বুড়িয়ে যাওয়ার সংকটে চিন! কেন জনসংখ্যা কমাতে পারে না ভারত?

China Population: চিনের সরকার ঠিক করেছে, তিন বছর ধরে প্রথম সন্তানের জন্য ৪৪৪ ডলার এবং তৃতীয় সন্তানের জন্য ১৫০০ ডলার সন্তান প্রতিপালনের খরচ হিসেবে দেওয়া হবে

কোভিডের পরে চিন এখন নতুন সমস্যায় পড়েছে। যে দেশের জনসংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, তারাই এবার আশঙ্কা করতে শুরু করেছে যে, তাদের জনসংখ্যা পড়তির দিকে! আজ থেকে ছয় দশক আগে চিনে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হয়। সেই সময় চিনের জনসংখ্যা বেশ খানিকটা নেমে আসে। যা খবর আসছে তাতে, চিন ধনী হওয়ার আগেই বুড়ো হয়ে যাবে- এই আশঙ্কা করছেন অনেকেই। খবর বলছে, শুধুমাত্র বেইজিংয়ের জনসংখ্যাই অর্ধেক হয়ে যেতে পারে ২১০০ সালের মধ্যে। এমনিতে জনসংখ্যা কমার খবর পেলে, অনেকেই উল্লসিত হয়ে ওঠেন! এই তো চিনও জনসংখ্যা কমানোর দিকে নজর দিয়েছে, তাহলে ভারত কেন পারে না? কিন্তু চিনের এই জনসংখ্যা হ্রাসের কারণ কী?

১৯৮০ সালে চিনের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি দেং জিয়াওপিং চিনের জনসংখ্যা কমানোর জন্য ‘এক সন্তান নীতি’ প্রণয়ন করেন। সেই সময় তাঁর যুক্তি ছিল, চিনের যা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার, তা যদি একই থাকে, তাহলে আগামী দিনে চিনের সম্পদে টান পড়তে পারে। তাই যদি কোনও দম্পতির একের অধিক সন্তান হয়, তাহলে সেই সন্তানদের ভরণপোষণের দায়িত্ব আর চিনের সরকার নেবে না। গত চার দশক ধরে এই নীতিই তারা চালিয়ে এসেছে। এই নীতির ফলে নানা সময়ে দেশবাসীর উপরে বিভিন্ন আইন চাপাতে হলেও সরকারের তরফে এই নীতি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবা হয়নি।

এই ‘এক সন্তান নীতি’র ফলও মিলেছে হাতেনাতে। দ্রুত চিন পৃথিবীর মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে কিন্তু দেখা গেছে এই নীতির ফলে শিশুকন্যা ভ্রুণ হত্যা বেড়ে গেছে। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। শিশু কিশোরদের মধ্যে স্থূলতা বেড়ে গেছে। ২০১৪ সালের এক পরিসংখ্যান বলছে, মহিলা-পুরুষের হার কম হওয়াতে বিয়ে করার মতো পাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না! অন্ততপক্ষে ১০,০০০ শিশুকন্যাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রথম সন্তানের পরে, দ্বিতীয়বার কোনও দম্পতি যদি সন্তান ধারণ করতেন তখন সরকারের পক্ষ থেকে জোর করে গর্ভপাতও করানো হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই নীতির এক সুদূরপ্রসারী ফল মিলতে চলেছে। অর্থাৎ আগামী দিনে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা চিনে আরও কমবে।

আরও পড়ুন- ২৫৬ বছরের জীবনে মোট ২৩ বার বিয়ে! চিনের এই ‘রহস্যময়’ বৃদ্ধ আসলে কে!

বেইজিং কিংবা তার আশেপাশের শহরে ‘এক সন্তান নীতি’র ফলাফল দেখে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির মাথাদের টনক নড়ে। ২০১৬ সালে সরকার ওই নীতি বদলে প্রথমে দুই, তারপরে ২০২১ সালে দুইয়ের অধিক সন্তান নীতি গ্রহণ করে কিন্তু তাতেও খুব বেশি লাভ হয়নি। জন্মহারে খুব বেশি উন্নতি হয়নি। সরকারের তরফ থেকে নানা উৎসাহব্যঞ্জক প্রকল্প ঘোষণা করা সত্ত্বেও চিনের জন্মহারে কোনও হেরফের হয়নি। পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং বাসস্থানের খরচ বেড়ে যাওয়ার ফলে চিনের মানুষজনও আর উৎসাহী নন একের অধিক সন্তান নিতে। এমনিতে চিনের সন্তান প্রতিপালনের খরচ জাপান এবং আমেরিকার থেকে বেশি। তাই চিনের কমিউনিস্ট সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তিন বছর ধরে প্রথম সন্তানের জন্য ৪৪৪ ডলার এবং তৃতীয় সন্তানের জন্য ১৫০০ ডলার সন্তান প্রতিপালনের খরচ হিসেবে দেওয়া হবে। তাও চিনের দম্পতিরা একের অধিক সন্তানের জন্ম দিতে উৎসাহী নন। তার অন্যতম একটি কারণ হলো, কোভিডের কারণে বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন এবং বহু মানুষের বেতন হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসা খাতে প্রতিটি পরিবারের ব্যায়বৃদ্ধি হয়েছে।

