বাইবেল লিখেছিলেন কে? যে রহস্যের উত্তর মেলে না আজও...
Writer of the Bible : বাইবেল কে লিখেছেন এই নিয়ে চারখানা ভিন্ন তত্ত্ব মেলে।
খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ। যিশুর নানা গল্প, নানা কীর্তির বর্ণনা, এর বেশি অন্য ধর্মের কাছে বিস্তারে জানা হয় না বাইবেলকে। অথচ বিশ্বের ইতিহাস সম্পর্কে এক সামগ্রিক গল্প বলে বাইবেল। সৃষ্টি, পতন, মুক্তি এবং জীবিত এবং মৃতদের প্রতি ঈশ্বরের শেষ বিচারের কথা বলা আছে বাইবেলে। ওল্ড টেস্টামেন্ট (৩০০ খ্রিস্টপূর্ব) বিশ্বের সৃষ্টি এবং আদম ও ইভ, ঈশ্বরের প্রতি তাদের অবাধ্যতা এবং ইডেন বাগান থেকে আদম ও ইভকে তাড়িয়ে দেওয়া থেকেই এই কাহিনির শুরু। নিউ টেস্টামেন্ট আবার যিশুর জীবন, মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের মাধ্যমে মানবতার মুক্তির কথা বলে। খ্রিস্টধর্মের প্রথম ৪০০ বছরে নিউ টেস্টামেন্ট গ্রহণের বিষয়টা খুব স্বচ্ছ ছিল না। অবশেষে, ৩৬৭ খ্রিস্টাব্দে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ২৭টি বইকে মান্যতা দেয়। সে তো হলো। কিন্তু বাইবেলের রচয়িতা আসলে কে?
বাইবেল কে লিখেছেন এই নিয়ে চারখানা ভিন্ন তত্ত্ব মেলে।
১. ঈশ্বর নিজেই বাইবেল লিখেছেন
খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা মোটামুটি এই বিষয়ে একমত যে বাইবেলয়ের কথার মধ্যে এক অদ্ভুত কর্তৃত্ব আছে। অনেকেই বিশ্বাস করেন ঈশ্বরেরই প্রকাশিত বাণী বাইবেল। কিন্তু এর অর্থ কী তা নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। অনেক বিশ্বাসীই মনে করেন বাইবেলের শব্দগুলি ঈশ্বরের লিখিত। ঈশ্বরই বাইবেলের লেখকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন এই কথাগুলি লেখার।
মধ্যযুগীয় ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে জড়িতরা এই বিশ্বাসই রাখতেন। ক্যাথলিক ধর্মতাত্ত্বিক থমাস অ্যাকুইনাস ১৩ শতকে বলেন, এই পবিত্র লেখার লেখক হলেন ঈশ্বর। এই লেখার প্রতিটি শব্দের বিভিন্ন নির্যাস থাকতে পারে, অর্থাৎ এটি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন- কোনওকালেই নাকি ক্রুশবিদ্ধ হননি যিশু! চাঞ্চল্যকর দাবি বাইবেলে
ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন প্রোটেস্ট্যান্টবাদ ১৫০০-র দশকে ইওরোপে ছড়িয়ে পড়ে। খ্রিস্টধর্মের ক্যাথলিক এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স ঐতিহ্যের পাশাপাশি গির্জার একটি নতুন দল গঠিত হয়। প্রোটেস্ট্যান্টরা 'সোলা স্ক্রিপ্টুরা'-র উপর জোর দিয়েছিল, যার অর্থ বাইবেলের পাঠ্যই গির্জার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব। প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারক জন ক্যালভিন ঘোষণা করেন: প্রফেট বা নবীরা নিজেদের কথা বলেননি স্বর্গ থেকে তাঁদের যা ঘোষণা করার জন্য নিযুক্ত হয়েছিল তারা সেটাই লিখে গেছেন। খ্রিস্টিয় ইতিহাসের প্রথম ১,৭০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটিই সত্য ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ১৮ শতক থেকে, ইতিহাস এবং বিজ্ঞান বাইবেলের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করে। ধর্মগ্রন্থে কোনও ধরনের ত্রুটি যে নেই এই নিয়ে চারদিকে হইচই পড়ে যায়। ২০ শতকের গোড়ার দিকে মৌলবাদী আন্দোলন শুরু হয়।
