযূষ কান্তির বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা দায়ের করেন। বলা বাহুল্য, পীযূষ কান্তির আইনি লড়াই আরও তীব্র হয়। তাঁর জামিন বাতিলের শুনানি বারবার স্থগিত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে নিত্য নতুন মামলা দায়ের করা হয়, যার মধ্যে একটি মামলা এমনও ছিল যেখানে তরুণ কুমার সামন্ত দাবি করেন যে পীযূষকান্তি তাঁকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, TMIBASL পীযূষ কান্তি রায়কে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার সাত বছরেরও বেশি সময় পরে এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল। সাইরাস মিস্ত্রি এবং টাটাকে লেখা মেলে পীযূষ কান্তি স্পষ্ট দাবি করেছেন যে এই সমস্ত অভিযোগই "ভিত্তিহীন এবং প্রতিশোধমূলক"।
তরুণ কুমার সামন্ত উত্তরাখণ্ডের রুরকিতে পীযূষ কান্তি রায়ের বিরুদ্ধে একটি নতুন মানহানির মামলাও দায়ের করেন। গত ১৫ মে, সুপ্রিম কোর্ট পীযূষ কান্তির আইনজীবীর আবেদন গ্রহণ করে মামলাটি রুরকি থেকে কলকাতায় স্থানান্তরের অনুরোধ করে, যেখানে পীযূষ কান্তি নিজে থাকেন এবং যেখানে তিনি TMIBASL-এ কর্মরত থাকাকালীন কাজ করতেন।
এই প্রতিবেদনের কাজে নেমে আমরা জানতে পারি, পীযূষ কান্তি রায় এবং তাঁর স্ত্রী প্রয়াত রতন টাটা, তাঁর উত্তরসূরি তথা টাটা সন্সের চেয়ারম্যান নটরাজন চন্দ্রশেখরন এবং অন্যান্যদের প্রায় প্রতিদিন মেল করতেন। কীভাবে মামলায় জেরবার হয়ে আর্থিকভাবে তাঁরা ভেঙে পড়েছেন, কীভাবে সারা পরিবার তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করছে, সবটা ওই মেলগুলিতে লিখতেন তাঁরা।
আরও পড়ুন- দুর্নীতি ঢাকতেই যুদ্ধবিরতি ভেঙে আবার গাজায় আক্রমণ নেতানিয়াহুর?
‘জাতীয় নিরাপত্তা’: একটি আইনের হত্যা
২০১১ সালের হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা আইনটি চালু হয়েছিল, যাতে সরকারি কর্মচারীরা সংঘটিত দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার বা ফৌজদারি অপরাধের কথা জানাতে পারেন, যাতে তাঁরা সুরক্ষিত থাকেন এবং যেন তাঁদের নিশানা না করা হয়।
২০১০ সালের ২৬ অগাস্ট লোকসভায় বিল হিসেবে উত্থাপিত হওয়ার চার মাস পর, ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর সংসদের নিম্নকক্ষ এবং ২০১৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উচ্চকক্ষ, রাজ্যসভায় এটি পাস হয়। ২০১৪ সালের ৯ মে ভারতের রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের তিনদিন পরে তা নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। এই আইনের লক্ষ্য কেবল তথ্য ফাঁসকারীদের পরিচয় রক্ষা করাই নয়, তাঁদের নানা নির্যাতন থেকে রক্ষা করাও। অন্যদিকে, যারা জেনেশুনে মিথ্যা বা তুচ্ছ অভিযোগ করছেন তাঁদের জন্য শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছিল। আইনটি কার্যকর করা সত্ত্বেও, তার প্রযোগ হয়নি। আইনটি বাস্তবে প্রয়োগ এবং কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মগুলিই কার্যকর করা হয়নি।
২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, সরকার দেশের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতাকে প্রভাবিত করে এমন বিষয় থেকে সুরক্ষার জন্য সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়। এই উদ্বেগগুলি সমাধানের লক্ষ্যে, হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা (সংশোধন) বিল, ২০১৫ লোকসভায় পেশ এবং পাস করা হয় ২০১৫ সালের ১৩ মে।
সেই আইন, যা ব্যবহার করা যাবে না
নতুন বিলটিতে রাজ্যের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা এবং 'অর্থনৈতিক স্বার্থ' সম্পর্কিত তথ্য সহ ১০ ধরনের তথ্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের মে মাসে ১৬তম লোকসভা ভেঙে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলটি বাতিল হয়ে যায় এবং তারপর থেকে এটি আর চালু করাই হয়নি। অর্থাৎ হুইসেলব্লোয়ার সুরক্ষা আইন, ২০১৪, কার্যকরী নয়।
সরকার জানিয়েছে যে, আইনের সংশোধনী বর্তমান আইনসভার কর্মসূচির অংশ ছিল না। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে, কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং উল্লেখ করেছিলেন যে "ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা, রাজ্যের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করে এমন তথ্য প্রকাশ থেকে রক্ষা করার লক্ষ্যে" আইনটির বর্তমান আকারে সংশোধনের প্রয়োজন আছে। এই আইনটি কার্যকর করতে এত দেরি করার পরিণতি কী হতে পারে সেই সম্পর্কে আন্দোলনকারীরা ২০১৯ সালেই এই সত্যটি তুলে ধরেছিলেন যে, দুর্নীতি প্রকাশ করার সময় অনেকেই প্রাণনাশের হুমকি পান, অনেকে নিহতও হন। আন্দোলনকারীরা বরাবরই হুইসেলব্লোয়ারদের জন্য আইনি সুরক্ষার জরুরি প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। আর দেরি না করে আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়েছেন, বারেবারে তাঁরা যুক্তি দিয়েছেন যে বাকি থাকা সংশোধনীগুলি এই আইনের প্রয়োগে কোনও বাধাই দেবে না।
সত্যেন্দ্র দুবের গল্প
ভারতের জাতীয় মহাসড়ক কর্তৃপক্ষে কাজ করতেন ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্র দুবে। ২০০৩ সালের ২৭ নভেম্বর, তাঁর ৩০তম জন্মদিনে বিহারের গয়াতে তাঁকে হত্যা করা হয়। ছয় বছরেরও বেশি সময় পর, সিবিআই-এর তদন্তের ভিত্তিতে পটনা হাইকোর্ট তিনজনকে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেয়।
সত্যিই ডাকাতির চেষ্টায় বাধা দিতে গিয়ে সত্যেন্দ্র দুবেকে মারা যেতে হয়েছিল কিনা তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিচার চলাকালীন বেশ কয়েকজন সাক্ষী মারা যান, অনেকে নিখোঁজ হন। অনেকেই অভিযোগ করেছেন যে, ভাড়াটে খুনিরা আসলে দুর্নীতিবাজ ঠিকাদারদের নির্দেশেই এই কাজ করছিল। ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কিছু তথ্য ফাঁস করেছিলেন সত্যেন্দ্র দুবে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালের আইনটি যখন সংসদে পাস হয়েছিল তখন ভারতীয় জনতা পার্টি প্রধান বিরোধী দল। সতর্ক নাগরিক সংগঠনের সমন্বয়ক অমৃতা জোহরি বলেছেন, এই আইনটি "ভারতের ১.৪৫ বিলিয়ন মানুষের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যারা আরটিআই কাঠামোর আওতায় পড়ছেন। ২০১৪ সালের আইনের পরিধি কেবলমাত্র সরকারি খাতেই সীমাবদ্ধ। এতে বেসরকারি এবং কর্পোরেট ক্ষেত্রের উল্লেখ নেই, শুধুমাত্র তখনই বেসরকারি ক্ষেত্রের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অনুমতি রয়েছে, যখন কোনও সরকারি কর্মচারীর সঙ্গে ঘুষ বা অন্য কোনও ফৌজদারি অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে।”
দেরি করা মানেই অস্বীকার করা
অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মসের (এডিআর) সহ-প্রতিষ্ঠাতা জগদীপ এস ছোকর কেন আইনটি বাস্তবায়িত হয়নি, তার একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলছেন, "বর্তমান সরকার এবং পূর্ববর্তী কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন সরকার দুই-ই সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করার জন্য নিয়ম তৈরি করতে অনিচ্ছুক ছিল। তারা এটা এড়াতে চায়। ফলস্বরূপ, সংসদে পাস হওয়া সত্ত্বেও, আইনটির কোনও আনুষ্ঠানিক কাঠামো নেই এবং এটি কার্যকরীও হয়নি।”
