বাংলাদেশ পাকিস্তান নৈকট্য ভারতের জন্যে কেন দুশ্চিন্তার?
Pakistan-Bangladesh Relations: গত কয়েক মাসে এই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, সংস্কৃতি বা যোগাযোগ সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বেড়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হচ্ছে। চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে ওমানের মাস্কাটে ভারত মহাসাগর সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা জোট বা সার্ক-কে আবার চালু করার প্রসঙ্গ তোলেন। এর আগেও বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার সার্ককে পুনরায় চালু করার কথা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন। কিন্তু বৈঠকে জয়শংকর পরিষ্কার জানিয়ে দেন, সার্কের কথা আপাতত না তোলাই ভালো। তিনি এও বলেন, কোন দেশের কারণে এবং কেন সার্ক এখন অচল তা জোটের সব সদস্য দেশগুলোরই ভাল মতো জানা। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার বিষয়টিকে ভারত 'পাকিস্তানের সুরে সুর মেলানো' হিসেবেই দেখবে। অর্থাৎ পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ যে একটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছে তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ নেই। কিন্তু ১৯৭১ এর ক্ষত ভুলে কেন কাছাকাছি এল বাংলাদেশ পাকিস্তান, এই সম্পর্কের প্রভাবই বা কতটা, বিশ্লেষণ জরুরি।
গত কয়েক মাসে প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য, সংস্কৃতি বা যোগাযোগ সব ক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বেড়েছে। বহু বছর পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে ৫০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানি করেছে। এছাড়াও ভিসা বিধিনিষেধ শিথিল করা এবং ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে ডিরেক্ট ফ্লাইট চালু করার কথাও চলছে। দু'দেশের সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারাও এক অন্যের দেশে যাওয়া আসা শুরু করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার এবং বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস-সহ অন্য উপদেষ্টাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গিয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিএনপি, জামায়াত বা এনসিপি-র শীর্ষ নেতাদের সঙ্গেও দেখা করেছেন ইসহাক দার। একাত্তরের যুদ্ধকে এই সফরে 'মীমাংসিত বিষয়' বলে দাবি করেন তিনি। যার অস্যার্থ দু-পক্ষই একে অন্যেকে কাছে টানার বার্তা দিচ্ছে। 'হৃদয় পরিষ্কার করে' বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে যাওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তিই হল একাত্তরের যুদ্ধ। সেখানে ভারতীয় সেনা ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী একসঙ্গে লড়েছিল। দু-দেশের মৈত্রীর সূত্রই ছিল পারস্পরিক নির্ভরতা, পাক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা।
আরও পড়ুন- ট্রাম্পের ফোন আসেনি, মাথা নত করেছিল পাকিস্তানই, বলছেন এস জয়শঙ্কর
সেই রয়ায়ন আজ বদলে গেলে ভারতের কপালে ভাঁজ পড়াই স্বাভাবিক। কারণ এই দুই দেশের সঙ্গে আবার চিনের সখ্য একটি নতুন ত্রিভুজ তৈরি করতে পারে। ভারতের প্রধান সেনাধ্যক্ষ (চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ) জেনারেল অনিল চৌহান বিবিসি-কে বলেছেন, চিন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ভারতে এর প্রভাব পড়তে পারে। তাঁর কথায়, "এই তিনটি দেশের ক্ষেত্রে যে সম্ভাব্য 'কনভার্জেন্স অব ইন্টারেস্ট' দেখা যাচ্ছে, তা ভারতের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ে বড় প্রভাব ফেলতেই পারে।"
নিরাপত্তার ঝুঁকি
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বহুদিন সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলার ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান মাথায় রেখেই দু-দেশের মধ্যে বোঝাপড়া, কূটনৈতিক দূরত্ব কমিয়ে আনা জরুরি। বিগত কিছু বছরে নিরাপত্তা বজায় ছিল। বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, অতীতে অবস্থাটা স্থিতিশীল ছিল। কারণ পাকিস্তানের কোনো ইন্ধন বাংলাদেশে ছিল না। এখন দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এই সীমান্ত নিয়ে বাড়তি দুশ্চিন্তার অবকাশ তৈরি হচ্ছে।
একটি ঘটনার কথা এখন আলোচনায় উঠে আসছে। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন ভিনা সিক্রি। সে সময়বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকার। তখনও বাংলাদেশ ও ইসলামাবাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। ভিনা সিক্রি রাষ্ট্রদূত থাকাকালীন ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দশটি ট্রাকে করে অস্ত্র পাচারের ঘটনা ঘটেছিল। তখন অভিযোগ উঠেছিল, আলফা-সহ ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর জন্য এই অস্ত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো হওয়ার বিষয়টিকে ভিনা সিক্রি 'খুব বড় সিকিওরিটি কনসার্ন' বলে মনে করেছিলেন।
আরও পড়ুন- কৌশল বদল, যেভাবে ভারতে গুপ্তচরবৃত্তি চালাচ্ছে পাকিস্তান
পাকিস্তানে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের পাকিস্তানে বৃত্তি দেওয়ার বিষয়টিও ভারতের থেকে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের টানার কৌশল বলে মনে করছেন অনেকে। ভারত এতদিন বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের শান্তিনিকেতনে বা বরোদার এম এস ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য বৃত্তি দিয়েছে। পাকিস্তান এখন একই পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটি এখন জিন্নাহ বা আল্লামা ইকবালের ডকট্রিনে বাংলাদেশের পড়ুয়াদের বৃত্তি দেবে।
কূটনৈতিকদের একটা পক্ষ আবার মনে করছেন, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের সম্পর্ক ভালো হওয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সায় রয়েছে। কারণ, ভারতকে যে তিনি আর তাঁদের প্রধান মিত্র বা সবচেয়ে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে তুলে ধরতে চান না, সেটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কূটনৈতিক সিদ্ধান্তে স্পষ্ট হয়েছে। ৫০ শতাংশ ট্যারিফের মতো পদক্ষেপ পরিষ্কার করে দিয়েছে, ভারত ও পাকিস্তানকে তিনি একই চোখে দেখেন। শুধু তাই নয়, আসীম মুনিরের সঙ্গে ট্রাম্পের মধ্যাহ্নভোজের ছবিটিই ছিল নৈকট্যের অলিখিত বার্তা। শুল্কযুদ্ধের আবহে দু'মাসে দু'বার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছেন মুনির
উল্লেখ্য, ভারতের পশ্চিম সীমান্তে রয়েছে পাকিস্তান, উত্তর সীমান্তে চিন, দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের সংঘাত। পূর্ব সীমান্তে কিছু বছর অপেক্ষাকৃত শান্ত ছিল। কিন্তু এখন যদি এই সীমান্ত নিয়েও চিন্তা বাড়ে, তাহলে ভারতের চাপ আরও বাড়বে।

Whatsapp
