সিঁদুর নিয়ে অধ্যাপকের 'বাঁকা' মন্তব্যে খড়্গহস্ত পুলিশই, বিজেপি নেতার মন্তব্যে কেন মৌন?

Ashoka University Prof Ali Khan Mahmudabad: হরিয়ানা পুলিশ গত ১৮ মে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অপারেশন সিঁদুর সম্পর্কে মন্তব্য করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে...

অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনার অপারেশন সিঁদুরকে কেন্দ্রে রেখে সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের জন্য এমন পদক্ষেপ। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ। অভিযোগ, অধ্যাপকের বক্তব্যে ভারতের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়েছে। তিনি আদতে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য প্রচার করছেন। অধ্যাপক মাহমুদাবাদের বিরুদ্ধে দু'টি এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। একটি করেছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির একজন নেতা। অন্যটি করে হরিয়ানা রাজ্য মহিলা কমিশন। মহিলা কমিশনের বক্তব্য, অধ্যাপকের মন্তব্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর মহিলা অফিসারদের প্রতি অবমাননাকর। সেই মামলার শুনানিতে ২১ মে সুপ্রিম কোর্ট কঠোর নিয়ম মেনে চলার শর্তে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছে। পাশাপাশি যুদ্ধবিরোধী সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টের তদন্তের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত দলও গঠন করেছে আদালত।

আদালত আরও বলেছে, তিনি এই মামলা সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে লিখতে বা বক্তৃতা দিতেও পারবেন না। আলি খান মাহমুদাবাদের পাসপোর্টও জমা দিতে বলা হয়েছে। আদালত বলেছে, "ভারতের সাম্প্রতিক সংকট, ভারতের মাটিতে সন্ত্রাসী হামলা বা ভারতের পাল্টা প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করতে পারবেন না" অধ্যাপক। শীর্ষ আদালত আরও বলেছে যে, যদি অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং অধ্যাপকরা, "এমনই কিছু করার সাহস দেখায়, আমরা তা মেনে নেব না, যদি তারা হাত মেলানোর চেষ্টা ইত্যাদি করে, আমরা জানি কীভাবে এই ব্যক্তিদের মোকাবিলা করতে হয়, তারা আমাদের এখতিয়ারের মধ্যেই আছে।"

আরও পড়ুন- কর্নেল সোফিয়া কুরেশি: একতা ও সম্প্রীতির প্রশ্নে অপারেশন সিঁদুরের মাস্টারস্ট্রোক

আদালত শুনানিতে বলেছে যে, "জটিলতা বোঝার জন্য এবং পোস্টে ব্যবহৃত ভাষার যথাযথ মূল্যায়নের জন্য", হরিয়ানার পুলিশের মহাপরিচালককে হরিয়ানা বা দিল্লির বাসিন্দা নয় এমন তিনজন পুলিশ অফিসারকে নিয়ে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠনের নির্দেশ দেবে আদালত। এই এসআইটির নেতৃত্বে থাকবেন একজন পুলিশ মহাপরিদর্শক এবং এর একজন সদস্য হবেন একজন মহিলা কর্মকর্তাও।

উল্লেখ্য, হরিয়ানা পুলিশ গত ১৮ মে অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহীতার ইঙ্গিত দিয়ে, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অপারেশন সিঁদুর সম্পর্কে মন্তব্য করে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে গ্রেফতার করে।

 

শীর্ষ আদালতের বিচারপতি সূর্য কান্ত শুনানি চলাকালীন অধ্যাপককে বলেন, "আপনার জানা উচিত কী ঘটছে। বাকস্বাধীনতা ইত্যাদির অধিকার অবশ্যই আছে.. কিন্তু কর্তব্য কোথায়? যেন গত ৭৫ বছর ধরে পুরো দেশে কেবল অধিকারই খর্ব হচ্ছে, কর্তব্যে গাফিলতি হচ্ছে না।” বিচারপতি আরও বলেন, "তাঁর (অধ্যাপক) অভিধানে শব্দের অভাব হওয়া উচিত নয়। তিনি এমন ভাষা ব্যবহার করতে পারতেন যা অন্যদের অনুভূতিতে আঘাত না করে, নিরপেক্ষ ভাষা ব্যবহার করতে পারতেন।"

ঠিক কী কী পোস্ট করেছিলেন আলি খান? গত ৯ মে অধ্যাপক তাঁর একটি পোস্টের এক অংশে লেখেন,

"কৌশলগতভাবে, ভারত পাকিস্তানে সামরিক এবং সন্ত্রাসীদের (অ-রাষ্ট্রীয় পক্ষ) মধ্যে পার্থক্য ভেঙে ফেলার ক্ষেত্রে এক নতুন পর্যায় শুরু করেছে। কারণ, যেকোনও সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রতিক্রিয়া এক প্রচলিত প্রতিক্রিয়াকেই আমন্ত্রণ জানাবে এবং তাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর এখন বাড়তি দায়িত্ব চেপে বসবে যে তারা যেন সন্ত্রাসী এবং অ-রাষ্ট্রীয় পক্ষের পিছনে আর লুকিয়ে থাকতে না পারে।