প্রাক্তন সরকারি কর্মচারী এবং অধ্যাপক জগদীপ এস ছোকর আরও বলছেন, “জনসাধারণ এবং নাগরিক সমাজের চাপে আরটিআই (তথ্য জানার অধিকার) আইনের মতো একটি স্বচ্ছতা বিষয়ক আইন পাস করা হয়। কিন্তু তারপরে তথ্য কমিশনার নিয়োগ না করে, তাদের মর্যাদা হ্রাস করে এবং পদ্ধতিগত নানা বাধা তৈরি করে এই আইনটিও দুর্বল করে দেওয়া হয়।”
তিনি বলছেন, হুইসেলব্লোয়ার'স প্রোটেকশন অ্যাক্ট এবং ১৯২৩ সালের অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট আসলে পরস্পরবিরোধী। “সরকার তথ্য গোপন রাখার জন্য অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের উপর নির্ভর করে কারণ 'তথ্যই শক্তি'। এদিকে হুইসেলব্লোয়িং বলতে এমন তথ্য প্রকাশ করা বোঝায় যা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা গোপন রাখতেই পছন্দ করেন,” বলছেন জগদীপ এস ছোকর।
ছোকর বলছেন, বেসরকারি কোম্পানিগুলিতে, শেয়ারহোল্ডাররাই কিন্তু প্রকৃত মালিক এবং তাঁদের বিষয়টি নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকার অধিকার আছে। “অথচ বাস্তবে, কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার আড়ালে প্রায়শই অবৈধ বা অনৈতিক কাজ করা হয়। বিবেকসম্পন্ন কোনও কর্মচারী এই ধরনের অন্যায় প্রকাশ করার চেষ্টা করলে সাধারণত তাদের বহিষ্কার করা হয় অথবা জড়িত দুর্নীতিগ্রস্তরা তাঁদের নানাভাবে হেনস্থা করার টার্গেট করে ফেলেন,” বলছেন ছোকর। তবুও, বেসরকারি সংস্থাগুলিতে, বিশেষ করে বেসরকারি কর্পোরেট সংস্থাগুলিতে তথ্য ফাঁসকারীদের আইনগত সুরক্ষা দেওয়ার কোনও ব্যবস্থাই নেই।
আরও পড়ুন- অরবিন্দ কেজরিওয়াল: আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত না কি ষড়যন্ত্রের শিকার?
ক্যান ফিন হোমস বনাম হুইসেলব্লোয়ার কে
ভারত সরকার নিয়ন্ত্রিত হাউজিং ফাইন্যান্স কোম্পানি ক্যান ফিন হোমসে, একজন হুইসেলব্লোয়ার, ধরা যাক তাঁর নাম কে, দাবি করেন যে তিনি একজন সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার পরিচালিত নিয়োগে বেনিয়ম ফাঁস করেছেন। এই ব্যক্তির নাম আপাতত গোপন রাখছি কারণ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনও আদালতে প্রমাণিত হয়নি। ২০২৪ সালের এপ্রিলে, কে ছিলেন মানব সম্পদ বিভাগের চিফ ম্যানেজার - এক বছর পরেই তাঁর এই এইচআর বিভাগের প্রধান হওয়ার কথা ছিল।
তবে, তেমনটা ঘটেনি।
পরের মাসে (মে, ২০২৪), কে আমাদের জানান, তিনি এমন কিছু নথিপত্র পেয়েছেন যাতে দেখা যাচ্ছে নিয়োগে কারচুপি করা হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, কোম্পানিতে চাকরির জন্য আবেদনকারী নির্দিষ্ট প্রার্থীদের পক্ষ নেওয়ার জন্য 'জোর' করা হয়েছে তাঁর অধস্তন কর্মীদের।
২০২৪ সালের ২৯ মে, কে প্রথমে ক্যান ফিন হোমসের এইচআর প্রধানের কাছে অভিযোগ করেন। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই তাঁর দাবি। তিনি আরও কয়েকটি অভিযোগ করেন। জুলাই মাসে, এইচআর বিভাগের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) পদে পদোন্নতি হয় কে-এর। তিনি বলেছেন, নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উপেক্ষা করা নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন।
