১১০ বছরে এই প্রথম! কেন দার্জিলিং চা বিক্রি বন্ধ হয়ে গেল পর্যটকপ্রিয় গ্লেনারিজে
Glenary's Darjeeling Tea: চা বাগান মালিকদের বক্তব্য, চা বাগানগুলির আসল সর্বনাশের মূলে রয়েছে ২০১৭ সালের ১০৫ দিন ব্যাপী টানা বনধ। সেই সময়ে আন্দোলনকারীরা চায়ের উৎপাদন বন্ধ রেখে দার্জিলিংয়ের চা রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দ...
শৈল শহর দার্জিলিং। দার্জিলিং মানেই ম্যাল। ম্যাল মানেই গ্লেনারিজ। দার্জিলিং গিয়েছেন কিন্তু গ্লেনারিজে বসে কাঞ্চনজঙ্ঘা দর্শন করতে করতে দার্জিলিং চায়ে চুমুক দেননি এমন বাঙালি খোঁজা যেন কতকটা খড়ের গাদায় সূচ সন্ধান। দীর্ঘ ১১০ বছর ধরে সেরা মানের দার্জিলিং চা পর্যটকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে গ্লেনারিজ। তবে বর্তমানে কিন্তু গ্লেনারিজে গিয়ে দার্জিলিং চায়ে চুমুক দিতে চাইলে নিরাশ হবেন আপনি। চা বাগানের শ্রমিকদের দুর্গাপুজোর আগে উপযুক্ত বোনাস না দেওয়ার অভিযোগে গ্লেনারিজে বন্ধ দার্জিলিং চা।
পুজোর আগে চা বাগান নিয়ে একটি আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, চা বাগানের কর্মীদের ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে। কিন্তু ২০ শতাংশ বোনাস দুই ভাগে দেওয়া হবে। ১৫ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে দুর্গাপুজোর আগে এবং বাকি ৫ শতাংশ বোনাস দেওয়া হবে কালীপুজোর আগে। রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন গ্লেনারিজের কর্ণধার অজয় এডওয়ার্ড।
ফেসবুকে দার্জিলিংয়ের চা বাগানগুলির শ্রমিকদের পাশে দাঁড়িয়ে অজয় এডওয়ার্ড লিখেছেন, “চা বাগানের কর্মীরা গড়ে ৮০০০ টাকা করে বোনাস পান। সারা বছরে এই একটি মাত্র সময়েই তারা একসঙ্গে হাতে এতটা টাকা পান। কিন্তু রাজ্য সরকার প্রত্যেক বছরই এমন কোনও নীতি গ্রহণ করে যা চা শ্রমিকদের অসুবিধায় ফেলে দেয়।” রাজ্য সরকারের এহেন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে গ্লেনারিজের কর্ণধার জানিয়েছেন, “আমাদের সমাজে দরিদ্রের মধ্যে দরিদ্রতম হল চা বাগানের কর্মীরা। রাজ্য সরকার যতদিন না পর্যন্ত এই নীতি প্রত্যাহার করছে ততদিন পর্যন্ত গ্লেনারিজে বসে চা পান ও চা বিক্রি বন্ধ থাকবে।”
আরও পড়ুন- গ্লেনারিজ: যে চুম্বক লাখো মানুষকে ফিরিয়ে আনে দার্জিলিংয়ে
পাহাড়ের রানি দার্জিলিংয়ের সবথেকে পুরনো ক্যাফে গ্লেনারিজ। ১১০ বছর ধরে একই ভাবে একই মানের খাবার পর্যটক-ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে গ্লেনারিজ কর্তৃপক্ষ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মালিকানায় বদল এলেও চায়ের মান বা অন্যান্য খাবারের গুণগত মানের সঙ্গে কখনোই আপোস করেনি গ্লেনারিজের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। বেকারির জন্য বিশেষ খ্যাতি থাকলেও খোদ দার্জিলিং চা গ্লেনারিজের জনপ্রিয়তার মুকুটে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পালক। দিনে প্রায় ১০০০ পট দার্জিলিং চা বিক্রি হত গ্লেনারিজে। খোলা বারান্দায় বসে কাঞ্চনজঙ্ঘার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখতে দেখতে দার্জিলিংয়ের ফার্স্ট ফ্ল্যাশ অথবা সেকেন্ড ফ্ল্যাশের স্বাদে গন্ধে মজে থাকতেন পর্যটকরা।
