কলের মিস্ত্রির মুখোশে খলিস্তানি জঙ্গি! ভারত-কানাডা সম্পর্কের কাঁটা হরদীপ আসলে কে?
Hardeep Singh Nijjar: কানাডা যে দিনে দিনে খলিস্তানিদের পীঠস্থান হয়ে উঠছে, এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই আশঙ্কা প্রকাশ করে এসেছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক।
খলিস্তানি প্রসঙ্গে ক্রমশ জটিল হচ্ছে কানাডা-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। দিন কয়েক আগেই জি-২০ বৈঠক উপলক্ষে ভারতে এসেছেন কানাডার প্রেসিডেন্ট জাস্টিন ট্রুডো, নয়াদিল্লিতে থেকেওছেন দিন দু'য়েক। কিন্তু রাষ্ট্রপতির ডাকা নৈশভোজে যোগ দেননি তিনি। যেন ইচ্ছা করেই তফাৎ রাখলেন ট্রুডো। আস্তে আস্তে কি তবে ভাঙছে দু'দেশের মধ্যিকার মৈত্রীসেতু। বিঁধে রয়েছে কাঁটা? দীর্ঘদিন ধরেই কানাডার বিরুদ্ধে খলিস্তানি কার্যকলাপে মদত দেওয়ার অভিযোগ আনছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক। সম্প্রতি খলিস্তানি নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জরের মৃত্যু নিয়ে পাল্টা ভারতকেই কাঠগড়ায় তুলল জাস্টিন ট্রুডো সরকার। কানাডানিবাসী ওই খলিস্তানি নেতার হত্যাকাণ্ডে ভারতেরই হাত রয়েছে বলে গোড়া থেকেই ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। এবার কার্যত নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিতেই ওই ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ভারতীয় এক শীর্ষ কূটনীতিককে বরখাস্ত করল কানাডা সরকার। তবে কি খলিস্তানি প্রসঙ্গেই কিনারায় পৌঁছবে দু'দেশের সম্পর্ক। সেটাই এখন ভাবাচ্ছে কূটনীতিকমহলকে।
খলিস্তানি নেতা হরদীপ সিংহ নিজ্জর। বয়স পঁয়তাল্লিশের আশপাশে। ভারতের চোখে সে দাগী। নিষিদ্ধ সংগঠন খলিস্তানি টাইগার ফোর্স (কেটিএফ)-এর প্রধান হরদীপের বিরুদ্ধে রয়েছে পঞ্জাবের জলন্ধরে এক পুরোহিত হত্যা-সহ একাধিক অভিযোগ। ২০২০ সালে হরদীপকে কালো তালিকাভুক্ত করে ভারত। এমনকী তার নামে জারি হয় ১০ লক্ষ টাকার ইনাম। এ হেন 'মোস্ট ওয়ান্টেড' হরদীপ অনেকদিন ধরেই কানাডার বাসিন্দা। ১৯৯৭ সালে কানাডায় চলে যান হরদীপ। সেখানেই কলের মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করত সে। গত জুন মাসে কানাডার সারে শহরের একটি গুরুদ্বারের কাছে হরদীপের উপরে গুলি চালায় দুই অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতি। ওই গুরুদ্বারের সভাপতিও ছিলেন হরদীপ সিং নিজ্জর, সেখানেই চলে হামলা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় হরদীপের। কী কারণে খুন, তা এখনও পরিষ্কার নয়। ঘটনায় গ্রেফতার হয়নি একজনও।
আরও পড়ুন: তলোয়ার উঁচিয়ে থানা ঘেরাও! পঞ্জাব কি তবে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে?
এর পর থেকেই শুরু হয়েছে দোষারোপের খেলা। ভারতের কালো তালিকাভুক্ত জঙ্গি হরদীপের হত্যাকাণ্ডের দায় নয়াদিল্লির কাঁধেই তুলে দিয়েছে কানাডা। নিজ্জর যে জঙ্গি সংগঠনকে নেতৃত্ব দিতেন, সেই সংগঠনটিকে ২০২০ সালে পুরোপুরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া হয় ভারতে। এদিকে, ভারতের তরফের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরেই কানাডায় মদত পাচ্ছে খলিস্তানি সংগঠনগুলো। সে অভিযোগ অবশ্য পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়াও যায় না। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। চলতি বছরের জুন মাসের ঘটনা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুমুহূর্তের পুনর্নিমাণ করে কানাডার ব্রাম্পটন শহরের রাস্তায় ট্যাবলো বের করে খলিস্তানিপন্থি একদল বিচ্ছিন্নতাবাদী। সেই ভিডিও ভাইরাল হয় সোশ্যাল মিডিয়ায়। যা নিয়ে বেশ হইচই পড়ে গিয়েছিল। ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিল ভারতের বিদেশমন্ত্রক। এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে এই বর্বরোচিত আচরণকে ভালো চোখে দেখেননি কেউই। তবে সে সময় দু'দেশের সার্বভৌমত্ব, একতা ও ভৌগলিক অখণ্ডতাকে মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছিল মোদি, ট্রুডো-দু'পক্ষই। তবে সেই সমস্ত সৌজন্যের ধার না ধরেই এবার সরাসরি পদক্ষেপ করল কানাডা। যা দু'দেশের সম্পর্কের পক্ষে স্বাস্থ্যকর না-ও হতে পারে বলে আন্দাজ করছে ওয়াকিবহাল মহল।