চিন মনে করে, তারা অর্থনৈতিকভাবে উন্নয়নকামী দেশ এবং যে বিদেশি বিনিয়োগ চিনে এতদিন করা হয়েছে, তা তাদের 'সস্তা' শ্রমিকদের কথা ভেবেই হয়েছে। যদি চিনের জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পায় তাহলে সেখানকার মানুষ ভোগ্যপণ্যে কম আকর্ষিত হবেন, ফলে বিনিয়োগও কমতে শুরু করবে। মধ্য আয়ের মানুষজন কম জিনিসপত্র কিনবেন এবং সঞ্চয় বাড়ানোর কথা ভাববেন, ফলে সরকারের বিদেশি বিনিয়োগের নীতিও প্রশ্নের মুখে পড়বে।

চিনের এখনকার রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং যদিও বলছেন, তাঁরা এই ধাক্কা সামলে নেবেন। সরকার চিনের নাগরিকদের বোঝাবে, কেন দেশের উন্নতির জন্যই দম্পতিদের একের অধিক সন্তানের প্রয়োজন। কিন্তু তাও চিন যেভাবে অকাল বার্ধক্যে পৌঁছে যাচ্ছে তা চিনের সরকারের জন্য যথেষ্ট চিন্তার কারণ। অনেকে বলতে পারেন, চিন নিয়ে এত কথা কেন? ভারতের জনসংখ্যা তো আগামী কিছুদিনের মধ্যেই ১৪০ কোটি ছোঁবে! আর আমাদের সমস্যা তো বরং উল্টো। আমাদের দেশে বেকারের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কী করে এত সংখ্যক মানুষকে সরকার খাবার জোগাবে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করা জরুরি। আমাদের অর্থনীতি কি সেই হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যাতে কর্মক্ষম সমস্ত মানুষকে কাজ দেওয়া যায়? এখনও ভারতের জনগণনা হয়নি কিন্তু তাতেই যা আন্দাজ করা যাচ্ছে, ভারতের বেকার সমস্যা আগামী দিনে যে কোনও সরকারকে বেশ বেগ দেবে। বিশ্বব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে জনসংখ্যার প্রায় ৪৬ শতাংশ কর্মক্ষম মানুষ। সেই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, কাজের ক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো কম। এখনকার শাসকরা এই তথ্য খুব ভালো করেই জানেন। তাই বিভাজনের রাজনীতি করে এই সমস্যা থেকেও মুখ ঘুরিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করে চলেছেন প্রতিনিয়ত।

আরও পড়ুন- ১০ বছর দেশের মানুষের তথ্যই জানে না বিজেপি সরকার! জনগণনা না হলে আখেরে কার লাভ?

এমনিতেই ঘৃণার রাজনীতিতে এক বদ্ধমূল ধারণা অনেক মানুষেরই মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র। মুসলিমদের প্রচুর সন্তান, বহুবিবাহ সংক্রান্ত তথ্য এনে প্রমাণের চেষ্টা চলছে যে, জন্মনিয়ন্ত্রণ যদি করতেই হয়, মুসলিমদেরই করা উচিত। অথচ জনগণনা করলে হয়তো এই ধারণা কিছুটা হলেও ভাঙত। যদিও এই সরকারের তা নিয়ে উচ্চবাচ্যই নেই। তথ্য দেখলে বোঝা যাবে, মুসলিম পরিবারও ছোট হয়ে আসছে এই অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে। মাঝে মধ্যেই হুঙ্কার শোনা যায়, জন্মনিয়ন্ত্রণ বিল আনা হবে। তাহলেই ভারতের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু জন্মনিয়ন্ত্রণ বিল তো শুধু বিশেষ ধর্মের জন্য আনা হবে না। সমস্ত ধর্মের মানুষদের জন্যই তা আনা হবে। আর তার ফল যদি চিনের মতো হয় তখন কি ভারতের মতো বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশ তা সামাল দিতে পারবে?

চিন যে আইন এনেছিল ১৯৬০ সালে, সেইরকম কোনও আইন যদি আমাদের দেশে আনা হয়, তাহলে চিন যে অসুবিধায় পড়েছে আমরাও কিন্তু আগামী দিনে একইরকম বিপদের সম্মুখীন হব। বিভিন্ন দৈনিক আলাপচারিতায় যে আমরা বলে থাকি, এত জনসংখ্যার জন্যই ভারতের এত সমস্যা, সেই ধারণার বদলে যদি আমরা ভাবতে শুরু করি, কীভাবে এই এত মানুষের কাছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কাজের পরিধি খুলে দেওয়া যায়, তাহলেই চিত্রটা বদলাতে পারে হয়তো।

More Articles