মীরা নায়ারের পুত্র, মোদি সমালোচক— নিউ ইয়র্ককে দিশা দেখাবেন ভাবী মেয়র মামদানি?
Zohran Mamdani: বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানির সন্তান হলেন জোহরান মামদানি।
এমনিতে আমেরিকার প্রায় সমস্ত খবর, ট্রাম্পের সমস্ত গতিবিধি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিষ্ঠাভরে প্রকাশ করে থাকে। তবে জোহরান মামদানির ক্ষেত্রে এমনটা ঘটল না। নিউ ইয়র্ক সিটির ডেমোক্র্যাটিক মেয়র পদে জয়ী হয়েছেন মামদানি। তবে ভারতীয় মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সেই খবর নেই কোথাও। সত্যি কথা বলতে গেলে, মামদানি এই মেয়র নির্বাচনের দৌড়ে এগিয়েও ছিলেন না, তবে নির্বাচনের ঠিক আগে একটি সমীক্ষায় তিনি কিছুদিন ধরেই দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন। কেউই মামদানির ব্যাপক জয় আশা করেনি, সম্ভবত মামদানি নিজেও নন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচন ভারতের কাছে কেনই বা গুরুত্বের হতে যাবে? আসলে মামদানির জয়ের খবরটি প্রচার হওয়ার কিন্তু যথেষ্ট কারণ ছিল। মামদানি এই পদের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান। নিউ ইয়র্ক সিটি কোনও ছোট্ট অঞ্চল নয়, বিশাল। এর জনসংখ্যা প্রায় ৮.৫ মিলিয়ন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২টি রাজ্য ছাড়া অন্য সমস্ত রাজ্যের চেয়ে বেশি এবং এর পরিচালনা বাজেট ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি, যা দিল্লির প্রায় দশগুণ। তবু মামদানিকে ভারত মনে রাখতে চাইল না।
মামদানি দক্ষিণ এশিয়দের কাছে বিশাল প্রচার চালিয়েছিলেন। উর্দু আর হিন্দিতে বলিউডি থিম ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। জোহরান মামদানির আরেকটি পরিচয় বললে হয়তো সাধারণ ভারতীয়দের কাছে তিনি কিঞ্চিৎ পরিচিত হতে পারেন। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার এবং ভারতীয় বংশোদ্ভূত উগান্ডার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মাহমুদ মামদানির সন্তান হলেন জোহরান মামদানি। বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ও সৃজনশীল শহরের মেয়র হলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত একজন, যাঁর শিকড়ে আছেন মীরা নায়ারের মতো শিল্পী, অথচ ভারতীয় মিডিয়া সেই কাহিনিকে গুরুত্বই দিল না। কেন এমন নীরবতা?