দার্জিলিং চায়ের অন্যান্য বিক্রেতারা আবার গ্লেনারিজের মালিকের চা বাগানের কর্মচারীদের প্রতি সহমর্মিতার মধ্যে দেখেছেন রাজনৈতিক স্বার্থ। ম্যাল সহ গোটা দার্জিলিং জুড়ে একমাত্র গ্লেনারিজেই অমিল দার্জিলিং চা। শহরের বাদবাকি প্রতিটি ক্যাফে থেকে চায়ের দোকান সর্বত্রই চায়ের চাহিদা তুঙ্গে। এই পরিস্থিতিতে কেন চা বিক্রি বন্ধ করার পথে হাঁটলেন গ্লেনারিজের মালিক অজয় এডওয়ার্ড, তাই নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিভিন্ন রকমের মতামত তৈরি হয়েছে। গ্লেনারিজের মালিকের এই সিদ্ধান্তের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দার্জিলিং টি প্ল্যান্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতা মহেন্দ্র বনশল বলেন, “এমন ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গ্লেনারিজ কর্তৃপক্ষের ভেবে দেখা উচিত ছিল কেন চা বাগানের শ্রমিকদের সামনে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। শুধু গ্লেনারিজে চা বিক্রি বন্ধ হলে দার্জিলিংয়ের বাকি অংশে এর কোনও প্রভাব পড়বে না।”
প্রায় একই কথা বলেছেন দার্জিলিং, তরাই, ডুয়ার্স প্ল্যান্টেশন ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি জে বি তামাং। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, “গ্লেনারিজে চা বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভাবেই রাজনৈতিক।” চা বাগান মালিকদের বক্তব্য, চা বাগানগুলির আসল সর্বনাশের মূলে রয়েছে ২০১৭ সালের ১০৫ দিন ব্যাপী টানা বনধ। সেই সময়ে আন্দোলনকারীরা চায়ের উৎপাদন বন্ধ রেখে দার্জিলিংয়ের চা রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেই সুযোগে দার্জিলিং চায়ের ট্যাগ ব্যবহার করে বাজারে এসেছিল নেপাল চা। এখনও সেই একই অবস্থা চলছে। বিদেশের বাজারে তাই চা রপ্তানি করতে গিয়ে ক্ষতির মুখে পড়ছেন চা মালিকেরা।
আরও পড়ুন- ভিড়ে ঠাসা দার্জিলিং-গ্যাংটক! গরম থেকে মুক্তি পেতে যান সিকিমের কোলে অচেনা এই গ্রামে
তবে রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির কথা এক বাক্যে নাকচ করে দিয়েছেন অজয় এডওয়ার্ড। তাঁর বক্তব্য, “পাহাড়ের চা শ্রমিকদের সঙ্গে চা বাগানের মালিকেরা যা করেছেন সেটা অত্যন্ত অন্যায়। সামান্য মজুরির বাইরে একমাত্র বোনাসের টাকাই এই পুজোর সময়ে তাঁদের একমাত্র ভরসা। সেই টাকা দেওয়া নিয়ে সরকার ও চা বাগান মালিকদের এই নীতি কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যতদিন না অবধি সিদ্ধান্ত বদল হচ্ছে, ততদিন অবধি চা বিক্রি করবে না গ্লেনারিজ।”
সামনেই দার্জিলিংয়ের পঞ্চায়েত নির্বাচন। হামরো পার্টির নেতা অজয় এডওয়ার্ড রাজনৈতিক অভিসন্ধির তত্ত্ব উড়িয়ে দিলেও পাহাড়ের চা বাগান মালিকদের একাংশের স্পষ্ট বক্তব্য, ভোটের আগে চা বাগানের শ্রমিকদের মন জয় করতেই চা বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গ্লেনারিজের মালিক। রাজনীতির গেরোয় কতদিন গ্লেনারিজের চা পান থেকে বঞ্চিত হবেন পর্যটকরা সেটাই এখন শৈলশহরের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন!