কার মদতে সাফ সবুজ দ্বীপের শ’য়ে শ’য়ে গাছ? যে উত্তর উঠে এল...

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’ উপন্যাসটি  বহুলপঠিত, সেই কাহিনি অবলম্বনে তপন সিংহ-র বিখ্যাত সিনেমাটিও হয়তো দেখা অনেকেরই। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া বসতির পটভূমিকায় আবর্তিত হয়েছিল সেই কাহিনি। কাকাবাবু, অর্থাৎ রাজা রায়চৌধুরী ও সন্তু আন্দামানে যায় একটি গোপন মিশনে। অপরদিকে কুখ্যাত অপরাধী পাঞ্জা তার আরও তিন শাগরেদ নিয়ে আন্দামানে উপস্থিত হয় একটি দামি জিনিস চুরি ও পাচারের উদ্দেশ্যে, তা হল, মহাকাশ থেকে আগত একটি অগ্নিপিণ্ড, যা জারোয়াদের মধ্যে বছরের পর বছর থেকে গেছে।

‘সবুজ দ্বীপ’ বললে বাঙালির হয়তো প্রথমেই এই কাহিনি বা চলচ্চিত্রের কথা মনে পড়তে পারে, কিন্তু সম্প্রতি সবুজ দ্বীপ নামটি বিশেষ একটি কারণে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বলাগড়ের গঙ্গা এবং বেহুলা নদীর উপকণ্ঠে গড়ে ওঠা নদীর চর সবুজ দ্বীপ। শুধু নাম এক নয়, সুনীলের গল্পের সঙ্গে পটভূমিকাতেও বিস্তর মিল। কাকাবাবুর সেই গল্পে মহার্ঘ জিনিস ছিল মহাকাশের অগ্নিপিণ্ড, কিন্তু বাস্তবের সবুজ দ্বীপে যে মহার্ঘ বস্তুটি চুরি করা ও পাচার করা চলছে দিনের পর দিন– তা হল গাছ। শ’য়ে শ’য়ে গাছ, কেউ কেউ বলছেন সংখ্যাটা হাজারও ছাড়াতে পারে, কেটে ফেলা হচ্ছে নির্বিচারে, অভিযোগ এমনটাই। ঘটনার প্রেক্ষাপটে একটু নজর দেওয়া যাক।


৩০ মার্চ, বলাগড়ের বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী সোশ্যাল মিডিয়াতে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লেখেন, সবুজ দ্বীপে গিয়ে তিনি দেখেছেন বহু গাছের মৃত্যু হয়েছে, এবং মৃত গাছদের কেটে ফেলা হয়েছে বহু ক্ষেত্রেই। মনোরঞ্জন আরও জানান, প্রশাসনের তরফে তাঁর কাছে দাবি করা হয়েছে যে, গাছেদের মৃত্যু হয়েছে বক, পানকৌড়ির মতো পাখিদের বিষ্ঠার ফলে। আশ্চর্য শোনালেও সত্যি, সোমড়া ২ পঞ্চায়েত সভাপতি হারু হালদার ঠিক এমন দাবিই করেছেন।

মনোরঞ্জনবাবুকে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বিডিও এবং পুলিশকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন অপরাধীদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তি দেওয়ার। উনি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন, এটা কাঠ-পাচারকারী চক্রের কাজ। সবুজ দ্বীপে অনেক গাছ রয়েছে, যার বাজারমূল্য অনেক। এই পাখির বিষ্ঠার তত্ত্ব একেবারেই খারিজ করছেন তিনি।

আরও পড়ুন: বাড়ছে সমুদ্রের জলতল, কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারতের অর্থনীতি?


১৯৭৭ সাল নাগাদ সবুজ দ্বীপ চর হিসেবে নদী বক্ষে উঠে আসে। পরে ১৯৯০ সালে রাজ্য সরকার এবং হুগলি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে এখানে অনেক গাছ লাগানো হয়, যার মধ্যে আছে মেহগনি, টিক, পাইন, সেগুন, শাল, পাম, ইউক্যালিপটাসের মতো কৃত্রিম গাছ। উদ্দেশ্য ছিল, এই দ্বীপকে পর্যটনের জন্য তৈরি করা।