যাই হোক, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দীর্ঘকাল ধরে এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার জন্য সামরিকীকরণ করে অ-রাষ্ট্রীয় পক্ষকে ব্যবহার করেছে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদেরকেই 'শিকার' বলে দাবি করেছে। তারা পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়াতেও একই পক্ষকে ব্যবহার করেছে - যাদের মধ্যে কয়েকজন সাম্প্রতিক হামলায় লক্ষ্যবস্তু হয়েছিল।

অপারেশন সিঁদুর ভারত-পাক সম্পর্কের সমস্ত ধারণাগুলির পুনর্নির্মাণ করেছে কারণ সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় সামরিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে এবং দুইয়ের মধ্যেকার অর্থগত পার্থক্য দূর হয়ে যাবে। এরপরেও, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী সামরিক বা বেসামরিক স্থানগুলিকে লক্ষ্যবস্তু না করার জন্যই সতর্কতা অবলম্বন করেছে..."

আরও পড়ুন- ভারত-পাক সংঘর্ষে সংবাদ মাধ্যমের সার্কাস প্রদর্শনী

মাহমুদাবাদ বলেছেন, তাঁর বক্তব্যকে ভুল বোঝা হয়েছে। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন যে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধবিরোধী বক্তব্যের সমালোচনা করা এবং যুদ্ধে বেসামরিক নাগরিকদের দুর্ভোগ এবং সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সহ সকল ভারতীয় নাগরিককে রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার মতো বিষয়গুলি তুলে ধরা। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিখুঁত পদ্ধতির প্রতি সমর্থনই জুগিয়েছেন এবং পাকিস্তান যেভাবে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করছে তার নিন্দাই করেছিলেন।

অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদের আইনজীবী কপিল সিব্বল আদালতকে বলেন, আলি খানের কথায় কোনও অপরাধমূলক উদ্দেশ্য ছিল না, তিনি সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করার চেষ্টাও করেননি, “তিনি কেবল আহত হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী ৯ মাসের গর্ভবতী কিন্তু অধ্যাপক জেলে আছেন।” আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং প্রশ্ন করেছেন, আলি খান এবং তাঁর স্ত্রীর প্রথম সন্তান আসতে চলেছে, অথচ সন্তানের বাবা কারাগারে। তাঁকে 'শিক্ষা' দিতে সবাই তৎপর অথচ বিজেপিরই এক মন্ত্রী কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে “সন্ত্রাসীদের বোন” বলে গালাগালি দিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট তাঁকে গ্রেফতার না করার নির্দেশ দেয়। একই প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের সাংসদ মহুয়া মৈত্র। মহুয়া দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আলি খানকে ভোরবেলা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, যেন তিনি কোনও সন্ত্রাসবাদী। ঘরে তখন তাঁর ন'মাসের গর্ভবতী স্ত্রী! অথচ বিজেপি নেতা বিজয় শাহ, কর্নেল সোফিয়া কুরেশির বিরুদ্ধে জঘন্য অবমাননাকর বক্তব্য রাখেন, তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি সুপ্রিম কোর্টে ক্ষমা চান, তবে আদালত এসআইটি গঠন করে। যদিও গ্রেফতারি তিনি এড়িয়ে গেছেন সযত্নেই। মহুয়া অভিযোগ করেছেন, “আলি মাহমুদাবাদকে গ্রেফতার করা হয়েছে কারণ তিনি মুসলিম।"

 

প্রশ্ন উঠছে, সত্যিই কেন কর্নেল সোফিয়া কুরেশির বিরুদ্ধে ঘৃণ্য বক্তব্য করেও পার পেয়ে যান বিজেপি নেতা? যেভাবে আলি খানের বেলায় স্বতপ্রণোদিত হলো পুলিশ, সেভাবে বিজেপির নেতার বিরুদ্ধেও কি সক্রিয় হতে দেখা গেল পুলিশকে? মহিলা কমিশন কি ওই বিজেপি নেতার বক্তব্যে মহিলাদের অবমাননাকে গুরুত্ব দিল না তবে? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, আলি মাহবুদাবাদ তাঁর দীর্ঘদিনের চর্চার জায়গা থেকেই এই সংঘর্ষ পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করেছেন, যা অত্যন্ত গভীর বিশ্লেষণের ফল। সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে অজস্র অপব্যাখ্যা, হিংসামূলক পোস্ট, এমনকী ভারতীয় গণমাধ্যমজুড়ে ভুয়ো খবরের পাহাড়! কেন তার বিরুদ্ধেও একইরকম কড়া নয় প্রশাসন ও আদালত? প্রশ্ন আর উত্তর দুই-ই সহজ, উত্তরও হয়তো জানাই।

More Articles