দ্য কেরল স্টোরির আগেও হয়েছে বিতর্ক! কে এই বাঙালি পরিচালক সুদীপ্ত সেন?

The Kerala Story Director Sudipto Sen: পরিচালক সুদীপ্ত সেনের সিনেমা ইন দ্য নেম অব লাভ — মেলানকোলি অব গডস ওন কান্ট্রি-ও ছিল লাভ জিহাদের উপর।

কথায় বলে, একই ভুল একবার করলে তা ভুল, একই ভুল বারবার করলে তা অভ্যাস। সিনেমা তো শিল্পমাধ্যম। শিল্পমাধ্যমে আজকাল ভুল কিছু নেই। তবে অভ্যাস আছে, ঘরানা বলে ডাকলে একটু সম্মান পায় সেই অভ্যাস। যেমন কারও কারও অভ্যাস, যৌন সুড়সুড়িমূলক সিনেমা তৈরি করে মুনাফা লোটা। কারও কারও অভ্যাস বিশেষ রাজনৈতিক ছত্রছায়াতে থেকে কর্মসূচিমূলক সিনেমা তৈরি। কারও কারও অভ্যাস বিরোধিতা। সম্প্রতি যে সিনেমাটি নিয়ে এত তর্ক, নিষিদ্ধ করার সমালোচনা- সেই সিনেমাটির পরিচালকেরও একটি বিশেষ অভ্যাস আছে। তা খানিক ওই রাজনৈতিক কর্মসূচির অধীনেই পড়ে। দ্য কেরল স্টোরির নির্মাতা সিনেমাতে পা দিয়েছেন নেহাত কম দিন হলো না। প্রায় ১৭ বছর আগে চলচ্চিত্র জগতে এসেছেন জলপাইগুড়ির বাঙালি ব্যক্তিত্ব সুদীপ্ত সেন। মূলত পরিচালক এবং লেখক হিসেবেই ২০০৬ সালে আত্মপ্রকাশ। এখনও অবধি বেশিরভাগই স্বাধীন প্রযোজনার চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন সুদীপ্ত সেন। দ্য কেরল স্টোরিই এখনও পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে চর্চিত চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে।

দ্য লাস্ট মঙ্ক নামে এক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পরিচালনায় হাতেখড়ি সুদীপ্ত সেনের। তবে ধর্ম থেকে বিশেষ নড়েননি চড়েননি সুদীপ্ত। এই লাস্ট মঙ্ক সিনেমাটির বিষয়ও ছিল ধর্ম। সিনেমাটি এমন একজন মহিলার জীবনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল যিনি অভিজাত পরিবারের ছায়া থেকে বেরিয়ে অবশেষে বৌদ্ধ ধর্মে যোগ দেন এবং শান্তি ও প্রশান্তির জীবনের সন্ধানে লাদাখে চলে যান। তবে আসল গল্প রয়েছে তাঁর অন্য একটি চলচ্চিত্রে। সুদীপ্ত সেন পরিচালিত অন্যান্য সিনেমার মধ্যে রয়েছে আসমা, গুরুজি: আহেড অব টাইম, লখনউ টাইমস, গুরুজানা এবং ইন দ্য নেম অব লাভ। তাঁর স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্রের মধ্যে রয়েছে আখনূর, ইন্ডিয়ান অটাম এবং ব্যাটল অব সরাইঘাট। দ্য কেরল স্টোরিই সুদীপ্ত সেন পরিচালিত প্রথম মূলধারার চলচ্চিত্র, যা সারাদেশে মুক্তি পেয়েছে। আর ঠিক বছর কয়েক আগে তাঁর ইন দ্য নেম অব লাভ সিনেমাটি প্রদর্শিত করতে গিয়ে পড়ুয়াদের বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয় তাঁকে।

আরও পড়ুন- ঠিক কোন কারণে বাংলায় নিষিদ্ধ দ্য কেরল স্টোরি?

পরিচালক সুদীপ্ত সেনের সিনেমা ইন দ্য নেম অব লাভ — মেলানকোলি অব গডস ওন কান্ট্রি-ও ছিল লাভ জিহাদের উপর। জোর করে হিন্দু মহিলাদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে ধর্মান্তরিত করার বিষয়টি নিয়েই সিনেমা করেছিলেন তিনি। দিল্লিতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সিনেমা প্রদর্শনের সময় বিক্ষোভ ওঠে চরমে। পরিচালক অভিযোগ করেছিলেন, হেনস্থা করা হয়েছে তাঁকে। দক্ষিণপন্থী অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) এবং অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সহ বামপন্থী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিক্ষোভ হিংসার পথে যায়।

আসলে সুদীপ্ত সেন তাঁর এই সিনেমাতেও নিশানায় রেখেছিলেন কেরলকেই। তাঁর অভিযোগ, কেরলে জোর করে গণ ধর্মান্তর করা হয় মহিলাদের। মুসলিম পুরুষদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের মাধ্যমে হিন্দু মহিলাদের ধর্মান্তরিত করার নাকি 'ইসলামি ষড়যন্ত্র' এটি। সেই সময়, দ্য প্রিন্টকে সুদীপ্ত সেন জানিয়েছিলেন, ২০১০ সালে কেরলে সিপিআই(এম)-এর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ভি.এস. অচ্যুতানন্দন বলেছেন যে ভারতের র‍্যাডিক্যাল পপুলার ফ্রন্টের লক্ষ্য "কেরলকে আগামী ২০ বছরে একটি মুসলিম দেশে পরিণত করা।" তাই সুদীপ্ত সেন নাকি তাঁর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সত্য খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন যে মহিলাদের কেন জোর করে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে।

ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের ঠিক কতটা কাছের মানুষ সুদীপ্ত সেন? কোনও সম্পর্কই নেই বলে দাবি করেছিলেন সুদীপ্ত। এই সিনেমাটিও নাকি 'লাভ জিহাদ' নিয়ে নয় মোটেও। উল্টে সুদীপ্ত সেন বলেছিলেন, “প্রথমত, আমি স্পষ্ট করে দিই যে আমি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) বা ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্তর্গত নই। আমি একটি কমিউনিস্ট পরিবার থেকে এসেছি এবং 'লাভ জিহাদ'-এ বিশ্বাস করি না, এটি এমন একটি ধারণা যা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের প্রচার করছেন এবং এটিই আমি আমার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলাম। আমার ছবিতে, আমি শুধুমাত্র কেরলে মুসলিম মহিলাদের জোর করে ধর্মান্তরিত করার কথা বলছি, যা বিপুল সংখ্যায় ঘটছে।"

"আমি সিনেমাতে যা দেখিয়েছি তা প্রমাণ করার জন্য আমার কাছে সমস্ত নথি এবং প্রমাণ রয়েছে। আসলে, আমি ৫০০ জনেরও বেশি মেয়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছি যারা কেরলে ধর্মান্তরিত হয়েছে। তাদের বেশিরভাগই কালিকট, মল্লাপুরম, কাসাগরের বাসিন্দা,” দ্য প্রিন্টকে জানিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন।

নিজের সপক্ষে একাধিক যুক্তি সাজিয়ে সুদীপ্ত বলেছিলেন, “এই এলাকার প্রতিটি থানায় মেয়েদের নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হিন্দু মেয়েদের তুলে নিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। এটাই আমি আমার ছবিতে দেখিয়েছি। লাভ জিহাদ বলে কিছু নেই… যদি কোনও মেয়ে যে কোনও ধর্মের পুরুষকে বিয়ে করতে চায়, সে তা করতে স্বাধীন, ধর্মান্তরের তো কোনও প্রয়োজন নেই। তারা বিশেষ বিবাহ আইনের অধীনে বিয়ে করতে পারে। সমস্যা হলো জোর করে ধর্মান্তরিত করা নিয়েই।”

তাহলে হঠাৎ চলচ্চিত্রের প্রথম প্রদর্শনীর জন্য JNU-কে বেছে নিয়েছিলেন সুদীপ্ত সেন? “JNU হচ্ছে বুদ্ধিজীবীদের কেন্দ্রস্থল। আমি ভেবেছিলাম, আমি যদি এমন সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে চাই তবে এটিই প্রথম স্থান হওয়া উচিত যেখানে আমি আমার চলচ্চিত্র প্রদর্শন করব,” বলেছিলেন সুদীপ্ত। তাহলে তাঁর ছবির প্রদর্শনের আয়োজক কেন আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত সংস্থা বিবেকানন্দ চিন্তা মঞ্চ?” সুদীপ্তর দাবি ছিল, আরএসএসের সংস্থা যে এই সিনেমার প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে তা জানতেনই না তিনি। চলচ্চিত্র নির্মাতাও আরএসএস বা বিজেপির সঙ্গে যুক্ত এমন ধারণা মানতে চাননি তিনি।