মনোরঞ্জনবাবুর বক্তব্য, তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বহুবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, এই জায়গা ঢেলে সাজানোর। এটি তাঁর স্বপ্নের প্রকল্প। চার বছর আগের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী দেড়শো কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন সবুজ  দ্বীপকে একটি পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করার জন্য। মনোরঞ্জনবাবু জানালেন, সেই পরিকল্পনামতো কাজও হচ্ছে। দ্বীপের এক প্রান্তে ঘন জঙ্গল, বাকি এলাকাজুড়ে চড়ুইভাতির জায়গা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি হচ্ছে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, ঘন জঙ্গলকেও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। ফেসবুকে মনোরঞ্জনবাবুর পোস্টে দেখা যাচ্ছে যে ছবিগুলি– তা যথেষ্ট আতঙ্কের। দেখা যাচ্ছে, বিশাল বিশাল সব গাছ পড়ে রয়েছে, যার বেশিরভাগই কেটে ফেলা হয়েছে। এবার প্রশ্ন উঠছে, পঞ্চায়েত সভাপতি পাখির বিষ্ঠার তত্ত্ব কী করে এবং কেন খাড়া করলেন? পরিবেশবিদ নব দত্তও এই তত্ত্ব একেবারে খারিজ করে বললেন, “এই গাছ কাটা আমাদের রাজ্যে একটা উৎসবে পরিনত হয়েছে। উন্নয়নের নামে গাছ কাটা, পুকুর বোজানো চলছে রাজ্যে এবং লাভবান হচ্ছে শুধু ঠিকাদাররা।” তিনি স্পষ্টভাবেই বললেন, উন্নয়নের এমন একটি মডেল তৈরি হচ্ছে, যেখানে বড় পুরনো গাছ, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ– তা কেটে ফেলা হচ্ছে এবং তার জায়গায় ‘লোকদেখানো’ বৃক্ষ রোপণ হচ্ছে। আদালতের রায় অনুযায়ী, একটি পূর্ণবয়স্ক গাছের দাম কম করে পনেরো কোটি টাকা হওয়া উচিত। নব দত্ত প্রশ্ন তুলছেন, কোথায় এই ক্ষতিপূরণের টাকা?

হাওড়ার ডুমুরজলা পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাথে যুক্ত এবং মাইক্রোবায়োলজির ছাত্রী তৃষিতা মান্নারও বক্তব্য, পাখির বিষ্ঠার তত্ত্ব যিনি দিচ্ছেন, তিনি একেবারেই ভুল কথা বলছেন এবং এইভাবে গাছ কেটে ফেলা একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রের অংশ। তৃষিতা আরও বলছেন, তাঁরা ডুমুরজলায় দেখেছেন, কীভাবে গাছের ভিতর বিষাক্ত পেরেক ঢুকিয়ে গাছগুলিকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এবং সেই কাজ যে প্রশাসনের একাংশের মদতেই হয়েছে– সেই ব্যাপারেও নিশ্চিত তিনি। একইভাবে তাঁর বিশ্বাস, প্রশাসনের একাংশের মদত ছাড়া সবুজ দ্বীপ থেকেও অত বড় গাছ কেটে সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়।

কিন্তু আশাপ্রদ যা, তা হল, প্রশাসনিক স্তরে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর মতো মানুষও আছেন, যাঁর নজরে এই ঘটনা আসায় পুলিশ তৎপর হয়েছে এবং শেষ খবর অনুযায়ী, একজন পাচারকারীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তবে মনোরঞ্জনবাবু নিজেই বলছেন, চুনোপুঁটি ধরা পড়েছে সবে। রাঘব বোয়ালরা জালে পড়া এখনও বাকি। তিনি আরও বলছেন, তিনি এর শেষ দেখবেন এবং আর একটাও গাছ যাতে কাটা না পড়ে, তা নিশ্চিত করবেন।

পরিবেশ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে এইভাবে নির্বিচারে গাছ কাটার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে, তা নিয়ে বারবার বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন। কিন্তু সরকার কি যথেষ্ট তৎপর পরিবেশকে বাঁচাতে? উঠছে প্রশ্ন। শুধু সবুজ দ্বীপ নয়, অভিযোগ, রাজ্য এবং দেশের অনেক জায়গাতেই পরিবেশ ধ্বংস চলছে। কোথাও চোরাচালান তো কোথাও উন্নয়নমূলক প্রকল্পের নামে। এই ধ্বংসলীলা এখনই বন্ধ না হলে ভবিষ্যতের সংকট এড়ানো কঠিন হবে। 

More Articles