রাধা-কৃষ্ণকে দোলনায় বসানোর রীতি শুরু হয়েছিল কীভাবে?

Jhulan Yatra : শ্রীকৃষ্ণের লীলা আট ধরনের, অর্থাৎ দিন ও রাত্রিকে আট প্রহরে বিভক্ত করা হয়েছে। একেই বলা হয় 'অষ্টকালীন নিত্যলীলা'।

ঝুলন এক আনন্দের উৎসব। মিলনের উৎসব। বর্ষাকালে অনুষ্ঠিত হওয়ায় অনেকে একে বর্ষাকালীন উৎসবও বলেন। শ্রাবণ মাসের শুক্লাপক্ষের একাদশী থেকে পূর্ণিমার দিন পর্যন্ত এই উৎসব পালিত হয়। ‘ঝুলন’ শব্দের অর্থ ঝুলনা বা দোলনা। শব্দটি এসেছে ‘হিন্দোল’ থেকে। হিন্দোল বা হিণ্ডোল (हिंडोल) সংস্কৃত শব্দ। যার অর্থ দোলানো। তাই এর অপর নাম হিন্দোল উৎসব। শ্রীকৃষ্ণের লীলা আট ধরনের, অর্থাৎ দিন ও রাত্রিকে আট প্রহরে বিভক্ত করা হয়েছে। একেই বলা হয় 'অষ্টকালীন নিত্যলীলা'। আটটি সময়চক্রে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সখা, গোপ, গোপী এবং রাধার সঙ্গে বিভিন্ন রসাত্মক লীলা করে থাকেন। এই আটটি লীলা হল— নিশান্তলীলা (রাত্রি শেষ হওয়ার প্রাক্কালে), প্রাতঃলীলা (ভোরবেলায়) ,পূর্বাহ্নলীলা (সকাল), মধ্যাহ্নলীলা (দুপুর), অপরাহ্নলীলা (বিকেল),সায়াহ্নলীলা (সন্ধ্যা), প্রদোষলীলা (রাত্রির শুরুতে) ,নক্তলীলা (রাত্রি)। এই অষ্টকালীন লীলার ধারাবাহিকতায় একটি বিশেষ দিব্যলীলা হল ঝুলন যাত্রা। এই উৎসবের সূচনা হয়েছিল সম্ভবত দ্বাপর যুগে। বৃন্দাবনে। কিন্তু প্রতিবছর ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি স্থানে এই অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। তবে মথুরা , বৃন্দাবন , পুরী , মায়াপুরে ধূমধাম অনেকটাই বেশি।

আরও পড়ুন-

ডাইনোসরের মুখে সরলতার হাসি, বাংলার কোথায় তৈরি হয় ঝুলন যাত্রার পুতুল?

এবার আসি এই ঝুলনের পৌরাণিক কাহিনিতে। একবার ব্রজের গোপীরা স্থির করল শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণকে একসঙ্গে দোলনায় দোলাবে। সার্থক করবে তাদের নয়নযুগল। তাদের এই মনোবাঞ্ছাকে আরও সুমধুর, আরও হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে ষড়ঋতুকে আহ্বান করলেন বৃন্দাদেবী। কে এই বৃন্দদেবী? বৃন্দাদেবী হলেন স্বয়ং তুলসি। বৃন্দাবনের অধীশ্বরী। তিনি ছিলেন শ্রীবিষ্ণুর পরম ভক্ত। বিভিন্ন পুরাণে তাঁকে লক্ষ্মীর অবতার বলা হয়েছে।

বৃন্দাদেবীর আহ্বানে সাড়া দিলেন ষড়ঋতু। একই সময়ে, এক স্থানে ছয়টি ঋতুর সমাহার যা এক বিরল দৃশ্য। ষড়ঋতু অর্থাৎ গ্রীষ্ম ,বর্ষা ,শরৎ , হেমন্ত , শীত , বসন্ত সকলেই নিজ-নিজ সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে হাজির। নির্মল আকাশ নিয়ে গ্রীষ্ম তখন গাছের ডালে ঝলমল করছে। বর্ষার শীতল জলবিন্দু পুষ্পবৃষ্টির মত মাঝেমাঝে ঝরে পড়ছে। চারিদিকে মিষ্টি ফুলের সৌরভ। চারিদিকে কাশফুল থরে-থরে সাজিয়ে রেখেছে শরৎ। সেই সঙ্গে চলছে মেঘ-বৃষ্টির লুকোচুরি খেলা। হালকা কুয়াশার চাদর গায়ে গুটি-গুটি পায়ে উপস্থিত হয়েছে হেমন্ত। চারিদিকে অশোক, পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার গাছে তখন কোকিল দেখে উঠল। বসন্ত সমাগত। এই অনাবিল সৌন্দর্যের আবহে রাধা-কৃষ্ণ আপন খেয়ালে দুলবেন।

