আনা হয় সাদা পদ্ম, কেন আজও ‘উত্তম’ পুজো করা হয় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে?
Uttam Kumar : আবেগ থেকে আস্ত একটা পুজো? শুনতে অবাক লাগলেও আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এমন কাজটাই আদতে করে দেখিয়েছিলেন অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়!
আকাশে ‘উত্তম’ নামের তারাটা যখন উজ্জ্বল হয়ে দীপ্যমান ঠিক তখনই আরও কিছু তারারা নিজেদের মতো করেই আলোকছটা তৈরি করেছেন। যাঁর মধ্যে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ছিলেন অন্যতম। উত্তম-সৌমিত্র এই দুই কিংবদন্তিকে এক পংক্তিতে রেখে আলোচনা করা হলেও সমান জনপ্রিয় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গ আসে তুলনায় অনেক কম। অথচ ‘চৌরঙ্গী’র স্যাটা বোসের সঙ্গে শঙ্করের সম্পর্কের রসায়নটা তো নেহাৎ কম কিছু ছিল না। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সুযোগ্য পুত্র অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় একবার এক সাক্ষাৎকারে বাবাকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, যখন তিনি সদ্য সিগারেট খেতে শিখেছেন, একদিন বাবার পকেট থেকে সিগারেট চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যান হাতেনাতে। শুভেন্দু অবশ্য চিরকালই রসিক মানুষ, তাই শাসন করার ধরনটাও ছিল বেশ অভিনব। শুভেন্দু তখন নাকি বলেন, “আমি বুঝতে পারছি, ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে রাখলে নিজেকে উত্তমকুমার মনে হয়। ওটা ঝুলিয়েই রাখিস, টানিস না’!’’
এই কথাটাই প্রমাণ করে দেয় শুভেন্দুর কাছে উত্তম কুমার ঠিক কতটা ছিলেন! বসন্ত বিলাপ ছবির বিখ্যাত সংলাপটা মনে পড়ে যায়, “একবার বলো, তুমি উত্তম কুমার!”, বাঙালি প্রেমিকের সেই উত্তম হবার শখ কিন্তু চিরকালীন। তাই হয় শুভেন্দু কেবল সহ অভিনেতা হয়ে থাকতে চাননি কোনও দিনই। বরং উত্তম মোহে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেই চেয়েছেন আজীবন। পড়াশোনা তুখোড় ছিলেন তার ওপর পারিবারিক পন্থা, তাই ডাক্তারি পড়ার হাত থেকে রেহাই মেলেনি শুভেন্দুর, কিন্তু ডাক্তারির থেকে অভিনয়ের প্রতি টানটাই বেশি ছিল তাঁর। ১৯৬৫ সালে মৃণাল সেনের ‘আকাশ কুসুম’ ছবির হাত ধরে প্রথম পরিচিত হলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। উত্তম কুমার অবশ্য তখন নিজের জায়গাটা তৈরি করেই ফেলেছেন। অথচ তাতে বিশেষ অসুবিধা হল না শুভেন্দুর। উত্তম ছায়ার আড়ালে তিনি কোনও দিনই যাননি। বরং তাঁকে ‘দাদা’ সম্মোধন করে প্রকৃত অনুজের দায়িত্ব পালন করেছেন সর্বদা।
আরও পড়ুন - ৫ সিকে পয়সার বিনিময়ে অভিনয় শুরু, পরবর্তী জীবনে কত পারিশ্রমিক ছিল উত্তম কুমারের?
অভিনয়ের মঞ্চ ছাড়িয়ে সম্পর্ক গড়িয়েছিল ব্যক্তিগত জীবনেও, শুভেন্দু উত্তমের রসায়নে আজও মোহিত টলিপাড়া। চৌরঙ্গীর স্যাটা বোসের সঙ্গে অবশ্য শঙ্করের সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে তার আগেই। শোনা যায়, সত্যজিৎ রায়ের ‘চিড়িয়াখানা’ ছবির শ্যুটে নাকি একবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মহানায়ক। সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীকে সুস্থ করতে সেদিন হাল ধরেছিলেন ডাক্তার শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। এই ছবিতে শুভেন্দু অভিনয় করেছিলেন ‘বিজয়’ চরিত্রে। জানা যায়, সেই সময় প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে মহানায়ককে ফিরিয়ে এনেছিলেন অভিনেতা।
একদিকে সহ অভিনেতা যার অভিনয়ে উত্তম ভালোই আঁচ করতে পেরেছেন জাত, তার ওপর অমন ডাক্তারি, সবমিলিয়ে উত্তম কুমার শুভেন্দু নামের তরুণ অভিনেতার ওপর আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। কৃতজ্ঞ মহানায়ক নাকি পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে ঘুরে ফিরে শুভেন্দুর ডাক্তারির প্রসঙ্গ তুলে বলতেন, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের ডাক্তারির কথা। আর অপরদিকে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের কাছে উত্তম কুমার ছিলেন বড় দাদা। ওই নামেই ডাকতেন তাঁকে। আসলে সেকালের টলিপাড়ায় একটা অন্যরকম আমেজ ছিল। ভীষণ রকম একটা পারিবারিক টান ছিল। যা একটু একটু করে ফিরে তুলেছিলেন অভিনেতারা। সেখানে আড্ডা হত, ঝগড়া হত, মনোমালিন্যও হত। আবার সেগুলো কাটিয়ে ভীষণরকম বন্ধুত্ব হত। স্নেহ ছিল, আবদার ছিল, শাসন ছিল আবার কখনও কখনও ছিল দারুণ অধিকার বোধ।
বাঙালির একটা আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উত্তম কুমার। আবেগের বয়স বাড়ে, তবে ফিকে হয় না একরত্তিও। তবে কিনা সেই আবেগ থেকে আস্ত একটা পুজো? শুনতে অবাক লাগলেও আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এমন কাজটাই আদতে করে দেখিয়েছিলেন অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তাঁর নিজের বাড়িতেই। আজও প্রতিবছর সেই রেওয়াজ মেনেই হয় উত্তম পুজো। শুভেন্দুর শুরু করা সেই রীতিকে সযত্নে লালন করেছেন তাঁর ছেলে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়ও।
আরও পড়ুন - এখনও বেজে ওঠে উত্তম কুমারের হারমোনিয়াম, অবহেলায় দিন গুনছে কলকাতার ঐতিহ্য ‘মেলোডি’
২৪ জুলাই, ১৯৮০। একপ্রকার না জানিয়েই চলেন জন বাঙালির চিরকালের ম্যাটিনি আইডল উত্তম কুমার। এর ঠিক এক বছর পর, যখন গোটা বাংলা জুড়ে স্মৃতিকথন চলছে ঠিক তখন খোদ কলকাতায় নিজের বাড়িতে অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় চালু করলেন উত্তম পুজো, দিনটা ১৯৮১ সালের ২৪ জুলাই, মহানায়ক উত্তম কুমারের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
নীরবে নিজের বড় দাদাকে পুজো করতেন তিনি।জানা গিয়েছে, বেশ কিছু সাদা পদ্ম আনাতেন ওইদিন। নিজের হাতে সেগুলো ফোটাতেন। তার পর সাজিয়ে দিতেন মহানায়কের ছবির নীচে। সঙ্গে থাকত এক পেগ হুইস্কিও। মৃত্যুর পর তো আর মদ্যপানের ভয় দেখাতে পারেন না ডাক্তার, তাই হয়তো প্রিয় জিনিসটাই এগিয়ে দিতেন নিজের হাতে। সেই রেওয়াজ আজও বহাল প্রজন্মের হাতে। বাবার মৃত্যুর পর জেঠুর পুজো করেন শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। বাঙালির এমন একজন আবেগ হয়ে আক্ষরিক অর্থেই আরাধ্য, তার প্রমাণ মেলে এভাবেই।