এই বছরের ১৫ মে, আমরা কোম্পানির আনুষ্ঠানিক মুখপাত্রকে একটি প্রশ্নপত্র মেল করি। ২৩ মে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুখপাত্র কে-এর অভিযোগ অস্বীকার করেন। ওই মুখপাত্রের দাবি, ক্যান ফিন হোমস স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং পদ্ধতি এবং নির্দেশিকা অনুসরণ করেই নিয়োগ করে। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং ন্যায্য, তাতে কোনও ফাঁকফোঁকর খুঁজে পাওয়া যায়নি। কে-এর অভিযোগগুলিকে 'অপ্রমাণিত' এবং 'সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন' বলে উড়িয়ে দেন ওই মুখপাত্র।
প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ
২০২৪ সালের ২৩ এবং ২৪ অগাস্ট, কে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সুরেশ শ্রীনিবাসন আইয়ারের কাছে তাঁর অভিযোগগুলি জানান। কে-এর দাবি, তিনি কোম্পানির এইচআর বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই অভিযোগ করেছিলেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন ম্যানেজার আরতি শেঠি এবং ডেপুটি ম্যানেজার শ্যাম সুন্দর।
এর দুই দিন পরে, ২৬ তারিখ, দুপুর ২.২১ মিনিটে, কে ক্যান ফিন হোমসের এমডি এবং ডেপুটি এমডি বিক্রম সাহাকে একটি মেল পাঠান। এর ঠিক চার ঘণ্টা পরেই নাকি তাঁর বিরুদ্ধে 'প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ' করা হয় বলে দাবি কে-এর।
গত ৩০ অক্টোবর, কে কোম্পানির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান অরবিন্দ নারায়ণ ইয়েনেমাদির কাছেও নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ জানান। চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি, এনডিটিভি প্রফিটের ওয়েবসাইটের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কে-এর অভিযোগগুলি সত্য। হিন্দি এবং ইংরেজিতেও সেই লেখাটি প্রকাশ হয়য়। একজন বিখ্যাত বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কলামিস্টও কে-এর এই অভিযোগ সম্পর্কে প্রতিবেদন লেখেন।
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত, ক্যান ফিন হোমস কানাড়া ব্যাংক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, কোম্পানিতে ৩০% অংশীদারিত্ব রয়েছে কানাড়া ব্যাংকের। বাকি ৭০% শেয়ার দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং সাধারণ জনগণের হাতে আছে। হাউজিং ফাইন্যান্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে এর মূল প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আধিপত্য রয়েছে, যার মধ্যে আছেন কানাড়া ব্যাংকের এমডি, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, জেনারেল ম্যানেজার এবং ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজারও। ব্যাংকের এমডি-ই হচ্ছেন ক্যান ফিন হোমসের চেয়ারম্যান।
কানাড়া ব্যাংক এবং এর হাউজিং ফাইন্যান্স শাখার মালিকানার চরিত্র এবং কে-এর নিয়োগে দুর্নীতির দাবিটি ধীরে ধীরে জনস্বার্থের বিষয় হয়ে ওঠে। কে আমাদের বলেছেন, ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংক, ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাংক, কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক, কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক এবং সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন সহ নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি তাঁর অভিযোগ সম্পর্কে অবগত ছিল।
‘সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ’: কোম্পানি
