৩০ দিনে ৪,১০৪ শিশুর মৃত্যু! কেন এত শিশু মারা যাচ্ছে গাজার যুদ্ধে?
Gaza Children Death : পৃথিবীতে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বোমা এসে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে শিশুর দেহ।
হামাস ইজরায়েলের ১৪০০ মানুষকে হত্যা করেছিল। হত্যার বদলা চিরকালই হত্যা, রাষ্ট্রশক্তির কাছে তো বটেই। তাই বদলা নিয়েছে ইজরায়েল। ১৪০০-র বদলা ১০০০০! গত ৪ সপ্তাহে ১০ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে ইজরায়েলি সেনাবাহিনী। এই ১০ হাজারের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই শিশু। ছোট্ট দেহ, ছোট্ট লাশ। বরাবরই যে কোনও যুদ্ধের 'সফট' টার্গেট মহিলা ও শিশু। ধর্ষণ ও শিশুমৃত্যু যুদ্ধের কতখানি অংশ জুড়ে থাকে সেই পরিসংখ্যান যে কোনও যুদ্ধের ইতিহাস অল্প ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে। রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ কিন্তু এখনও চলছে। সেখানেও এত বেশি শিশু কিন্তু প্রাণ হারায়নি। কেন ইজরায়েল হামাসের দ্বন্দ্বে পড়ে গাজার ছোট শিশুরা হাজারে হাজারে মারা যাচ্ছে?
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্যমন্ত্রক আরও জানাচ্ছে, ৭ থেকে ২৪ অক্টোবরের মধ্যেই কেবল ২,৯০০ শিশু নিহত হয়েছে। এই মুহূর্তে মোট মৃত্যুর অর্ধেকই শিশুমৃত্যু। ইউক্রেনে কিন্তু তুলনামূলকভাবে দু'টি অনেক বড় শক্তির মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। দীর্ঘ সময়ের এই যুদ্ধে প্রায় ৯,৮০০ নাগরিকের প্রাণ গিয়েছে, কিন্তু শিশুর সংখ্যা ৫৫০-রও কম। গাজার তাহলে এত পরিমাণ শিশু মৃত্যু কেন? গাজা বিশ্বের তৃতীয় ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। এবং এখানে তরুণ জনসংখ্যাই বেশি। ফিলিস্তিনি অঞ্চলের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ২০ বছরের কম বয়সি। ইরাক, নামিবিয়া এবং থাইল্যান্ডের মতো অন্যান্য উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশগুলির গড়ের তুলনাতেও অনেক বেশি এই হার।
আরও পড়ুন- লাশের স্তূপ মর্গে! ৮,০০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে দ্বিতীয় পর্যায়ের যুদ্ধ ঘোষণা ইজরায়েলের
শিশু জনসংখ্যা কেন এত বেশি তার মূল ভিত্তি লুকিয়ে আছে উচ্চ প্রজনন হারের উপর। অর্থাৎ একজন মহিলা তাঁর জীবদ্দশায় কতগুলি সন্তান জন্ম দিতে পারবেন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের জনসংখ্যা বিভাগ অনুসারে, ২০২১ সালে গাজা (মোট জনসংখ্যা ২ মিলিয়ন) এবং ওয়েস্টব্যাঙ্ক (৩ মিলিয়ন) সহ ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এই প্রজনন হার ছিল ৩.৪%। ২০১৭ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত তা ছিল ৩.৮।
গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া কঠিন। কিন্তু জনসংখ্যা বিভাগের মতে, সেই সময়ে গাজার জন্মহার ছিল ৩.৯%। এই হারগুলি প্রতিবেশী দেশ ইজরায়েল, জর্ডান বা মিশরের তুলনায় অনেক বেশি। উচ্চ প্রজনন হারের নেপথ্যে থাকে স্বল্প আয়ু, দারিদ্র্য এবং নারী শিক্ষার হার কম হওয়ার মতো কারণ। কিন্তু ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এই সমস্যা ছিল না। প্যালেস্তাইনে জনপ্রতি গড় আয় প্রতি বছর ৪,৬০০ ডলার, যা মিশর এবং জর্ডনের তুলনায় বেশি। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ছেলেদের চেয়ে বেশি মেয়ে ভর্তি হয় প্যালেস্তাইনে। উচ্চ-মধ্য স্তরের আয় আবার উচ্চ প্রজনন হার, প্যালেস্তাইনের এই বিষয়টি বেশ অন্যরকম। বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, ইজরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের বিরোধ এবং হামাসের প্রভাব (গাজাকে হামাস শাসন করে কিন্তু ওয়েস্ট ব্যাঙ্ককে নয়) এর জন্য আংশিকভাবে দায়ী।
প্যালেস্তাইনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত একবার বলেছিলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ফিলিস্তিনি পরিচয় এবং নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করার একটি উপায়। ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর হামাস উচ্চ জন্মহার বজায় রাখার চেষ্টা করে গিয়েছে।
আরও পড়ুন- গাজায় সাদা ফসফরাস ছড়াচ্ছে ইজরায়েল! কতটা মারাত্মক এই ‘নিষিদ্ধ অস্ত্র’?
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে প্রায় ১০০০ শিশু নিখোঁজ, হয়তো ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে তারা। ৬০০০-এর বেশি শিশু আহত। বিদ্যুতের অভাবের পাশাপাশি পাওয়ার জেনারেটরগুলিতে জ্বালানির অভাব দেখা দিয়েছে। হাসপাতালগুলির অবস্থা এমনিই তথৈবচ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানিও না থাকায় গাজার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। এই ঘটনা শিশুদের জীবনকে আরও বিপন্ন করে তুলেছে। সদ্যোজাতরা পরিচর্যা পাচ্ছে না বিন্দুমাত্র। পৃথিবীতে আসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বোমা এসে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে শিশুর দেহ। ইজরায়েল কেবল সংখ্যা গুনছে, ৮০০১, ৮০০২, ৯০০০...
ঠিক ১০০ বছর আগে শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত একটি খসড়া তৈরি করেন এগ্লান্টিন জেব, আন্তর্জাতিক সেভ দ্য চিলড্রেন ইউনিয়ন তা প্রকাশ করে। ওই খসড়াতে বলা হয়, বিপর্যয়ের সময় প্রথম ত্রাণ পাবে অবশ্যই একজন শিশু। যে শিশুটি ক্ষুধার্ত তাকে অবশ্যই প্রথমে খাওয়াতে হবে।অসুস্থ শিশুকে অবশ্যই লালন-পালন করতে হবে এবং অনাথকে আশ্রয় দিতে হবে। এই এক শতাব্দীর পর, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলিতে শিশুরাই এখনও সবচেয়ে বেশি ভুগছে।
প্রতি ছয়জনে একজন শিশু (৩০ বছর আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ) সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে বাস করে এবং মারা যায়। ২০২১ সালের হিসেব বলছে, যুদ্ধের শিকার হিসাবে প্রতিদিন ২২ জন করে শিশু নিহত হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে।