কোনও হিট সিনেমা ছাড়াই দামি গাড়ি, প্রযোজনা সংস্থা! বনি সেনগুপ্ত আসলে কে?

Bonny Sengupta ED: ১০ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বনি বিজেপিতে যোগ দিলেন। এক বছরও সংসার করলেন না।

বয়স ৩২। চেহারা খুব যে একটা সৌম্য নয়, এমন দাবি করা যায় না। পালিশ করা ধোপদুরস্ত চেহারা হলেও যে সিনেমা জগতে বিশেষ করেকম্মে খাওয়া যায় না তার প্রকৃষ্ট বহু উদাহরণ চোখের সামনে রয়েছে। এমনকী পরিবারে যদি প্রায় সকলেই সিনেমা জগতের সঙ্গে যুক্ত হন তাহলেও হালে পানি পাওয়া যায় না। কিন্তু সিনেমায় না দাঁড়াতে পারলেও জীবনে ঠিকই দাঁড়ানো যায়, অন্তত টাকা পয়সা করে বিলাসের অভাব হয় না। দামি 'লাইফস্টাইল'-এর সঙ্গে সাফল্যের যোগ নেই, যোগ রয়েছে সঠিক মানুষের সঙ্গে সঠিক যোগাযোগের। যেমনটা করে উঠতে পেরেছেন বনি সেনগুপ্ত। বেশ কয়েক বছর ধরে টালিগঞ্জে কাজ করেও 'নায়ক' বা অভিনেতা কোনওটাই তেমন হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মাঝেমাঝে একদিকে কেরিয়ার খারাপ চললে অন্য দিকে ছিপ ফেলে দেখতেই হয়। বনিও রাজ্যের উথলে ওঠা রাজনৈতিক ঘোলা জলে ছিপ ফেলেছিলেন। সেখানেও বিশেষ লাভ হয়নি। কিন্তু বনি সেনগুপ্ত ঘরে ঘরে পরিচিত হয়ে গেলেন, টেলিভিশনের সবচেয়ে বেশি টিআরপিওয়ালা সংবাদ মাধ্যমে প্রতি ৫ মিনিটে ২ বার বনির নাম উচ্চারিত হতে থাকল। বনি জড়ালের পশ্চিমবাংলার অন্যতম বড় 'স্ক্যান্ডাল'-এর সঙ্গে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জড়ালেন টালিগঞ্জের এককালের বিখ্যাত মুখ সুখেন দাসের নাতি।

আসল নাম অনুপ্রিয় সেনগুপ্ত। তবে টালিগঞ্জের অন্দরে এসে সিনেমায় পা রাখলেন বনি ডাকনাম নিয়েই। দাদু সুখেন দাস বাঙালি বাড়ির অতিপরিচিত অভিনেতা। তাঁরই কন্যা পিয়া দাস বিয়ে করলেন পরিচালক অনুপ সেনগুপ্তকে। ১৯৯০ সালের ১০ অগাস্ট জন্মালেন বনি। সিনেমার পরিবেশে জন্ম, সিনেমাই তাই সহজ কর্মক্ষেত্র। তবে অভিনেতা নয়, সহকারী পরিচালক হিসেবেই প্রথম টালিগঞ্জের সিনেমাপাড়ায় কাজ শুরু করলেন বনি। রাজ চক্রবর্তীর 'যোদ্ধা' সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে হাতেখড়ি হলো বনির। ২০১৪ সালে, বনির বয়স যখন ২৪, প্রথম 'হিরো' হিসেবে পর্দায় এলেন তিনি। রাজ চক্রবর্তীরই সিনেমা, 'বরবাদ'। সেখানে তাঁর বিপরীতে নায়িকা রীতিকা সেন। বরবাদের পরের বছরই ফের রাজ চক্রবর্তীর সিনেমা 'পারব না আমি ছাড়তে তোকে'-তে আবার নায়ক হলেন বনি। এবার বিপরীতে নায়িকা কৌশানী। পরপর সিনেমা করতে থাকলেন বনি। কিন্তু দাগ কাটল না কোনওটাই। 'তোমাকে চাই', ‘জিও পাগলা', গার্লফ্রেন্ড', রাজা রানি রাজি', 'মনে রেখো' (বাংলাদেশ) 'কে তুমি নন্দিনী', 'ভূতচক্র Pvt. Ltd.’, 'জানবাজ', 'লাভ স্টোরি', 'বিয়ে.কম', 'তুমি আসবে বলে', 'আজব প্রেমের গল্প', ‘F.I.R No. 339/07/06’, 'অন্তর্জাল', 'হীরকগড়ের হিরে', 'জতুগৃহ', 'আম্রপালি', 'শুভ বিজয়া'- এমন সব কত কত সিনেমা যে করেছেন বনি, নিজেও হিসেবে রেখেছেন কিনা জানা নেই। অথচ খুব চেষ্টা করলেও একটা বা দুটো বাদে বাকি সিনেমার নামটুকুও মনে রাখেনি দর্শক, এমন সিনেমা যে কোনওকালে তৈরি হয়েছে সেটুকুও বোধহয় জানা নেই অনেকের। কিন্তু বনি থামলেন না। বনি নিজের কেরিয়ারের গাড়ি ঘোরালেন অন্যদিকে।

