যুদ্ধের প্রস্তুতি শি জিনপিংয়ের, কেন তাইওয়ানের দখল চায় চিন?

China-Taiwan Conflict: সাম্প্রতিক কালে ফের তাইওয়ান দখলে উঠেপড়ে লেগেছে চিন। আর তারই প্রমাণ দিচ্ছে তাইওয়ান ঘেঁষে ড্রাগন সেনার সামরিক মহড়া।

প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল-ঘেঁষা দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ান। সেই তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের সংঘাত দীর্ঘদিনের। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে এই দুই দেশের মধ্যে। তবে সাম্প্রতিক কালে ফের তাইওয়ান দখলে উঠেপড়ে লেগেছে চিন। আর তারই প্রমাণ দিচ্ছে তাইওয়ান ঘেঁষে ড্রাগন সেনার সামরিক মহড়া। অভিযোগ উঠেছে, তাইওয়ান সংলগ্ন এলাকা থেকে লাইভ ফায়ারিং মহড়া চালিয়ে যাচ্ছে চিন। এমনিতেই বিশ্ব জুড়ে যেভাবে একের পর এক দেশের মধ্যে সংঘাত পরিস্থিতি লেগেই রয়েছে। তার মধ্যে চিন-তাইওয়ানের এই উস্কে ওঠা সংঘাত, যা নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে আন্তর্জাতিক মহলে।

গত সোমবার বেজিংয়ের তরফে ঘোষণা করা হয়, তাইওয়ান থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরের একটি দ্বীপে মঙ্গলবার সামরিক মহড়া চালাবে চিন। তার জন্য চার ঘণ্টা দ্বীপটি বন্ধ রাখার কথাও ঘোষণা করে তারা। জানা গিয়েছে, প্রায় ১৫৩টি সামরিক বিমান, সেইসঙ্গে ১৪টি যুদ্ধ জাহাজ ও উপকূলরক্ষী জাহাজ মোতায়েন করে তাইওয়ানের উপর চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করেছে চিন। তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী চো জং মঙ্গলবার জানান, চিনের এই মহড়া অনৈতিক, কারণ এর ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে। সামরিক মহড়ার স্কেল যতই বড় হোক না কেন, এই ভাবে ঘন ঘন তাইওয়ান সংলগ্ন এলাকায় তা করা একেবারেই অনুচিত। যদিও চিনের তরফে এই মহড়াকে রুটিন বলেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন: মোবাইল ছেড়ে হাতে হাতে পেজার! কেন সেকেলে যোগাযোগ মাধ্যমেই ভরসা লেবাননের?

চিনের সঙ্গে তাইওয়ানের সংঘর্ষের ইতিহাস কিন্তু দীর্ঘ। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকের এই দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ান এক সময় ছিল স্বাধীন এবং স্বশাসিত। সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময় সেই তাইওয়ানে উপনিবেশ স্থাপন করে নেদারল্যান্ড। প্রায় ৪০ বছর শাসন করার পর স্বাধীনতা পায় তাইওয়ান। প্রায় দু'দশক স্বাধীন ছিল তারা। কিন্তু সতেরো শতকের শেষে তাইওয়ানের দখল যায় চিনের হাতে। প্রায় দুই শতাব্দী চিনের নিয়ন্ত্রণে ছিল দ্বীপরাষ্ট্রটি। অবশেষে ১৮৯৫ সালে চিন-জাপান যুদ্ধের মাধ্যমে তাইওয়ানের দখল নেয় জাপান, এবং তা পরিণত জাপানি উপনিবেশে। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান হেরে যাওয়ার ফলে চিনের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাইওয়ানকে। ১৯৪৯ সালে চিনের শাসন যায় চিনা কমিউনিস্ট বাহিনীর হাতে। সে সময় চিনের জাতীয়তাবাদী সরকার ও তার সেনা পালিয়ে যায় তাইওয়ানে। যার ফলে চিনের হাত থেকে বেরিয়ে যায় তাইওয়ান। তবে তাইওয়ানে অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে মুখিয়ে রয়েছে চিন তবে থেকেই। বেজিং মনে করে, তাইওয়ানের উপর এক্তিয়ার চিনেরই। এ নিয়ে সংঘাত লেগেই রয়েছে দ্বীপরাষ্ট্রটির সঙ্গে চিনের।

সাম্প্রতিক কালে চিনের এই শক্তিপ্রদর্শন যে তাইওয়ান দখলের আভাসমাত্র, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না কারওরই। চিনের অন্যতম শত্রুদেশ আমেরিকা। স্বাভাবিক ভাবেই চিন-বিরোধিতার কারণে হোক বা ভৌগোলিক রাজনীতি, তাইওয়ানকে এতদিন ধরে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে এসেছে বাইডেনের দেশ। স্বাভাবিক ভাবেই চিনের এই তাইওয়ান-ঘেঁষা সামরিক মহড়াকে ভালো চোখে দেখছে না আমেরিকাও। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে চিনের নিউশন দ্বীপের চারপাশে লাইভ ফায়ার ড্রিল চালিয়েছে ড্রাগন সেনা। যা কিনা চিন ভূখণ্ড ও তাইওয়ানের মধ্যে সবচেয়ে কাছের একটি জায়গা। যা তাইওয়ানের রাজধানী তাইপেই থেকে মাত্র ১০০ মাইল দূরে। তাইওয়ানের প্রধানমন্ত্রী চো জং অবশ্য একে চিনের অর্থহীন হুমকি হিসেবেই দেখছেন।

