স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা হবে ডিজিটাল! কেন আজ ভেঙে পড়ছে তিলে তিলে গড়া বাইজুস সাম্রাজ্য
Byju's recession: বাইজু'স-এর পতনের নেপথ্যে রয়েছে বিশ্বমন্দার প্রভাব।
করোনাকালে আমরা দেখেছিলাম অনলাইন শিক্ষার বাড়বাড়ন্ত। ভাইরাসের প্রকোপে যখন মানুষ ঘরবন্দি, তখন ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনা চালানোর অন্যতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল অনলাইন পড়াশোনা। বর্তমানে এই অনলাইন পড়াশোনাকে কেন্দ্র করেই একটি ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে যাকে বলা হয় এড-টেক ইন্ডাস্ট্রি। এই এড-টেক ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম বড় বড় নামগুলি হলো আনঅ্যাকাডেমি, ফিজিক্সওয়াল্লাহ, বেদান্ত প্রভৃতি। তবে এই ইন্ডাস্ট্রির একদম প্রথম সময়ের একটি সংস্থা হচ্ছে 'বাইজুস'। বর্তমানে এই ইন্ডাস্ট্রিতে অন্যতম বড় নাম বাইজুস (Byju's)। বর্তমানে সংস্থার বাজারদর ২২০০ কোটি ডলারের বেশি। শুধু চলতি বছরের শুরুতেই ৮০ কোটি ডলারের ব্যবসা করেছে বাইজুস। ভারত-সহ অন্যান্য দেশেও ধীরে ধীরে বাজার বিস্তৃত করছে তারা।
কিন্তু, এই বছর ক্রমাগত ছাঁটাইয়ের জন্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের শিরোনামে চলে এসেছে বাইজুস। এবছরের জুন মাসে একসঙ্গে প্রায় ১৫০০ কর্মী ছাঁটাই করেছিল বাইজুস। এখন আবার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শোনা যাচ্ছে, আগামী ৬ মাসের মধ্যে নিজেদের মোট কর্মী সংখ্যার ৫ শতাংশ ছাঁটাই করতে চলেছে বাইজুস। বাইজুস-এর মোট কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজারের কাছাকাছি। অর্থাৎ আগামী ছয় মাসের মধ্যে বাইজুসের প্রায় আড়াই হাজার কর্মচারী চাকরি হারাবেন! মূলত মার্কেটিং, অপারেশন, কনটেন্ট এবং ডিজাইন থেকেই অধিকাংশ কর্মীকে ছাঁটাই করা হবে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে বর্তমানে বাইজুস-এর কনটেন্ট এবং অ্যানিমেশন গ্রাহকদের একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। একই সঙ্গে বাইজুসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে টপার, টিউটরভিস্তা, স্কলার-সহ অন্যান্য অধিকৃত কোম্পানিগুলিকে একটি ছাতার তলায় আনা হবে। সেক্ষেত্রে এই সংস্থাগুলিকে বাইজুসের সঙ্গে মার্জ করিয়ে দেওয়া হতে পারে কি না, তা দেখার বিষয়। তবে আকাশ এবং গ্রেট লার্নিং দু'টি পৃথক সংস্থা হিসেবে কাজ করতে থাকবে বলে জানিয়েছে বাইজুস।
কিন্তু শুধু ছাত্র-ছাত্রীদের বা গ্রাহকদের পছন্দ হচ্ছে না বলে ছাঁটাই করা হচ্ছে তা নয়। এর পিছনে রয়েছে বিশ্বমন্দার প্রভাব। শুধু আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলি নয়, এর প্রভাব পড়েছে ভারতেও। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প। চলতি বছরেই দশ হাজারের বেশি কাজ হারিয়েছেন ওই সেক্টরে। ইতিমধ্যেই আনঅ্যাকাডেমি, ওলা, উবের, উইপ্রো, ইনফোসিস, কারস-২৪-সহ বহু কোম্পানি নিজেদের কর্মী ছাঁটাই করেছে। কয়েকদিন আগেই আমরা দেখেছিলাম নেটফ্লিক্স নিজেদের ৮ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে। ইতিমধ্যেই শোনা যাচ্ছে, এলন মাস্ক টেসলা কোম্পানির প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করতে চলেছেন। অর্থনীতিবিদদের মতে, এরকম চলতে থাকলে বছর শেষ হওয়ার আগেই শুধুমাত্র এইসব ইন্ডাস্ট্রি থেকে কাজ হারাবেন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ! করোনাকালে একেই কাজ হারিয়েছেন অনেক মানুষ, করোনা-পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর বদলে ক্রমশ মন্দার দিকে যাচ্ছে। বলাই বাহুল্য, মন্দা থেকে না বেরতে পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
আরও পড়ুন: অনলাইন কেলেঙ্কারির ফাঁদ পেতে ভয়াবহ মানুষ পাচারচক্র! বাংলাদেশে বিছিয়ে রয়েছে যে জাল
এর পাশাপাশি আপনাদের জানিয়ে রাখি, বর্তমানে বাইজুস কিন্তু একটি লস মেকিং কোম্পানি। অর্থাৎ, বর্ষশেষে কোম্পানির রেভেনিউ বা আয় কিছুই হচ্ছে না, উপরন্তু ক্যাপিটাল বা মূলধন কমে যাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে অবশ্য বাইজুস-এর সিইও মৃণাল মোহিত আশ্বস্ত করে বলেছেন, “আমরা একটি অত্যন্ত পরিণত সংস্থা। আমাদের কর্তব্য বিনিয়োগকারী এবং আমাদের কোম্পানির স্টেকহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষা করা। কোম্পানিকে লাভজনক বানানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি লাভের জন্যে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের বিশ্বাস এই পদক্ষেপ গুলি গ্রহণ করলে ২০২৩ সালের মার্চ মাসের মধ্যেই বাইজুস পুনরায় একটি লাভজনক সংস্থা হয়ে উঠবে।”
গত অর্থবছরের (২০২০-২০২১) ফিনান্সিয়াল রিপোর্ট জমা দিতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছিল বাইজুস-কে। পূর্বনির্ধারিত সময়ের থেকে এক বছরেরও বেশি সময় বিলম্ব হয়েছিল সেই বার্ষিক রিপোর্ট প্রস্তুত করতে। ইতিমধ্যেই গুচ্ছ গুচ্ছ কর্মী ছাঁটাই এবং শূন্য ফান্ডিং-এর সমস্যায় জর্জরিত এই কোম্পানি। সব মিলিয়ে খুব কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বাইজুস। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এই কথা স্বীকার করে নেন বাইজুস-এর কর্ণধার বাইজু রবীন্দ্রন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “কোম্পানির অন্যতম কঠিন সময়ে এটি। আমি হলফ করে বলতে পারি, যদি আমরা এই কঠিন সময়টা পেরিয়ে যেতে পারি তাহলে আমাদের কেউ আটকাতে পারবে না।” এই একই বাইজু রবীন্দ্রন জানিয়েছিলেন এই অর্থবর্ষে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আয় করেছে কোম্পানি। কিন্তু ফাইনাল অডিট হওয়ার আগে পর্যন্ত বোঝা যাচ্ছে না এই দাবি কতটা বাস্তবসম্মত। তবে ২০২০-'২১ অর্থবর্ষর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৪ শতাংশ আয় কমে গেছে এই সংস্থার। গত অর্থবর্ষে প্রায় ৪,৫৮৯ কোটি টাকার লোকসান হয়েছে বাইজুসের।
