রাজন্যাই তবে পারবে যাদবপুরের বাম দুর্গে ফাটল ধরাতে?

Rajanya Halder TMCP: যাদবপুরের রাস্তা বামদিকে না ডানদিকে, এই প্রশ্ন নিয়ে পুজো অবধি চালিয়ে দেওয়া যাবে। তারপর তো 'মা আসছেন', অষ্টমী সর্টেড!

লাঠির মুখে গানের সুর দিয়ে 'দেখিয়ে' দিয়েছিল যাদবপুর। বহুকাল পরে হোক কলরব আন্দোলন দিয়ে সারা দেশের ছাত্র ক্ষমতার এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল, একথা যাদবপুরের অতি বড় নিন্দুকও স্বীকার করবেন। রাজ্যটা পশ্চিমবাংলা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলে দিয়েছেন, রাজ্যে সবাই তৃণমূল। রাজ্যের কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয় না ঢের ঢের বছর! কারণ সবাই তৃণমূল, বিরোধী শূন্য। যে শাসক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনও তারই, এসব স্বাভাবিক। কিন্তু খোদ কলকাতাতেই আছে যাদবপুর। 'বিপ্লবী, আঁতেলদের' পীঠস্থান বলে জনমানসে কুখ্যাতি এবং সুখ্যাতি দুই-ই আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই পীঠস্থানেই পিঠ ঠেকে গিয়েছে তৃণমূলের। যতই সেখানে তৃণমূল শিক্ষক সংগঠন করার, ছাত্র সংগঠন করার চেষ্টা করুক না কেন, হালে পানি পায় না। বাম, অতিবাম, বাম মনোভাবাপন্ন, ‘সহি বাম' এত বামের মাঝে তৃণমূল একেবারেই চার আনার স্থান পেয়েছিল যাদবপুরে। সেই ঐতিহ্যপূর্ণ যাদবপুরেই র‍্যাগিংয়ের ফলে মৃত্যু ঘটল ছাত্রের। ছাত্রটি মারা গেল, নগ্ন করে দিয়ে গেল প্রগতিশীল চেতনার আড়ালে থাকা সহস্য অপরাধী মুখ, অপরাধী মানসিকতাদের। ছাত্রটি মারা গেল, সুযোগ করে দিয়ে গেল রাজনৈতিক দলগুলিকে। বিশেষত দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলিকে, যারা এতদিন সামান্য দাঁত ফোটানোর মরিয়া চেষ্টা করে গিয়েও সেভাবে দাগ কাটতে পারেনি। তৃণমূল তুলে ধরল ছাত্রদের নেতৃত্ব দেওয়ার নতুন মুখ, রাজন্যা হালদারকে। ২১ জুলাইতেই তুলে ধরা হয়েছিল শহিদ দিবসের মঞ্চে। রাজন্যাই কি তবে বাম দুর্গে ফাটল ধরানোর ব্রহ্মাস্ত্র?

তৃণমূলের একুশে জুলাইয়ের মঞ্চে দলের পোড়খাওয়া নেতাদের পাশে নতুন মেয়েটিকে দেখে অনেকেই ভেবেছিলেন, এত গুরুত্বপূর্ণ কীভাবে হয়ে উঠলেন এই তনয়া? ঝাঁঝালো ভাষণ দিয়ে রাজন্যা সেদিনই প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, সায়নী ঘোষ ব্যাকফুটে যেতেই নতুন বোড়ে এগিয়ে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, গান লেখার কথা সকলেই জানেন। সেই 'শিল্পানুরাগ' থেকেই কিছুকাল আগে ধর্মতলায় এক ধর্নামঞ্চে তৃণমূল ছাত্র-যুবদের গান শুনে একটি গানের ব্যান্ড তৈরি করেন দিয়েছিলেন। সেই ‘জয়ী’ ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য রাজন্যা হালদার। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী রাজন্যা হালদার। রাজন্যার কাছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'ছাতা', মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় 'বটবৃক্ষ'! অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যুব প্রজন্মের ‘নয়নের মণি’! তৃণমূলের দিল জেতার কৌশলটি যে তাঁর রপ্ত হয়ে গিয়েছে এই বিষয়ে রাজন্যারও সংশয় নেই, তৃণমূলের তো নেই-ই!