আরও পড়ুন- অশান্তির আতঙ্কে বাংলায় নিষিদ্ধ! মাত্র ৪ দিনে দেশজুড়ে ‘দ্য কেরল স্টোরি’র আয় কত?

এখন, এই ২০২৩ সালে এসে সুদীপ্ত সেন তৈরি করলেন দ্য কেরলা স্টোরি। ফের সেই কেরল, ফের সেই ধর্মান্তরকরণ এবং জঙ্গি তৈরি। সুদীপ্ত তাঁর সিনেমা মুক্তির আগেই ট্রেলারে দাবি করে বসেন, কেরলের ৩২,০০০ মহিলা ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ISIS-এ যোগ দিয়েছেন৷ বিতর্ক হয়, আদালত তথ্য প্রমাণ চাইলে দুম করে ৩২ হাজার থেকে নেমে ৩-এ চলে আসেন সুদীপ্ত! কিন্তু তাঁর কাছে নাকি প্রমাণ রয়েছে, যে প্রমাণ তিনি এখনও কাউকে দেখাননি৷

তবে গল্প বলছে অন্য কথা। আট বছর আগে, ২০১৫ সালে দিল্লিতে আরএসএসের দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন 'কমিউনিস্ট পরিবারের ছেলে' সুদীপ্ত সেন। ২০১৫-২০১৬ এই সময়ের মধ্যে, কেরলে আইএসআইএসের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারির একাধিক ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। সুদীপ্ত সেন আরএসএস সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার পরে ওই নেতারাই কেরলের 'উগ্রবাদ' সম্পর্কে সুদীপ্তর জ্ঞানচক্ষু উন্মোচন করেন।

আরএসএসের তরফে জানা গিয়েছে, কেরলে আরএসএস-সমর্থিত স্বেচ্ছাসেবী একটি সংগঠন আছে, আরশা বিদ্যা সমাজান। এই সংস্থায় যান সুদীপ্ত সেন। এই এনজিও ইসলামে ধর্মান্তরিত কিছু মহিলাকে উদ্ধার করেছে এবং নিজেদের ধর্মে ফিরে যেতে বাধ্য করেছে। সুদীপ্ত সেন নাকি এই মহিলাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেই গল্প শুনেই সুদীপ্ত তাঁর গবেষণা শুরু করেন। ইউটিউব চ্যানেল 'ফেস্টিভ্যাল অব ভারত'-এ একটি সাক্ষাত্কারে, পরিচালক দাবি করেছেন, ২০১০ সালে, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ওমেন চান্ডি কেরল বিধানসভায় একটি রিপোর্ট পেশ করেছিলেন যাতে বলা হয়েছিল, "প্রতি বছর প্রায় ২৮০০-৩২০০ মেয়েকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে।" সুদীপ্ত সেন সাক্ষাত্কারে বলেছেন, "দশ বছরের জন্য এই সংখ্যাটি গণনা করলে তা ৩২,০০০-৩৩,০০০-এই দাঁড়ায়। বাস্তবে, এই পরিসংখ্যান উল্লিখিত রয়েছে ২০১০ সালের এমন কোনও নথিই মেলেনি। "কান্ট্রি রিপোর্টস অন টেররিজম ২০২০: ইন্ডিয়া" শীর্ষক মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন অনুসারে, "নভেম্বর পর্যন্ত ৬৬ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইএসআইএসের সঙ্গে যুক্ত ছিল (২০২০)।” সিনেমাটির দাবি, যে চারজন মহিলার গল্পের উপর ভিত্তি করে সিনেমাটি নির্মিত, যারা ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিল এবং ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ISIS-এ যোগ দিতে তাদের স্বামীদের সঙ্গে আফগানিস্তানে গেছিল, তারা বর্তমানে একটি আফগান কারাগারে বন্দি রয়েছে।

More Articles