অবশ্য কোম্পানির কর্ণধার বাইজু রবীন্দ্রন জানিয়েছেন শীঘ্রই আরও ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করা হবে এই কোম্পানিতে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই ঘোষণার পরের দিনই আড়াই হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের খবরটি সামনে আসে। ইতিমধ্যেই প্রায় ২০ হাজার এডুকেটর রয়েছেন এই প্ল্যাটফর্মে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু টিচার ছাত্র-ছাত্রীদের খুবই পছন্দের। তারা প্রায় ২০ থেকে ২৫ লক্ষ টাকার প্যাকেজ পাচ্ছেন বাইজু-তে। এমন কয়েকজন টিচার আছে যারা প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকার প্যাকেজ পান। এই কোম্পানির অন্যতম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর শাহরুখ খান। কয়েকদিন আগেই ভারতীয় ক্রিকেট টিমের স্পনসর ছিল এই সংস্থাটি। এমনকী, আসন্ন ফুটবল বিশ্বকাপে-ও অন্যতম স্পনসর বাইজুস। এহেন একটি সংস্থা নাকি বর্তমানে লস মেকিং কোম্পানি! ভাবা যায়... তবে বাইজুসের লসের পিছনের মূল কারণগুলি কী কী ? আসুন জেনে নেওয়া যাক।
প্রথমত, এই সংস্থাটি অত্যন্ত দ্রুতগতির সঙ্গে নিজেদের ব্যবসাকে বাড়াতে চেষ্টা করেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের টিচারদের আনতে তারা বিভিন্ন ইনসেন্টিভ স্কিম ডিজাইন করেছে। অনলাইনে জনপ্রিয় বহু শিক্ষকদের বিপুল অঙ্কের বেতন দেয় সংস্থা। বর্তমানে সেই বেতন এবং ইনসেন্টিভের খরচ এতটাই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে যে তারা আর সামাল দিতে পারছে না। পাশাপাশি নিজেদের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে সুপারস্টার শাহরুখ খান-কে আনা এবং ভারতীয় দলের পাশাপাশি একটি ফুটবল বিশ্বকাপ স্পনসর করা তাদের মার্কেটিংয়ের খরচ আরও বাড়িয়েছে। বর্তমানে সেই কারণেই মার্কেটিং টিম থেকে এত কর্মী ছাঁটাই করতে হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, অনিয়ন্ত্রিতভাবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছে বাইজুস। সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় ৫.৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ১৬টি বড় বড় ক্যাপিটাল ভেঞ্চার কোম্পানি অধিগ্রহণ করেছে বাইজুস। ভেঞ্চারগুলিকে সুদক্ষভাবে পরিচালনার অভাবে, তারা যতটা ইনভেস্ট করেছিল, সেই মোতাবেক রিটার্ন পায়নি। ফলত তাদের এক্সপ্যানশন স্ট্র্যাটেজি কিছুটা হলেও ধাক্কা খেয়েছে।
তৃতীয়ত, বর্তমানে বাইজুসের কনটেন্ট ছাত্র-ছাত্রীদের আর পছন্দ হচ্ছে না। অনেক ট্রেড অ্যানালিস্টদের মতে কনটেন্টের থেকে বেশি মার্কেটিংয়ে খরচ করছে বাইজুস। এদিকে বাইজুস-এর সেলস টিমের ওপর কোর্স বিক্রির তুমুল চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ কর্মীদের। তাদের দাবি যদি কোর্সের মান ভালো না হয় তাহলে তারা কীভাবে বিক্রি করবেন!
তবে বাইজু রবীন্দ্রনের দাবি যদি যথাযথ হয়, কোম্পানি যদি সত্যিই এই অর্থবর্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা আয় করে থাকে তাহলে হয়তো খুব শীঘ্রই আবার লাভজনক কোম্পানি হয়ে উঠবে বাইজুস। তবে অডিটের আগে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় স্টার্ট-আপের (বাইজুসের বর্তমান ভ্যালুয়েশন ২৩ বিলিয়ন ডলার) ভবিষ্যৎ কোন দিকে এগোবে, সেটাই এখন দেখার।