দীপাবলির প্রদীপ জ্বালানোর নিয়মে লুকিয়ে শুভ-অশুভ! যে বিশ্বাস আজও অটল

Diwali Rituals: এমন কিছু ছোট ছোট টোটকা আছে, যা আমাদের দুর্ভাগ্যের অন্ধকার দূর করতে দীপাবলির সময় মেনে চলার কথা বলা হয়।

আগামী কিছুদিনের মধ্যেই আরম্ভ হতে চলেছে দীপাবলির উত্‍সব। ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে চলছে সেই উৎসবের তোড়জোড়। প্রথম দিনে ধনতেরস থেকে শুরু হয়ে এই উৎসবের প্রারম্ভ। শেষে ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার সুন্দর মেলবন্ধনে সমাপ্ত হয় বছরের এই শেষ উত্‍সব। এই আলোর উত্‍সব কেবল হিন্দু ধর্মর মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এমনকী, শিখ ও জৈন ধর্মর মানুষরাও একইভাবে এই উৎসবে সমবেত হয়। মূলত অক্টোবর মাসের শেষে ও নভেম্বর মাসের শুরুতে এই দীপাবলি উৎসবের তারিখ পড়ে। কিন্তু এই উৎসব পালন হয় কেন? কী এর ইতিহাস?

আসলে দীপাবলির সঙ্গে পুরাণের এক বিশেষে তাৎপর্য আছে। পুরাণে এমন অনেক ব্যাখ্যা আছে, যার জন্য আমরা মূলত এই উৎসব পালন করে থাকি। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় রামায়ণের কাহিনি। বলা হয়, এইদিনে নাকি রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের সঙ্গে বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যায় ফিরেছিল। তাই রামভক্তরা এই দিনে রাম ও সীতার আরাধনা করে থাকে।

গল্পানুসারে দশেরার দিনে রাম রাবণকে বধ করেছিল, এরপর যে দিন তাঁরা অযোধ্যায় ফেরে, সেই দিনটা দীপাবলি নাম পরিচিত। তাঁদের স্বাগত জানানোর জন্য অযোধ্যা নগরীজুড়ে হাজার হাজার প্রদীপ জ্জ্বালানো হয়। ১৪ বছর পর অবশেষে বনবাস কাটিয়ে, রাবণ বধ করে ফিরে আসে তাঁদের রাজা রাম, সঙ্গে সীতা ও লক্ষ্মণ। তাঁদের ঘরে ফেরার আনন্দে ওইদিন আলোর উত্‍সবে মেতে উঠেছিলেন অযোধ্যাবাসী। তিথি অনুসারে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষর দশমী তিথিতে রাবণ বধ হয়েছিলেন রামচন্দ্র দ্বারা। সেইদিন আমরা, বাঙালিরা বিজয়া দশমী পালন করে থাকি। আবার অনেক অবাঙালি হিন্দু ওই দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় দশেরায় রাবণ বধ অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। বলা হয়, তারপর প্রায় ২০ দিন লাগে রাম, লক্ষণ ও সীতাকে অযোধ্যায় আনতে। তাই জন্যই বিজয়া দশমী থেকে দীপাবলির মধ্যে প্রায় দুই সপ্তাহের ব্যবধান থাকে।

আরও পড়ুন: প্রায় এক কোটি দেবদেবীর মূর্তি! ত্রিপুরার এই পাহাড় আজও রহস্যে ঘেরা

রামায়ণ ছাড়া মহাভারতেও এর ব্যাখ্যা মেলে। বলা হয়, ভূদেবী ও নরকাসুর স্বর্গ, মর্ত্যজুড়ে প্রবল অত্যাচার করতে থাকে, সেই সংকট রুখতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা নরকাসুরকে বধ করে এবং তাঁর প্রাসাদে যে ১৬,০০০ নারী বন্দিনি ছিল, তাঁদেরও উদ্ধার করে। তাঁর মর্যাদা বাঁচাতে ১৬,০০০ বন্দিনিকেই বিয়ে করে নেন কৃষ্ণ। এই দিনে নরকাসুরের মৃত্যু হয়েছিল, তাই তাঁর মৃত্যুর দিনটি ধুমধাম করে পালন করা হয়। গল্পানুসারে এই দীপাবলির দিনেই নরকাসুর বধ হয়েছিল।

আবার জৈন ধর্মে এর ব্যাখ্যা আলাদা। তাঁদের মতে, এই দীপাবলির দিনেই তাঁদের ধর্মগুরু মহাবীর নির্বাণ লাভ করেছিলেন। এছাড়া মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গেও এর যোগসূত্র আছে। পুরাণ অনুসারে, এই দীপাবলিতেই তাঁরা তাঁদের বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস কাটিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে আসে। সেই খুশিতে গোটা হস্তিনাপুর সেজে উঠেছিল আলোর মালায়।

দীপাবলি হলো এক আলোয় মোড়া আনন্দ উৎসব। অন্ধকারের অবসান করে আলোর আহ্বানই এই উৎসবের মূল বিষয়বস্তু। কার্তিক অমাবস্যার সন্ধ্যায় দেশের প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে শুভ শক্তির আরাধনা করা হয় এই দিনে। বাঙালিরা ঘরে যদিও এই সময়ে শক্তির দেবী মা কালীর আরাধনা করে। অন্যদিকে অবাঙালি পরিবার এইদিনে ঘরে ঘরে লক্ষ্মী ও গণেশের পুজো করে , কোনও কোনও জায়গায় আবার বাঙালিরাও কোজাগরী পূর্ণিমার বদলে কার্তিক অমাবস্যায় লক্ষ্মীপুজো করেন, যাকে 'দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো' বলে।

দীপাবলি মানেই হাজার হাজার প্রদীপের ভিড়। অন্ধকারকে দূরে সরাতে এদিন আমরা প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকি, যা শুভর প্রতীক। দীপাবলির সময় এমন কিছু ছোট ছোট টোটকা আছে, যা আমাদের দুর্ভাগ্যের অন্ধকার দূর করতে মেনে চলার কথা বলা হয়।

আমরা সাধারণত প্রদীপ জ্বালানোর সময় তাতে তেল ব্যবহার করে থাকি, কিন্তু দীপাবলির সন্ধেয় তেলের জায়গায় ঘি দিয়ে প্রদীপ জ্বালালে তা অত্যন্ত শুভ নির্দেশ দেয়। মনে করা হয়, দীপাবলির দিন ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালালে সমস্তরকম অশুভ শক্তি দূরে সরে যায় ও এক শুভ শক্তির দিকে ইঙ্গিত করা হয়। কিন্তু বাস্তবের ঘিয়ের দাম তেলের চেয়েও বেশি, তাই সেই ক্ষেত্রে বিষয়টা ব্যায়সাপেক্ষ হয়ে যায়। ব্যায় কমাতে সব প্রদীপে ঘি না দিয়ে কেবল দরজার সামনে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালালেও সেটাই অনেক।

দীপাবলির দিন প্রদীপে একটি লবঙ্গ রেখে দেওয়ার কথা বলা হয়, তাতেও অশুভ শক্তির পতন হয়। লবঙ্গ জ্বলে উঠলে সেখান থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয়, তা অত্যন্ত শুভ। বলা হয়, এর ফলে ঘরে ঘরে সুখ-সমৃদ্ধি আসে। এই প্রদীপটি ঠাকুরের আসনের সামনে রেখে দেওয়া উচিত।

এটা হয়তো অনেকেরই জানা যে, দীপাবলিতে তিলের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালাতে বলা হয়। নিতান্ত ঘি না পেলে সেই ক্ষেত্রে তিলের তেল দিয়ে প্রদীপ জ্বালালে নাকি তা শুভ সংকেত প্রদান করে। কথায় আছে, কোনও গ্রহদোষ থাকলে তাও তিলের তেলের ধোঁয়ায় কেটে যায়।

আমরা বেশিরভাগ প্রদীপে সরষের তেল ব্যবহার করে থাকি, শনির দশা কাটাতে নাকি সরষের তেলের প্রদীপ বিশেষ উপযোগী। সন্ধেবেলায় ঠাকুরের আসনের সামনে একটি পঞ্চপ্রদীপ রাখা অত্যন্ত অবশ্যক। এটি পরিবারের সুস্থতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক বলে মনে করা হয়।

পুজোর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হলো ব্রহ্মস্থান। বাস্তুমতে বাড়ির ঠিক মধ্যবর্তী অংশটি সব সময় খোলামেলা রাখা উচিত যাতে পর্যাপ্ত আলোবাতাস চলাচল করতে পারে। দীপাবলির আগে সেই স্থান ভালো করে পরিষ্কার করা উচিত। বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণ অর্থাৎ ঈশান কোণকে শুভ অংশ বলা হয়। সেখানেই পুজোর ব্যবস্থা করতে পারলে গৃহদেবতা খুশি হয় বলে বিশ্বাস।

More Articles