তবে শুধু মাত্র ভূখণ্ডের দাবিদাওয়াই নয়, তাইওয়ানের সঙ্গে চিনের সংঘাতের নেপথ্যে জড়িয়ে রয়েছে বাণিজ্যগত কূটনীতির বিষয়টিও। দীর্ঘদিন ধরেই সেমিকন্ডাক্টরের দুনিয়ায় একচেটিয়া সাম্রাজ্য করে এসেছে তাইওয়ান। সেমিকন্ডাক্টর চিপ উৎপাদনের ব্যাপারে এই দ্বীপরাষ্ট্রকে টক্কর দেওয়া কঠিন ব্যাপার। এদিকে, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে রাজা হয়ে উঠতে চায় চিনও। কিন্তু তাইওয়ানকে ছাপিয়ে সেই জায়গায় পৌঁছনো শক্ত চিনের জন্যও। কার্যত বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর চিপের মধ্যে ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় তাইওয়ানে। আর সেই বাজারের সবচেয়ে বড় খেলোয়ার তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি (TSMC)। অ্যাপল থেকে শুরু করে একাধিক বড় সফটওয়ার, হার্ডওয়ার ও তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাকে চিপ সরবরাহ করে থাকে এই TSMC। এদিকে, তাইওয়ানের যে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে এই একচেটিয়া বাজার, তা আবার গ্লোবাল টেক ইকো-সিস্টেমের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

তবে সমস্যা অনেক। চিপ লিথোগ্রাফির জন্য প্রয়োজনীয় যে সিলিকন ওয়েফার, তা সরবরাহ হয় চিন থেকে। ফলে চিন যদি সেখানে কড়াকড়ি করে তাহলে বিপদে পড়তে পারে তাইওয়ান। পাশাপাশি আমদানি-রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় পারমিট প্রত্যাহার করেও বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে তাইওয়ানের জন্য বিপাক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে চিন। কার্যত সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে ব্যবহার করে অন্যান্য দেশের উপরেও রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চাপ বাড়ানোর ক্ষমতা রয়েছে বেজিংয়ের হাতে। কারণ চিনের কড়াকড়ির প্রভাব পড়বে তাইওয়ানের উৎপাদনে, যা বিশ্ববাণিজ্যকে প্রভাবিত করতে পারে সহজেই। কোভিড অতিমারির সময়ে তা হাড়ে হাড়েই টের পেয়েছিল গোটা দুনিয়া। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় সেমিকন্ডাক্টর শিল্প ও বাণিজ্য প্রসারে সফল হয়েছে তাইওয়ানে। আমেরিকার অ্যারিজোনায় তিনটি নতুন ফ্যাব (মাইক্রো চিপ তৈরির কারখানা) তৈরি করতে বহু অর্থ বিনিয়োগ করেছে তাইওয়ানের সংস্থা টিএসএমসি। এই সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে উত্তরোত্তর উন্নতি করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাইওয়ান। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেই লাই চিং-তে জানিয়েছিলেন, তাদের দেশ সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে আরও বেশি অগ্রগতি করতে প্রস্তুত, যা প্রভাব ফেলতে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। ক্ষমতায় এসেই চিনকে বার্তা দিয়ে লাই চিং জানিয়েছিলেন, তাইওয়ানের উপর কোনও অধিকার নেই চিনের। তাদের ইতিহাসই বলে দেয় তারা কোনও দিনই চিনের অংশ ছিল না। সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা তাদের মূল ভিত্তি। গত জানুয়ারিতে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন লাই চিং। তবে লাই-কে কোনওকালেই পছন্দ করে না চিন। বেজিংয়ের কাছে তিনি একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী। বেজিং দীর্ঘদিন ধরেই তাইওয়ানকে চিনের আওতায় থাকা স্বশাসিত রাষ্ট্র বলে মনে করে। যে ব্যাপারটির সঙ্গে একমত নয় লাইয়ের সরকার। তা সত্ত্বেও এক পা এগিয়ে লাই জানিয়েছিলেন, তিনি এবং তাঁর সরকার জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার বিষয়ে বা সংক্রামক রোগের মোকাবিলায় বিষয়ে এবং তাইওয়ান প্রণালীর দু'পাশে থাকা জনগণের কল্যাণ, শান্তি ও পারস্পরিক সমৃদ্ধি বৃদ্ধি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা বজায় রাখার বিষয়ে চিনের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।

আরও পড়ুন:এ কলকাতার মধ্যে আছে চৈনিক কলকাতা

কিন্তু বেজিং কি আদৌ চায় স্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবে তাইওয়ানের এই উত্থান? কিংবা সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে তাইওয়ানের এই উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি? বরং দু'শো বছর তাঁদের আওতায় ছিল যে দ্বীপরাষ্ট্রটি,  নরমে-গরমে তার উপর চাপ তৈরি করে রাখাটাই মূল উদ্দেশ্য চিনের, তেমনটাই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। বিশ্ববাজারে চিনের তেমন কোনও শক্তিশালী দেশ বন্ধু নয়। কারণ একচ্ছত্র ভাবে ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক বা বাণিজ্যিক ভাবে পৃথিবীর উপর আধিপত্য জারি করতে চায় চিন। আর সেক্ষেত্রে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের মূল খেলোয়ারকে যদি কোনও ভাবে নিজের ভূখণ্ডের আওতায় রাখা যায়, সে ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে যে প্রায় সর্বশক্তিমান হয়ে উঠতে পারে চিন, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। সে কারণেই কি তাইওয়ানের উপর চাপ বাড়িয়ে রাখতে চাইছে ড্রাগন সেনা? উস্কে উঠেছে একাধিক প্রশ্ন।

More Articles