বাবা, মা ও স্ত্রীর সঙ্গে জোহরান মামদানি
আরও পড়ুন- চার দশকের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষা! খামেনির পতন কি আসন্ন?
এর ছোট্ট, টু দ্য পয়েন্ট, অপ্রিয় উত্তরটি হলো মামদানি একজন মুসলিম, শিয়া মুসলিম। অভিযোগ, ভারতে গত কয়েক বছর ধরে হিন্দুত্বের বাইরে বাকি সবই ক্রমে তুচ্ছ হয়ে উঠছে। প্রীতি প্যাটেলের মতো ভারতীয় বংশোদ্ভূত, ঋষি সুনকের মতো নিষ্ঠাবান 'হিন্দু'-র কথা — যাদের ভারতীয় সংযোগ মামদানির চেয়েও ক্ষীণ, যাঁদের দক্ষিণ এশিয়ায় কোনও প্রভাবই নেই— ভারত ঢালাও উদযাপন করলেও মামদানি ব্রাত্যই থেকে যান। নিন্দুকেরা বলেন, মুসলিম, শিখ এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য সরকারের হাতে সময় খুব কম। হয় ভারতে তাঁদের উপেক্ষাই করা হয় বা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অথচ বিজেপি সরকার 'অখণ্ড ভারত'-এর কথা প্রচার করতে চায়। অখণ্ড ভারত অর্থাৎ বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রয়েছে। তবে সেখানেও, এই বিভেদটুকুকে মান্যতা দিয়েই চলেছে বিজেপি সরকার, বলছেন বিশ্লেষকরা।
৩৩ বছরের জোহরান মামদানি সাত বছর বয়সে নিউ ইয়র্কে চলে আসেন। তিনি মেইনের বোডোইন কলেজ থেকে আফ্রিকানা স্টাডিজে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতিতে আসার আগে একজন হাউজিং কাউন্সেলর হিসেবে কাজ করতেন তিনি, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিকে উচ্ছেদ রোধে সহায়তা করতেন। ২০২০ সালে প্রথম নিউ ইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে, তিনি কুইন্সের অ্যাস্টোরিয়ার থেকে জিতে ৩৬ তম জেলা থেকে নির্বাচিত হন। এই বছরের শুরুতেই, ব্রুকলিনে ২৭ বছরের সিরিয়ান শিল্পী রামা দুওয়াজিকে বিয়ে করেন মামদানি।
মামদানি গাজার বিরুদ্ধে ইজরায়েলের যুদ্ধের সমালোচনাকারী সবচেয়ে সোচ্চার মানুষদের মধ্যে একজন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে মেহেদি হাসানের একটি সাক্ষাৎকারে মামদানিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্ক সফর করলে তিনি কী করবেন? মামদানি স্পষ্ট উত্তর দিয়েছিলেন, "মেয়র হিসেবে, নিউ ইয়র্কে এলে আমি নেতানিয়াহুকে গ্রেফতার করতাম!" এমন একজন মানুষের কথা যে, ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও ভারতীয় মূলধারার গণমাধ্যমে উঠে আসবে না, তাই স্বাভাবিক।

রামা দুওয়াজি
আরও পড়ুন- ইউক্রেনের সঙ্গে খনিজ চুক্তির আড়ালে যা করতে চাইছে আমেরিকা
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের বাইরে থাকা ভারতীয় এবং আরও বৃহৎ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়দের মধ্যে যে সহজ ঐক্য ও মিলনের ক্ষেত্রটি ছিল, মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার সময়কালে সেই আত্মবোধটি শেষ হয়ে গেছে। মোদি তাঁর প্রথম শপথগ্রহণে সময় দক্ষিণ এশিয়ার সমস্ত রাষ্ট্রপ্রধানকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অংশে ভারতের যে সদিচ্ছা এবং অবস্থান ছিল তা হারিয়ে গেছে। ২০১৪ সালে ভারত আফগানিস্তানের সরকারের অন্যতম বৃহত্তম দাতা ছিল, আজ তালিবানদের পক্ষ নিচ্ছে সেই দেশই। সেই সময়ে, ভারত মায়ানমারে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সাহায্যকারী অন্যতম প্রধান দেশ ছিল, এখন মণিপুরে হিংসার কারণে ভারত নিজেদের সরিয়ে আনছে এবং মায়ানমারে তাদের একমাত্র মধ্যস্থতাকারী হচ্ছে সামরিক জুন্টা। ২০১৪ সালে, চিনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সত্ত্বেও, বাংলাদেশে ভারতের অবস্থান ভালো ছিল। ভারত-বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা এখন কী, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৪ সালে, নওয়াজ শরিফ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে লড়াই করেছিলেন। আজ, আকাশসীমাও একে অপরের জন্য বন্ধ।
রাজনীতিতে ভারতীয় ও দক্ষিণ এশিয় আমেরিকানদের অংশগ্রহণের প্রচারকারী সংস্থা ইন্ডিয়া ইমপ্যাক্ট ফান্ড জোহরান মামদানিকে সমর্থন করলেও, ইন্ডিয়ান আমেরিকানস ফর কুওমো নামে একটি দল এবং আমেরিকান হিন্দু কোয়ালিশন তাঁকে আক্রমণ করেছে। এর মূল কারণ হচ্ছে, মামদানি ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সমালোচনা করার মতোই মোদিরও সমালোচনা করেছেন। মামদানির ব্যাপক বিজয়ে দক্ষিণ এশিয়দের শক্তিশালী অবদান রয়েছে। কিন্তু ভারতের নীতির কারণেই দক্ষিণ এশিয়ার বাইরেও আমাদের দেশ ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে উঠছে। সামাজিকভাবে ক্রমশ দুর্বল হতে থাকা ভারত একাই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

Whatsapp