ক্যান ফিন হোমসের মুখপাত্র যুক্তি দেন যে, “এই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ জমা দেওয়ার জন্য একাধিক সুযোগ দেওয়া হয়েছিল কে-কে, যা তিনি প্রমাণ করতে পারেননি।” মুখপাত্রর আরও অভিযোগ যে, কে নিজের বদলি আটকাতেই এই অভিযোগগুলি করেছিলেন। তবে কে বলেছেন, তিনি তাঁর অভিযোগে অটল।
ক্যান ফিন হোমসের ভিলাই শাখার শাখা ব্যবস্থাপক ধনঞ্জয় কুমার ছত্তিশগড়ের বিলাসপুর হাইকোর্টে অন্যায়ভাবে চাকরি থেকে বরখাস্তের অভিযোগ সম্পর্কিত একটি রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন। চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি আদালত কে-এর চাকরি বরখাস্ত করার উপর একটি অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ২৩ এপ্রিল তাঁকে দেওয়ানি আদালতে যেতে বলেন। ক্যান ফিন হোমসের মুখপাত্র বলেন, 'কোম্পানির পক্ষেই' রায় দেওয়া হয়েছে এবং ধনঞ্জয় কুমারের চাকরি বরখাস্তের চিঠিটি আদালত 'বহাল' রেখেছে।
২৩ মে, যেদিন আমরা আমাদের প্রশ্নাবলীর উত্তর পাই, সেই দিন কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার, "এমডি এবং সিইওর আদেশে", হুইসেলব্লোয়ার কে-কে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন, বিভিন্ন কারণে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেন। এই কারণগুলির মধ্যে রয়েছে নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ করা, সহকর্মীদের তাঁর বদলির বিরোধিতা করতে উস্কানি দেওয়া, কোম্পানির ভাবমূর্তি এবং সুনাম নষ্ট করা, অকার্যকারীতা এবং ব্যবসায়িক লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থতার অভিযোগ। তাঁকে পাঁচ দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছিল।
২৮ মে তাঁর জবাবে, কে কারণ দর্শানোর নোটিশে উক্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং আবারও নিজের দাবি জানিয়েছেন। আমরা সেই কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং তাঁর প্রতিক্রিয়ায় উঠে আসা বেশ কয়েকজন ব্যক্তির নাম এখানে প্রকাশ করছি না। এরপর গত ২ জুন ক্যান ফিন্স হোমস থেকে কে-কে বরখাস্ত করা হয়।
টাটা ভ্যালু হোমসে জালিয়াতি
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ টাটা হাউজিং ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি (THDC) লিমিটেডের একটি সহায়ক সংস্থা টাটা ভ্যালু হোমস দ্বারা প্রচারিত হরিয়ানার ঝাজ্জর জেলার বাহাদুরগড়ে একটি আবাসন প্রকল্পে কর্মরত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার নিত্যানন্দ সিনহা আবাসিক কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাটের সম্ভাব্য ক্রেতাদের যে পরিমাণ এলাকা জুড়ে বাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল সেই বিবৃতিতে অসঙ্গতি আবিষ্কার করেন।
নিত্যানন্দ সিনহা বলেন যে, তিনি বিক্রয়ের চূড়ান্ত নথির দু'টি সংস্করণ পেয়েছেন। একটিতে 'প্রকৃত' পরিমাপ আছে এবং অন্যটিতে পরিসংখ্যান বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই দ্বিতীয় নথিটিই কোম্পানির ওয়েবসাইটে এবং ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য নানা প্রচারে ব্যবহার করা হয়েছিল।
ওই অ্যাপার্টমেন্টের সম্ভাব্য ক্রেতারা এতে প্রতারিত হচ্ছেন বলে উদ্বিগ্ন হয়ে নিত্যানন্দ সিনহা প্রথমে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরেই সংখ্যার অসঙ্গতির বিষয়টি তুলে ধরেন। তবে কোনও হেলদোল হয়নি। ২০১৫ সালের জুন নাগাদ, টাটা ভ্যালু হোমস নিত্যানন্দ সিনহাকে বরখাস্ত করে। নিত্যানন্দ সিনহা মেল এবং সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের মাধ্যমে 'জনসচেতনতামূলক প্রচার' শুরু করেন। তিনি সরকারি সংস্থা, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ এবং টাটা গ্রুপ অফ কোম্পানিজের ঊর্ধ্বতন নির্বাহীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন।
উল্টে, টাটা ভ্যালু হোমস তার বিরুদ্ধে দুটি মানহানির মামলা দায়ের করে: একটি হরিয়ানার গুরুগ্রামের এক দেওয়ানি আদালতে এবং আরেকটি মুম্বইয়ের একটি দেওয়ানি আদালতে। দুই আদালত থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, যা ফলে জনসমক্ষে আরও কোনও অভিযোগ করার ক্ষেত্রে বাধা পড়ে নিত্যানন্দের।
তবে এই আইনি বাধা সত্ত্বেও, নিত্যানন্দ সিনহার প্রচার গতি পায়, যার ফলে হরিয়ানা টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি প্ল্যানিং বিভাগ ওই আবাসন প্রকল্পটি কীভাবে অনুমোদিত হয়েছিল এবং THDC নিয়ম মেনে চলেছিল কিনা তা নিয়ে তদন্ত শুরু করে। দেখা যায়, কোম্পানি তদন্তে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেনি, যার ফলে বিলম্ব ঘটে।
আরও পড়ুন- কেন আদানির বিরুদ্ধে তদন্ত হয় না? সেবির প্রধানের সত্য ফাঁস হিন্ডেনবার্গের নতুন রিপোর্টে
২ বছর ধরে চলা অর্থহীন তদন্ত
বরিষ্ঠ নগর পরিকল্পনাবিদ দাবি করেছিলেন, নিত্যানন্দ সিনহার কোনও মেল তিনি পাননি। তাই তিনি যে তথ্য চেয়েছিলেন তা দিতেও অস্বীকার করেন ওই ব্যক্তি। ২০২৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ঝাজ্জরের জেলা নগর পরিকল্পনাবিদের (ডিটিপি) জারি করা একটি চিঠির মাধ্যমে আরটিআই আবেদনটি করা হয়েছিল। ওই আবেদনে টাটা ভ্যালু হোমস প্রকল্প বিষয়ক তদন্তের ফলাফলের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছিল।
নিত্যানন্দ সিনহা এই তথ্যগুলির বিরোধিতা করেন, যুক্তি দেন যে তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ অসঙ্গতিগুলি খুঁজে পেয়েছেন তা বেরই করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। তিনি ২৯ ডিসেম্বর এসটিপি রোহতক এবং ডিটিপি ঝাজ্জরকে একটি মেল করে ডিটিপির সিদ্ধান্তের আপত্তি জানান। বরিষ্ঠ নগর পরিকল্পনাবিদ ওই মেলের কোনও সাড়া না দেওয়ার পর, নিত্যানন্দ সিনহা বিষয়টি হরিয়ানার প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদের (আরটিআই আইনের অধীনে প্রথম আপিল কর্তৃপক্ষ) কাছে নিয়ে যান। তারপর অসন্তুষ্ট হয়ে, হরিয়ানার রাজ্য তথ্য কমিশনের (এসআইসি) কাছে দ্বিতীয় আপিল দায়ের করেন।
SIC-এর হস্তক্ষেপের পর, এসটিপি রোহতক ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারি একটি চিঠি জারি করে। দেখা যায়, নিত্যানন্দ সিনহা যে তথ্য চেয়েছিলেন তা দেওয়ার বদলে চিঠিতে বলা হয়েছে যে তদন্তটি নিত্যানন্দ সিনহাকে না জানিয়ে বা তাঁর কথা না শুনেই বন্ধ করা হয়েছে।
এসটিপি ২০২৩ সালের ১৮ জানুয়ারির ২৩ মাস বয়সি একটি স্মারকলিপি উদ্ধৃত করে, যার সঙ্গে তদন্তের কোনও প্রাসঙ্গিকতাই নেই। আমরা এসটিপি-র সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি, মেল করে একটি প্রশ্নপত্র পাঠিয়েছি। এখনও উত্তর আসেনি।
নিত্যানন্দ সিনহার চিঠিপত্র থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসছে। অভিযোগের ভিত্তিতে যদি কোনও ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তাহলে ঝাজ্জরের ডিটিপি কেন ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারি ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ধরে তদন্ত চালিয়েছিল?