আরও পড়ুন- দুর্নীতির আখ্যানে নয়া চরিত্র! যেভাবে সিবিআইয়ের জালে এলেন ‘কালো মানিক’!

তবে এসবের মাঝে বনি বাকি তারকাদের মতোই বিলাসে অভ্যস্ত হয়েছেন। বনির 'ফেভারিট ডেস্টিনেশন' হয়ে উঠেছে মলদ্বীপ। বনির শখের তালিকায় জুড়ে গিয়েছে বিলাসবহুল গাড়ি। সিনেমা হিট না হওয়ার সঙ্গে তারকাসুলভ যাপনের যে সম্পর্ক নেই তা প্রমাণ করে দিয়েছেন বনি সেনগুপ্ত। দ্বিতীয় সিনেমার নায়িকা কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ততদিনে প্রেমও করতে শুরু করে দিয়েছেন তিনি। ২০২১ সালে হঠাৎ বনি ঠিক করলেন, একটু রাজনীতি ঘেঁটে দেখা যাক। ছাত্রজীবনে যে জীবনে আন্দোলন বিক্ষোভ করেননি বলা বাহুল্য, বড় হয়েও খুব রাজনীতি সচেতন, প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল এমন ছাপও দেখাননি কোনওদিন। তবু বনি রাজনীতিতে এলেন। চারদিকে গেরুয়া হাওয়া তখন রাজ্যে। ১০ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে বনি বিজেপিতে যোগ দিলেন। এক বছরও সংসার করলেন না। ২৪ জানুয়ারি টুইট করে বলে দিলেন, খেলা শেষ। বিজেপি মানুষকে যা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিচ্ছু রাখেনি তাই বনিও বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন না। কৌশানি অবশ্য তৃণমূল কংগ্রেসের বিধানসভা প্রার্থী ছিলেন। বনির সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক কর্মজীবন সাঙ্গ হতে পারত এখানেই। কিন্তু বনি জড়ালেন দুর্নীতি মামলাতে। ২০২৩ সালে গোড়া থেকেই ঘুরে ফিরে শিক্ষক নিয়োগের ঘটনায় রাজ্যের তৃণমূল সরকারের দুর্নীতিতে নাম জড়াতে থাকল বনির।

নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে ইডির দফতরে টানা জেরা করা হয়েছে বনিকে। ইডি বলছে, হুগলির যুব তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষের সঙ্গে বনির আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। বনি অবশ্য অস্বীকার করেননি। বনির জীবনযাপন যা, তা চালাতে গেলে টাকা লাগেই। বনিরও প্রয়োজন পড়েছে। কুন্তল ঘোষের হয়ে 'ইভেন্ট' করার পারিশ্রমিক হিসেবে নাকি ৪০-৪৫ লক্ষ টাকা পেয়েছেন তিনি। আর তাই দিয়ে ২০১৭ সালে কিনেছেন দামি গাড়ি। মনে রাখতে হবে, বনির সিনেমায় আসার ৩ বছর পেরিয়ে গিয়েছে তখন, অথচ নেই কোনও হিট। তবু, শখ আছে, সাধও আছে, আছে গাড়িও। আরও একটি বিষয় খটকা বাঁধিয়েছে। প্রেমিকা কৌশানি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্প্রতি যৌথ উদ্যোগে নতুন প্রযোজনা সংস্থাও খুলেছেন বনি সেনগুপ্ত। 'বি কে এন্টারটেইনমেন্ট' নামের এই প্রযোজনা সংস্থা 'ডাল-বাটি-চুরমা' নামে একটি সিনেমার প্রযোজনাও শুরু করেছে। এই সমস্ত কিছুর নেপথ্যে যে মূলধন, তা আসছে কীভাবে?

আরও পড়ুন- প্রমাদ গুণছেন স্বয়ং অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়! এসএসসি মামলার ভবিষ্যৎও কি ‘সারদা-নারদ’-এর মতোই?

বনি জানান, কুন্তলের সঙ্গে তাঁর আলাপ ২০১৭ সালে জিরাটে একটি অনুষ্ঠান করতে গিয়ে। বনি গাড়ি কিনবেন আর কুন্তল গাড়ি কেনার টাকা দিয়ে বনিকে সাহায্য করবেন। তার পরিবর্তে কুন্তলের হয়ে ২৫-২৬টি অনুষ্ঠান বনি করেছেন বলে দাবি। কুন্তল নাকি বনির একটি সিনেমা প্রযোজনা করবেন বলেও জানিয়েছিলেন যদিও পরে সেই পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। বনি বলছেন, পারিশ্রমিক হিসেবে তিনি কুন্তলের কাছে যে টাকা নিয়েছেন তার সমস্ত কাগজপত্র তাঁর কাছে রয়েছে। সেই টাকা নিয়ে তিনি ডিসকভারি গাড়ি কিনেছিলেন। তবে গাড়িটি পরে তিনি আবার বেচেও ফেলেছেন। সেই গাড়ির কাগজপত্র চেয়েছে ইডি। বনির মা পিয়া আবার তৃণমূলের ঘনিষ্ঠ এবং একনিষ্ঠ সদস্য। মা আর প্রেমিকার ঠিক উল্টোদিকে গিয়েই বনি বিজেপিতে যান। তার আগে যখন এসব গাড়ি কেনাবেচা চলছে তখন কিন্তু বনির সঙ্গে নিবিড় যোগ তৃণমূলের এই যুবনেতা কুন্তলের। 'আমি আর বিজেপিতে নেই,' জানিয়ে দেওয়ার পরে বিজেপিও খুব একটা বাংলা সিনেমার 'নায়কের' পাশে দাঁড়ায়নি। এখন ইডির ফাঁদে পড়ার পরে আরই হাত তুলে দিয়েছে বঙ্গ বিজেপি।

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলে দিয়েছেন, ২ বছর হয়ে গেল বিজেপির সঙ্গে বনি সেনগুপ্তের কোনও সম্পর্ক নেই। বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল বলছেন, তৃণমূলের প্রত্যেক নেতাই কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত। তাই বনি এককালে বিজেপি করতেন বলে খুব যে স্বস্তিতে থাকবেন এমনটা না। গত বছরের মে মাসে, সিবিআইকে ২০১৪ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি) এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশনের নন-টিচিং স্টাফ (গ্রুপ সি এবং ডি) এবং টিচিং স্টাফ নিয়োগের তদন্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে, পরীক্ষায় ফেল করার পরেও চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য ৫ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন শাসকদলের নেতা কর্মীরা। সেই তদন্তে নেমেই চমকে দেওয়া সব নাম উঠে আসছে। বনি সেনগুপ্তর সিনেমা ব্যর্থ হলেও, দুর্নীতির 'খ্যাতি' জুটেই গিয়েছে তাঁর।

More Articles