আরও পড়ুন- ভোটে হেরেও ছিলেন মমতার বিশ্বস্ত! অভিনয় থেকে দুর্নীতিতে যেভাবে নাম জড়াল সায়নী ঘোষের

এই এতকাল পরে যাদবপুরকে বেগতিকে পেয়ে তৃণমূল তাই এই বিশ্বস্ত সেনাকেই দায়িত্ব দিল বামদুর্গ সামলাবার! সক্রিয় রাজনীতিতে এসেছেন বছর ছয়েক হলো। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর বর্তমানে গবেষণা করছেন রাজন্যা। দক্ষিণ ২৪ পরগনার তৃণমূল ছাত্র যুব সংগঠনের সহ-সভাপতি রাজন্যা। রাজনৈতিক পরিবার থেকেই উঠে এসেছেন তিনি। রাজন্যার দাদু এবং বাবা দু'জনেই ছিলেন কংগ্রেস নেতা। তাঁর বাবা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরেই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর দল ভাগাভাগিতে আদর্শ পাল্টে যায়। ২০১৭ সালের ছাত্র সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচনে লড়ে জিতে যান তিনি, সেখান থেকেই তৃণমূলের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। বলা ভালো, রাজন্যার হাত ধরেই প্রেসিডেন্সিতে গড়ে ওঠে ছাত্র পরিষদের সংগঠন। ২১ জুলাইয়ের বক্তব্য রাজন্যার রাজনৈতিক সিভি-তে পর্যাপ্ত নম্বর বাড়ানোর পরেই যাদবপুরে তৃণমূলের শখার দায়িত্ব দেওয়া হলো তাঁকে।

দায়িত্ব পেয়েই লড়ে যাচ্ছেন রাজন্যা। সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করা থেকে শুরু করে যাদবপুরের একাধিক বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া, জ্বালাময়ী ভাষণ- সবটাই করে চলেছেন মন দিয়ে। র‍্যাগিং এবং ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা ঘটতেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূলের নতুন ইউনিট গড়ে ফেলল তৃণমূল। সেখানে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি হয়েছেন রাজন্যা হালদার৷ সঞ্জীব প্রামাণিক হয়েছেন চেয়ারপার্সন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচিতে তৃণমূলের ছাত্র সংগঠনের মহিলা সদস্যদের শ্লীলতাহানি অভিযোগ দিয়ে শুরুটা করেছেন রাজন্যা। বাম ছাত্র সংগঠনের নেতারা রাজন্যা হালদারের সঙ্গেও অশালীন আচরণ করেছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। রাজন্যা বলছেন, প্রগতিশীলতার মানসিকতার আড়ালে বামপন্থীরাই হেনস্থা করে চলেছেন ছাত্রদের, মহিলাদের। ছাত্র মেরে ছাত্রপ্রেম দেখানোর নেপথ্যে রয়েছেন 'বামপন্থী'রাই। আর এই বাম-অতিবাম ঠেকাতে তৃণমূল যে বদ্ধপরিকর তাও বলছেন রাজন্যা। মানে, সারা রাজ্যে বিজেপিই তৃণমূলের মূল বিরোধী হলেও, আপাতত তৃণমূলের লক্ষ্য বাম হঠাও! কী আশ্চর্য, বিজেপিরও লক্ষ্য একই! সারারাজ্যে সবাই তৃণমূল যেখানে, একা যাদবপুরকে কেন এত গুরুত্ব দিচ্ছে শাসক দল? তৃণমূল বলছে, ২০২০ সালের নির্বাচনে যাদবপুরের ৩১ টি সিআর বা ক্লাস রিপ্রেজেন্টেটিভ রয়েছে তৃণমূলের। এই আসন যত বাড়বে, তৃণমূলের দাপট বাড়বে, দাপট যত বাড়বে, রাজ্যের এই বিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিও নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে শাসকদল। তাই রাজন্যাকে দায়িত্ব দেওয়া।

আরও পড়ুন- ছাত্র বলছে, ‘শিক্ষকের কলার ধরতে পারি’, কে এই যাদবপুরের ছাত্রনেতা সঞ্জীব?

আর এসবের মাঝে মরে যাওয়া ছাত্রটি? এসবের মাঝে র‍্যাগিং করা ছাত্ররা? এসবের মাঝে র‍্যাগিং হতে হতে ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া অজস্র পড়ুয়ারা? আসল বাম, নকল বাম, তৃণমূল, বিজেপি, সবের ভিড়ে যে যে বিচার চাই প্ল্যাকার্ডগুলির কালি ক্ষয়ে যাবে সেগুলি? একটি মৃত্যু কীভাবে সুযোগ হয়ে ওঠে দেখিয়ে দিয়েছে রাজ্য। একটি মৃত্যু কীভাবে কারও নেত্রী হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হয়ে ওঠে দেখিয়ে দিয়েছে রাজ্য। একটি মৃত্যু কীভাবে কোনও পরিবারকে শেষ করে দেয়, তাও দেখিয়ে দিয়েছে রাজ্য। স্বপ্নের মৃত্যু শব্দবন্ধখানি কাব্যিক, কাব্য মাঝে মাঝে ছাল ছাড়ানো দেহের মতোই বীভৎস। যাদবপুরের কলঙ্কের মতোই দগদগে। যাদবপুরের রাস্তা বামদিকে না ডানদিকে, এই প্রশ্ন নিয়ে পুজো অবধি চালিয়ে দেওয়া যাবে। তারপর তো 'মা আসছেন', অষ্টমী সর্টেড!

More Articles