হরিয়ানা সরকারের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে দীর্ঘ বিলম্ব এবং সাড়া না পাওয়ার ফলেই বোঝা যাচ্ছে যে পরিস্থিতি কীভাবে কাজ করে!
এই প্রেক্ষাপটেই, টাটা গ্রুপের আবাসন শাখায় এক বড় ধরনের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন দেখা দেয়। টাটা ভ্যালু হোমসের এমডি এবং সিইও পদত্যাগ করেন। এরপর গ্রুপের রিয়েল এস্টেট এবং পরিকাঠামো ব্যবসার পুনর্গঠন শুরু হয়। জল্পনা শুরু হয়, নিত্যানন্দের অভিযোগের সঙ্গে কি কোনওভাবে যোগ আছে এই পরিবর্তনগুলির?
গত ১৫ মে, আমরা টাটা রিয়েলটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড এবং টিএইচডিসির এমডি এবং সিইও সঞ্জয় দত্তকে একটি প্রশ্নপত্র মেল করেছিলাম। কোনও উত্তর পাইনি।
উল্লেখ্য, এই ঘটনা চলাকালীনই আইন নিয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি অর্জন করেন নিত্যানন্দ সিনহা এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজের আইনি লড়াই চালিয়ে যান।
চূড়ান্ত জয়
২০২৫ সালের ১১ এপ্রিল গুরুগ্রামের সিভিল জজ (জুনিয়র ডিভিশন) নিত্যানন্দ সিনহার বিরুদ্ধে মানহানির মামলায় চূড়ান্ত রায় দেন। আদালত বলেছে, সরকারি কর্তৃপক্ষ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির কাছে অভিযোগ জানানোর বৈধ অধিকার নিত্যানন্দের থাকলেও, গণমাধ্যম এবং টাটা গ্রুপের ব্যবসায়িক অংশীদারদের - বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক গোষ্ঠীর সদস্য ইন্টান্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে - মেলে 'গুন্ডা' এবং 'মজ্জাগত অপরাধী' শব্দের ব্যবহার আপাতদৃষ্টিতে মানহানিকর।
আদালত দেখেছে, এই বক্তব্যগুলিতে টাটা গ্রুপ কোম্পানির সুনামের ক্ষতি হলেও প্রকৃত আর্থিক ক্ষতির কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আদালত নিত্যানন্দ সিনহার আর্থিক ক্ষতিপূরণের দাবি খারিজ করে বলে যে, অভিযোগ করা মানহানিকর বিষয়বস্তু টাটা ভ্যালু হোমস প্রকল্পের কার্যক্রমের উপর কোনও প্রভাব ফেলতে পারে না। আদালত নিত্যানন্দ সিনহাকে কোম্পানি এবং এর কর্মচারীদের সম্পর্কে আরও কোনওরকমের মানহানিকর বিষয়বস্তু প্রচার করা থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে একটি স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। পাশাপাশিই, আদালতের রায়ে যথাযথ পন্থায় হুইসেলব্লোয়ারের দায়িত্ব পালনের অধিকারের কথাও বলা হয়েছে।
তবে নিত্যানন্দ সিনহা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন। নিত্যানন্দ সিনহা ভারতের অন্যতম বিখ্যাত এবং খ্যাতনামা কর্পোরেট সংগঠনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলাগুলি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আইনি লড়াইয়ের পর, নিত্যানন্দ সিনহার জয় হুইসেলব্লোয়ারদের অধিকারের লড়াইয়ে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হয়েই থেকে যাবে।
লেখক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা এবং আয়ূষ যোশী স্বাধীন সাংবাদিক
(লেখাটি Article 14-এ প্রকাশিত How India’s Corporate Whistleblowers Face Retaliation & Get No Protection From A Law Govt Keeps Dormant শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে অনুমতিক্রমে অনূদিত)