২. ঈশ্বরই বাইবেল লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছেন
আরেকটি তত্ত্বে বলে, লেখকদের ঈশ্বর অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। অর্থাৎ ঈশ্বর এবং মানুষ দুইয়ে মিলে বাইবেল লিখেছেন। প্রোটেস্ট্যান্টিজমে বিশ্বাসীরা বলেন, বাইবেল মানুষের দ্বারা লিখিত হলেও ঈশ্বরের প্রভাব তাতে সবচেয়ে বেশি। প্রোটেস্ট্যান্টরা বিশ্বাস করত ঈশ্বরের সার্বভৌমত্ব মানুষের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। ক্যাথলিকরা ঐশ্বরিক সার্বভৌমত্বের ঊর্ধ্বে মানুষের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতেই বেশি আগ্রহী ছিল। ১৬২০-র দশকের গোড়ার দিকে স্প্লিটের আর্চবিশপ, মার্কানটোনিও ডি ডোমিনিস বাইবেলের দু'টি অংশকে আলাদা করেন, যেগুলি ঈশ্বরের দ্বারা লিখিত, এবং যেগুলি মানুষের দ্বারা। পরবর্তীতে, তিনি বিশ্বাস করেন যে বাইবেলে ত্রুটি ঘটতেই পারে।
৩. ঈশ্বর লেখকদের অনুপ্রাণিত করেছেন: উদারপন্থা
১৯ শতকের সময় প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক- দুই বিশ্বাসীরাই মনে করেন বাইবেলের লেখকরা ঈশ্বর অনুপ্রাণিত ছিলেন ঠিকই কিন্তু তারা তাদের লেখাগুলি যে সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন তা পূর্ব নির্ধারিত ছিল। ১৮৬৮ সালে, একটি রক্ষণশীল ক্যাথলিক চার্চ বলে বাইবেল সরাসরি ঈশ্বর লিখিত। ভ্যাটিকান ১ নামে পরিচিত চার্চের কাউন্সিল ঘোষণা করেছিল যে, ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্ট দুই-ই 'পবিত্র আত্মার অনুপ্রেরণায় লেখা, তাদের লেখক ঈশ্বর।'
আরও পড়ুন- যিশু নেই, সান্তা নেই! ক্রিসমাসে বেথলেহেমের এই চেহারা আগে দেখেনি বিশ্ব
৪. মানুষই কোনও ঐশ্বরিক সাহায্য ছাড়াই বাইবেল লিখেছে
সবচেয়ে উদারপন্থী খ্রিস্টানরা বাইবেলের ঐতিহাসিক বা বৈজ্ঞানিক নির্ভুলতা বা অপূর্ণতার প্রশ্নে মনে করেন মানুষই বাইবেলে লিখেছে। বাইবেল কে লিখেছেন এই প্রশ্নে তারা চার জনের নাম করেন, ম্যাথিউ, মার্ক, লুক এবং জন – এরা চারটি গসপেলের লেখক। ওল্ড টেস্টামেন্টের ৩৯টি বইয়ের বিষয়বস্তু ইহুদি হিব্রু বাইবেলের ২৪টি বইয়ের মতোই।
মনে করা হয়, চারটি গসপেলের লেখকদের মধ্যে ম্যাথিউ এবং জন, মার্ক যিশুর শিষ্য পিটারের সহচর, এবং লুক হচ্ছেন পলের সহচর, যিনি প্রথম শতাব্দীতে গ্রিকো-রোমান বিশ্বে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করেছিলেন। গসপেল তৈরির তারিখ দেখে বোঝা যায়, যিশুর জীবনের প্রত্যক্ষদর্শীরা মোটেই এগুলি লেখেননি। প্রাচীনতম গসপেল, মার্ক (৬৫-৭০ খ্রিস্টাব্দ) যিশুর মৃত্যুর প্রায় ৩০ বছর পরে (২৯-৩৪ খ্রিস্টাব্দ) লেখা হয়েছিল। শেষ গসপেল, জন (৯০-১০০ খ্রিস্টাব্দ) যিশুর মৃত্যুর প্রায় ৬০-৯০ বছর পরে লেখা হয়েছিল।
মজার বিষয় হলো, অ্যাপোক্রিফা নামে পরিচিত একটি রচনা ওল্ড এবং নিউ টেস্টামেন্টের (৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী) সময়কালে লেখা হয়েছিল। ক্যাথলিক চার্চ এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স খ্রিস্টান ঐতিহ্যগুলি এগুলিকে বাইবেলের অংশ হিসাবে বিবেচনা করে, কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চগুলি তা মনে করে না।

Whatsapp