বাংলার ঝুলনযাত্রা

ব্রজের গোপীরা সুন্দরভাবে সেজে এলেন রাধাকুণ্ডে। পাশেই ছিল কুঞ্জবন। এদিকে নিকুঞ্জ বনে শ্রীরাধা ও শ্রীকৃষ্ণ অপেক্ষায় আছেন কখন সখিরা তাঁদের ডাকবে। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই লাইন— 'আজ নিকুঞ্জ বনে রত্নাসনে রাধা শ্যামসুন্দর'। কিন্তু কৃষ্ণ তো রসিক। ‘রসরাজ’। তাঁকে পাওয়া কি অতই সহজ? এই লীলাকে আরও সুমধুর করার জন্য তিনি এক অদ্ভুত কাণ্ড করলেন। তিনি শ্রীরাধাকে বললেন আজ তিনি নিজের হাতে তাঁকে সাজাবেন। অবশ্য শ্রীরাধা প্রথমে রাজি না থাকলেও শ্রীকৃষ্ণের কথা কী করে ফেলবেন? এ যে 'বচনং মধুরং'। এই মধুর বচনেই সবাই মোহিত হয়ে যায়।

আরও পড়ুন-

মেঘলা দিনের রথের মেলা আজও রঙিন মাটির পুতুলে

শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতে শ্রীরাধাকে সাজিয়ে দিলেন। গড়ে তুললেন নিজের মনের মত করে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মতো পোশাক, কোঁকড়া চুল , তাঁরই মত পাঁকড়ি বেঁধে দিলেন। অলংকারে অলংকৃত করলেন রাধারানীর সর্বাঙ্গ। কাজল দিলেন দু-নয়নে। কুমকুম রেণু ছড়িয়ে দিলেন। সজ্জিত করার পর শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধাকে ভালো করে দেখছেন। সবই তো ঠিক আছে কিন্তু সমস্যা হল ঠোঁট কীভাবে রক্তিম করবেন। একটু ভেবে শ্রীরাধার মুখে তাম্বুল বা পান দিলেন আর শ্রীরাধার অধরে লাল রং খেলে গেল। তাঁর হাতে দিলেন বাঁশি সেই মোহন বাঁশি। দু-জনেই একইরকম সজ্জায় সজ্জিত হলেন।

কিছুক্ষণ পর ডাকতে-ডাকতে ওখানে হাজির হলেন ললিতা-বিশাখারা। কিন্তু কুঞ্জের ভিতর প্রবেশ করেই তারা থমকে গেল, এ কী শ্রীরাধা কই? এই যে দুটোই কৃষ্ণ? তাহলে রাধাকে কি কেউ অপহরণ করল? চিন্তাই পড়ল অষ্টসখী। এই অষ্টসখী হল ললিতা , বিশাখা , চম্পকলতা , চিত্রা , তুঙ্গবিদ্যা , ইন্দুলেকা , রাঙ্গাদেবী , এবং সুদেবী। এদিকে তখন ত্রিভঙ্গ মুরারি শ্রীকৃষ্ণদ্বয় আপন খেয়ালে বাঁশি বাজিয়ে চলেছেন। সখিরা এবার অবাক হল। নিজেদের মধ্যে শুরু হল গুঞ্জন। কানাকানি। তারা বুঝতে পারল এই দু’জন কৃষ্ণের মধ্যে একজন অবশ্যই তাদের সখি শ্রীরাধা। তিনি কৃষ্ণের বেশ পরিধান করেছেন। বহু পর্যবেক্ষণ ও আলাপচারিতার পর তারা তাদের সখিকে চিনতে পারলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেল তাঁদের সাথে। আর একজন কৃষ্ণ ওখানেই রয়ে গেলেন।

সখিরা হাসতে-হাসতে নিয়ে যাচ্ছে তাদের প্রাণের সখি অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের রূপধারী শ্রীরাধাকে। মাঝে মাঝে হাসতে-হাসতে শ্রীরাধার গায়ে ঢলে পড়ছে সখিরা। হঠাৎ তাদের মনে হল শরীর এত শক্ত কেন? প্রশ্ন করাতে সেই শ্রীকৃষ্ণের বেশধারী শ্রীরাধা উত্তর দিলেন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে মন্ত্রপুত জল দিয়ে এরকম করে দিয়েছে। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের অঙ্গের মতই হয়ে উঠেছে শ্রীরাধার অঙ্গ।

আরও পড়ুন-

স্বদেশিদের তৈরি এই মেলায় আসতেন বিপিনচন্দ্র পাল, সুভাষচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ

কিছুক্ষণ পর একজন সখি জানতে চাইল তাঁর গলার স্বরের পরিবর্তন হয়েছে কেন? অর্থাৎ পুরুষের মতোই গম্ভীর হয়ে উঠেছে। এবারেও শ্রীরাধা একই উত্তর দিলেন। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণের গলার স্বরের মতই হয়ে উঠেছে শ্রীরাধার গলার স্বর। সমস্ত কথায় বিশ্বাস করল সখিরা। কারণ তারা তো সরল। সহজ। নিষ্পাপ। সখিরা তখন সেই কৃষ্ণরূপী শ্রীরাধাকে কানে-কানে গোপন কিছু কথা বলল। নিয়ে যেতে চাইল আড়ালে।

কৃষ্ণ দেখলেন এ তো মহাবিপদ। তখন সেই কৃষ্ণ তাঁর আসল পরিচয় দিলেন। বললেন তিনি আসল কৃষ্ণ। আর শ্রীরাধা নিকুঞ্জ বনে রয়েছে। এতদিন মেলামেশার করার পরেও তোমরা তোমাদের সখিকেই চিনতে পারোনি। তোমাদের সখি অর্থাৎ শ্রীরাধা ওই কুঞ্জেই বাঁশি বাজাচ্ছে। আর আমি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। আসল কৃষ্ণ। লজ্জায় তখন আরক্ত হয়ে ওঠে সখিরা। কেউ-কেউ আবার জিভ বের করে। সত্যি তো তারা নিজেদের সখিকেই চিনতে পারেনি। এটাই তো শ্রীকৃষ্ণের মায়া। তিনি যেমন চাইবেন তেমনটাই হবে। তার মোহন বাঁশির সুরে এ-জগৎ সংসার পুতুলের মতো নাচতে বাধ্য। তিনি যেমন চালান আমরা তেমন চলি।

আসলেই এই কাহিনির মধ্যে রয়েছে এক গূঢ় তত্ত্ব। পরমাত্মা এবং জীবাত্মা যে এক ও অদ্বিতীয় সেটাই সাধারণ মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীরাধা আর শ্রীকৃষ্ণ একই। একই অঙ্গে ভিন্নরূপ। ভক্ত আর ভগবান। ভগবান আর ভক্ত। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী বলেছেন—

রাধা পুনশক্তি কৃষ্ণ পুনশক্তিমান
দুই বস্তু ভেদ নাহি শাস্ত্র প্রমাণ।।

'গীতা'-য় বলা হয়েছে—

স্বয়মেবাত্মনাত্মানং বেত্থ ত্বং পুরুষোত্তম।
ভুতভাবন ভুতেশ দেবদেব জগৎপতে।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ১০ম অঃ, শ্লোক ১৫)

যাইহোক এবার তারা শ্রীরাধা কৃষ্ণকে নিয়ে তাদের অভীষ্ট জায়গায় প্রবেশ করল। বৃন্দাদেবী আগেই ঝুলন সাজিয়ে রেখেছিলেন। সেখানে প্রবেশ করল সখি-সহ রাধাকৃষ্ণ। বিভিন্ন পুষ্পে সজ্জিত দোলনা। সোনা-রূপা দিয়ে পালিশ করা হয়েছে, দড়িটি কদমগাছে ঝোলানো হয়েছে। সেই সঙ্গে সাজানো হয়েছে ফুল-লতা দিয়ে। শুরু হল রায়যুগলের দোলন। 'দোলে দোদুল দোলে ঝুলনা'। কেউ গান করছে , কেউ বাজনা বাজাচ্ছে। কেউ আবার নাচছে। এ-দৃশ্য সত্যই নয়নাভিরাম।

এই নয়নাভিরাম দৃশ্য কল্পনা করেই বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় ঝুলন সাজানো হয়। ঝুলনের প্রাণকেন্দ্র বা প্রাণপুরুষ হলেন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ। রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ সুসজ্জিত দোলনায় বসানো হয়। পূর্ব থেকে পশ্চিমে তাঁদের দোল দেওয়া। এর মধ্যেও কিন্তু একটি তাৎপর্য রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরা প্রকৃতি। বা পরমপুরুষ। আর শ্রীরাধা অপরা অর্থাৎ ভক্ত। এটি আসলে ভক্ত ভগবানের লীলা। তবে এর মধ্যে একটা ভৌগোলিক চিন্তাভাবনা প্রকাশ দেখা যায়। দোলনাটিকে দোলানো হয় পূর্ব থেকে পশ্চিমে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের অবস্থানের উপর নির্ভর করে। আমরা জানি পৃথিবীর দুটি গতি— আহ্নিক ও বার্ষিক গতি। আর সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবী তার নিজের কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে। শক্তির প্রধান উৎস সূর্য। পৃথিবীর এই গতির ওপর নির্ভর করে কর্কটক্রান্তি মকরসংক্রান্তি ঘটে। সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ণ অবস্থা দেখা যায়। এরই ওপর নির্ভর করে দোলযাত্রার সময় দোলনা উত্তর থেকে দক্ষিণে দোলানো হয় আর ঝুলনের সময় পূর্ব থেকে পশ্চিমে দোলানো হয়। আসলে এটি ভক্ত ভগবানের লীলা। বলা হয়েছে—

অনুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাশ্রিতঃ।
ভজতে তাদৃশীঃ ক্রীড়াঃ যাঃ শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ।।

শাস্ত্রমতে শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি হলেন রাধা। তিনি কৃষ্ণপ্রেমে বলীয়ান হয়েছেন। আসলে উভয় সত্ত্বা অর্থাৎ ভক্ত ও ভগবান এক ও অভিন্ন। যাইহোক ঝুলন ভক্ত ভগবানের একই দোলনায় দোলার উৎসব। ভক্ত ও ভগবান যে একই অংশ থেকে উদ্ভূত তারই প্রকাশ এই ঝুলন যাত্রা। আমরাও শ্রীরাধার মত ঝুলন যাত্রায় শামিল হব। দুলবো পরম পুরুষের সঙ্গে। এটাই আমাদের জীবনের পরম লক্ষ্য। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতন বলতে ইচ্ছা করছে—

বসিব দুজনে বড় কাছাকাছি
ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্ট হাসিয়া মারিবে ঠেলা
আমার প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা
নিশীথবেলা। ('ঝুলন', রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

ঋণ স্বীকার :

১. শ্রীমদ্ভগবদগীতা : শাঙ্করভাষ্য ও তার ব্যাখ্যা
২. একটি সংস্কৃত-ইংরেজি অভিধান:
৩. ‘ঝুলন, রাস ও রাখীবন্ধন: ইতিহাসগত বিশ্লেষণ' : রানা চক্রবর্তী
৪. ‘পরম্পরা ও ঐতিহ্যে বাংলা ঝুলন’
সপ্তডিঙা ঝুলনযাত্রা সংখ্যা ১৪২৫* Shoptodina Vol 4 No 2 2018 * ISSN 2395 6054
৫. ঝুলন উৎসব কেন পালন করা হয়? ৫ আগস্ট, ২০২২ জেনে নিন, এই শুভ দিনের মাহাত্ম্য দ্য হিন্দুস্থান টাইমস
৬. ঝুলন যাত্রা : কৃষ্ণকমল ( সনাতন ধর্মতত্ত্ব)
৭. ভক্তি বিলাস : শ্রী গোপাল ভট্ট গোস্মামী
৮. উইকিপিডিয়া

More Articles