ভূখণ্ডের দাবিতে এ দেশে বারবার মাথাচাড়া দিয়েছে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী দল। কাশ্মীর থেকে শুরু করে পঞ্জাব। কত যে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী সব ঘটনা, গুলি-বোমা-বন্দুকের নৃশংসতা দেখেছে দেশ, তা গুনে শেষ করা কঠিন। দীর্ঘদিন ধরেই পঞ্জাবকে পৃথক দেশ হিসেবে দাবি করে আসছে বিচ্ছিন্নতাকামী খলিস্তানিরা। সেই দাবি আজও একই রকম ভাবে বহাল। সেই ভূখণ্ডের দাবিতে কখনও ঘটেছে অপারেশন ব্লু স্টার, আর তার রেশ ধরেই গোছানো হয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে খুনের পরিকল্পনা। নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল ইন্দিরার। তার পরে দেশ অনেক কিছু দেখেছে। ক্ষোভের আগুন দেখেছে, হিংসা দেখেছে। কয়েকজন বিচ্ছিন্নতাকামীর জন্য রোষের মুখে পড়তে হয়েছে অসংখ্য শিখ সম্প্রদায়ের মানুষকে। নিরপরাধ, নির্বিবাদী শিখদের ঘরবাড়ি জ্বলেছে, জমেছে লাশের পাহাড়।
কানাডা যে দিনে দিনে খলিস্তানিদের পীঠস্থান হয়ে উঠছে, এ নিয়ে অনেক দিন ধরেই আশঙ্কা প্রকাশ করে এসেছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক। শুধু তাই নয়, কানাডার কাছে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোরও অভিযোগ উঠেছে খলিস্তানিদের বিরুদ্ধে। সে দেশের মাটিতে লাগাতার ভারত-বিরুদ্ধ কার্যকলাপ চালাচ্ছে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এ ব্যাপারে জাস্টিন ট্রুডো সরকারের সঙ্গে আলোচনাও করে ভারত। খলিস্তানিরা ভারত-কানাডা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে টলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে বলেও অনেকদিন ধরে অভিযোগ করেছে ভারতের বিদেশমন্ত্রক।
গতবছর গোড়ায় জার্মানি থেকে ধরা পড়েছিল নিষিদ্ধ সংগঠন ‘শিখস ফর জাস্টিস’-এর সদস্য জসবিন্দর সিং মুলতানি। এর আগে লুধিয়ানা বিস্ফোরণের ঘটনাতেও জড়িত ছিল সে। ওই খলিস্তানি জঙ্গিকে জেরা করে পুলিশের হাতে উঠে এসেছিল ভারতকে রক্তাক্ত করার মাস্টারপ্ল্যান। সেই পরিকল্পনায় শুধু খলিস্তানিরা নয়, জড়িত ছিল পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইও। পাকিস্তানের মদতে যে ভারতের বিরুদ্ধে যে এমন একাধিক ষড়যন্ত্র আঁটছে খলিস্তানিরা, সে কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তখনই। আর সেই ষড়যন্ত্রের শিকড় পৌঁছয় কানাডাতেও।
নিহত এই খলিস্তানি নেতা যে শুধুমাত্র কেটিএফ-এর মাথা ছিল, তাই নয়। 'শিখস ফর জাস্টিস' সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত ছিল এই হরদীপ। ২০০৭ সালে লুধিয়ানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত, জড়িয়ে ছিল ২০১০ সালে পাটিয়ালার বিস্ফোরণের ঘটনাতেও। পঞ্জাবে এক আরএসএস নেতাকে খুনের ঘটনাতেও হাত ছিল হরদীপেরই। জানা গিয়েছে, ২০১৩-১৪ সালে একবার পাকিস্তানেও যায় সে। সেখানে গিয়ে কেটিএফ নেতা জগতার সিং কারার সঙ্গেও দেখা করেন তিনি। ২০১৫ সালে তার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার মিসিজেন পাহাড়ে খলিস্তানি জঙ্গিদের জন্য গোপন প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজনের অভিযোগ আনে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। গোয়েন্দাদের রিপোর্টে জানা যায়, সেই ক্যাম্পে নানা ধরনের অস্ত্রশিক্ষা চলত প্রতিনিয়ত। এখানেই শেষ নয়। তারার নেতৃত্বাধীনন বাব্বর খালসা ইন্টারন্যাশনাল নামে আরও একটি খলিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করত সে। ২০১৬ সালেও এমন প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন করেছিল সে। এ হেন দুর্ধর্ষ জঙ্গিকেই কি আদতে আড়াল করার চেষ্টা করছে কানাডার সরকার? স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছে প্রশ্ন।
আরও পড়ুন:নকশা ফাঁস! ড্রোন ব্যবহার করে জঙ্গি পাঠাতে চাইছে পাকিস্তান?
এদিকে কানাডাতেও কিন্তু পুলিশের খাতায় নাম ছিল হরদীপের। একবার তার নামে লুক আউট সার্কুলার জারি করতে বাধ্য হয় কানাডা সরকার। এমন তার বিরুদ্ধে জারি করা হয় রেড কর্নার নোটিসও। ধরাও পড়ে হরদীপ, তবে পরে ছাড়া পেয়ে যায়। সেই হরদীপকেই কারা যেন গুরুদ্বারের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে পালাল। সেই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কার হাত, তা জানা যায়নি। তবে সেই দায় আপাতত ভারতের কাঁধে ঠেলতে চাইছে কানাডা। ভারত অবশ্য সে সমস্ত দাবিই উড়িয়েছে। কিন্তু এক খলিস্তানি জঙ্গিকে কেন্দ্র করে যেভাবে একে অপরকে কাঠগড়ায় তুলছে কানাডা ও ভারত, তাতে দু'দেশের সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা চিন্তার কথা তো বটেই।