কেন ট্রাম্পের নজরে ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক কেন্দ্র?
Iran Fordo Nuclear Site: ফোর্দোর অবস্থান এবং গঠনের কারণে তাকে ধ্বংস করা সহজ নয়। এর অবস্থান পাহাড়ের গভীরে, তাই সাধারণ বোমা দিয়ে এটার ক্ষতি করা কঠিন।
ইরানের ফোর্দো পারমাণবিক ঘাঁটিতে হামলার কথা জানিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। হামলা হয়েছে নাতাঞ্জ আর ইসফাহানের পারমাণবিক ঘাঁটিতেও। এই আক্রমণের সত্যতা স্বীকার করে নিয়েছে ইরান। ট্রাম্প এই হামলার কথা জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন 'ফোর্দো ইজ গন'। প্রশ্ন হলো, সত্যিই কি তাই? কেন ফোর্দোই ট্রাম্পের পাখির চোখ?
ফোর্দো ফুয়েল এনরিচমেন্ট প্ল্যান্ট, যাকে সংক্ষেপে এফএফইপি বলা হয়, ইরানের কোম শহরের কাছে একটি পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত। এটা মাটির নীচে তৈরি একটি গোপন ঘাঁটি। আগে এখানে ইরানের বিপ্লবী গার্ডের একটি ক্যাম্প ছিল। ২০০৯ সালে পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই কেন্দ্রের খবর পায়, তারপর থেকে ফোর্দো বিশ্বের নজরে।
এই কেন্দ্রে ইউরেনিয়ামের শক্তিবৃদ্ধি করা হয়। এই শক্তিশালী ইউরেনিয়াম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যায়, আবার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্যও। ফোর্দোর মতো জায়গা আন্তর্জাতিক মহলের তুমুল আগ্রহের বিষয়। ইজরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার পর ফোর্দো নিয়ে আলোচনা আরও বেড়েছে।
ফোর্দোর গঠন খুব শক্তপোক্ত। পাহাড়ের ভেতরে, মাটির অনেক গভীরে অবস্থিত। এই কারণে ফোর্দোকে ধ্বংস করা খুব কঠিন। কেন্দ্রটি আয়তনেও ছোট, তবে এখানে প্রায় তিন হাজার সেন্ট্রিফিউজ মেশিন আছে। এই মেশিনগুলো ইউরেনিয়ামের শক্তি বৃদ্ধি করতে ব্যবহৃত হয়। ইরানের দাবি, ফোর্দো সহ অন্যান্য জায়গায় যন্ত্রপাতি তারা আগেই সরিয়ে ফেলেছিল।
আরও পড়ুন- ইরানের পারমাণবিক ঘাঁটিগুলির কতটা ক্ষতি হয়েছে?
ফোর্দোর গুরুত্ব কেন অন্য কেন্দ্রর থেকে বেশি?
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বিশ্বে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। ২০১৫ সালে ইরান ও বিশ্বের তাবড় দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল, যাকে বলা হয় জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন (জেসিপিওএ)। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরান প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করবে না। ফোর্দোতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার কথাও ছিল। ২০১৮ সালে আমেরিকা এই চুক্তি থেকে সরে যায়। তারপর থেকে ইরান আবার ফোর্দোতে ইউরেনিয়াম প্রকল্প শুরু করে।
২০২৪ সালের হিসেবে, ফোর্দোতে ইরান ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়ামের শক্তিবৃদ্ধি করছে। পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ৯০ শতাংশ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের এখনও অস্ত্র তৈরির জন্য আরও কিছু পদক্ষেপ করা বাকি। ফোর্দোর কার্যক্রম তাই এখনও অসম্পূর্ণ বলেই ধরতে হবে।
ফোর্দোকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা সম্ভব?
ফোর্দোর অবস্থান এবং গঠনের কারণে তাকে ধ্বংস করা সহজ নয়। এর অবস্থান পাহাড়ের গভীরে, তাই সাধারণ বোমা দিয়ে এটার ক্ষতি করা কঠিন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এমন কিছু শক্তিশালী অস্ত্র আছে, যেগুলো মাটির গভীরে থাকা লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর (এমওপি), যাকে বলা হয় জিবিইউ-৫৭। এই বোমার ওজন ১৪ টন। এই বোমা মাটির ৬০ মিটার গভীরে গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। কিন্তু, ফোর্দোর গভীরতা এর থেকেও বেশি হতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এমওপি ব্যবহার করে ফোর্দোর মূল অংশ ধ্বংস করা সম্ভব নাও হতে পারে। এছাড়া, ফোর্দোর চারপাশে ইরানের শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম আছে। আমেরিকার বিমান বা মিসাইলকে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পরাজিত করতে হবে। সংবাদ সংস্থা তাসনিম জানিয়েছে, ফোর্দোর একটি অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
আরও একটি আশঙ্কা রয়েছে। ফোর্দোতে পারমাণবিক উপাদান থাকায় হামলা করলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়তে পারে। তেজস্ক্রিয় দূষণ মুহূর্তে লক্ষ মানুষের জীবন বিপন্ন করতে পারে।
আরও পড়ুন- ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ইরান! কেন দুই দেশের সর্ম্পকের অবনতি হলো?
উল্লেখ্য, ট্রাম্প ফোর্দো হামলা করেলে ইরানও চুপ করে থাকবে না। তারা পাল্টা হামলা করতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন ঘাঁটি বা তার মিত্র দেশগুলোর ওপর হামলা করতে পারে ইরান। এছাড়া, ইরানের মিত্র গোষ্ঠী, যেমন হিজবুল্লাহ বা ইয়েমেনের হুথিরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্রদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করতে পারে। এমন পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলকে আরও বড় যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ইতিমধ্যেই ইরান বলছে, এখন যে কোনো মার্কিন নাগরিক-সামরিক স্থাপনাই তাদের টার্গেট হতে পারে।
তাছাড়া ফোর্দো ধ্বংস হলেও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ হবে না। ইরানের আরও কেন্দ্র রয়েছে, যেমন নাতাঞ্জ। তবে ফোর্দো ধ্বংস হলে তাদের অস্ত্র তৈরির গতি কমে যেতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান এখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির খুব কাছে। কিন্তু শেষ কথা বলার সময় আসেনি।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আমেরিকা এবং ইজরায়েলের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। ইজরায়েল বারবার বলছে, তারা ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেবে না। আমেরিকাও এই বিষয়ে কঠোর অবস্থানে। এর ফলে বড় ধরনের যুদ্ধ শুরু হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফোর্দো ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। গভীর অবস্থান এবং গঠনের এই কেন্দ্র ধ্বংস করা প্রায় অসম্ভব। ফোর্দো নিয়ে উত্তেজনা কমাতে কূটনৈতিক পথ কি এখনও খোলা? বিশ্ব তাকিয়ে সেদিকেই।