কেন সৌদি আরবে আশ্রয় চাইছেন শেখ হাসিনা?
Sheikh Hasina Political asylum: নওয়াজ শরিফ এবং বেনজির ভুট্টো আর বিএনপির তারিক রেহমান সহ নির্বাসিত অনেক নেতাকে যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি দিলেও হাসিনাকে দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে পালিয়ে চলে আসেন ভারতে। তারপর সময় হু হু করে পেরিয়ে গেলেও শেখ হাসিনা অবশেষে কোন ঠিকানায় থিতু হবেন তা স্পষ্ট নয় এখনও। ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন হাসিনা। কিন্তু হাসিনার এই অনুরোধ রাখা যে খুব একটা সম্ভব নয় তা বুঝিয়ে দিয়েছে সেই দেশ। মাত্র ৪৫ মিনিট সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগ করতে হয়। তারপর থেকেই জল্পনা চলে, পাকাপাকি কোন দেশে যাবেন তিনি? ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের থেকে সবুজ সংকেত না পাওয়াতে, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং সৌদি আরবের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন তিনি। যোগাযোগ করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফিনল্যান্ড এবং ভারতের সঙ্গেও, হাসিনার অনেক নিকটাত্মীয়ই থাকেন। এই মুহূর্তে শেখ হাসিনা আর তাঁর বোন শেখ রেহানা সিদ্দিক 'সেফ হাউসে' রয়েছেন।
ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের সরকার জানাচ্ছে, অভিবাসন আইন অনুযায়ী যুক্তরাজ্যের বাইরে থাকা ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়া বা অস্থায়ী আশ্রয় দাবি করার কোনও বিধান নেই। "যাদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রয়োজন তাদের উচিত প্রথম নিরাপদ দেশটিতেই আশ্রয় চাওয়া (এক্ষেত্রে, ভারত), এটিই নিরাপত্তার দ্রুততম পথ।" হাসিনা যুক্তরাজ্যে নিয়মিত ভিসার জন্য আবেদন করেছেন কিনা সে বিষয়ে অবশ্য সরকারি কর্মকর্তারা কিছুই স্পষ্ট করেননি।
আরও পড়ুন- হাসিনার দেশে কাদের গুম করে রাখা হতো কুঠুরিতে! কী এই রহস্যময় আয়নাঘর?
বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে অবতরণের পরই যুক্তরাজ্যে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন, এই আশায় যে তিনি সরাসরি বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর যে বিমানে চড়ে যেতে দিল্লিতে এসেছিলেন, সেটিতেই লন্ডনে চলে যেতে পারবেন। বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব আইনের অধীনে শেখ রেহানার যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট রয়েছে এবং তাঁর মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক হ্যাম্পস্টেড এবং হাইগেটের (উত্তর লন্ডন) বর্তমান লেবার মেম্বার অব পার্লামেন্ট (এমপি) এবং ট্রেজারি ও সিটি মিনিস্টারের অর্থনৈতিক সচিব।
কিন্তু হাসিনার আশা পূর্ণ হয়নি। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি বিবৃতি জারি করেন যাতে শেখ হাসিনা বা তাঁর এই আশ্রয় চাওয়ার অনুরোধের কথা উল্লেখই করা হয়নি। উল্টে, তিনি বলেছিলেন, "বাংলাদেশের জনগণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা ঘটনাগুলির জন্য জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি পূর্ণাঙ্গ এবং স্বাধীন তদন্তের দাবি রাখে"। অর্থাৎ ইঙ্গিত স্পষ্ট যে, স্টারমার সরকার হাসিনার এই দমন পীড়নের আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য চাপ দিতে পারে। শেখ হাসিনাকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হতে পারে। যদিও অতীতে, নওয়াজ শরিফ এবং বেনজির ভুট্টো আর বিএনপির তারিক রেহমান সহ নির্বাসিত বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি নেতাকে যুক্তরাজ্যে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
ইউরোপে হাসিনার পরবর্তী বিকল্প হেলসিংকি। এখানে রেহানার পুত্র রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক 'ববি' থাকেন। তিনি ফিনল্যান্ডের একজন নাগরিককে বিয়ে করেছেন। রাদওয়ান সিদ্দিক বাংলাদেশের একজন যুব কর্মী ছিলেন। সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন এবং ইয়ং বাংলা এনজিও-র প্রধান ছিলেন। কোভিড মহামারী চলাকালীন, ২০২১ সালে হাসিনা হেলসিংকিতে কিছুটা সময় ছিলেন। ফিনিশ প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাবের কার্যালয় অবশ্য হাসিনার এই রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার অনুরোধের বিষয়ে কিছু জানায়নি।
আরও পড়ুন- পঞ্চাশ বছর আগে হারিয়েছিলেন পরিবার, আর এক গণঅভ্যুত্থানে দেশ হারালেন মুজিব-কন্যারা
শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ায় থাকেন। তাঁর স্ত্রী একজন আমেরিকান আইনজীবী। বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার সময় ওয়াজেদ গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা এবং নোবেলজয়ী মহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য সমালোচিত হন। বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হয়েছেন ইউনূস। বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে হাসিনার সম্পর্ক ভালো নয়। বিশেষ করে 'বাংলাদেশে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন'- এর লক্ষ্যে আমেরিকা মে ২০২৩-এ যে বিশেষ ভিসা নীতি নেয় তাতে দুই দেশের সম্পর্ক কঠিন হয়ে যায়। এবছরের জানুয়ারি বাংলাদেশে হওয়া নির্বাচন নিয়েও কড়া সমালোচনা করে আমেরিকা। এই বছরের মে মাসেই, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'পশ্চিমি সরকার' বলপ্রয়োগ করে বাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের চেষ্টা করছে। হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পরে মার্কিন ভিসার জন্য আবেদন করেছিলেন কিনা তা জানা যায়নি অবশ্য।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক পড়শি বাংলাদেশের। গত এক দশক ধরে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সরকারের সঙ্গে মোদি সরকারেরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তা সত্ত্বেও দিল্লিতে হাসিনার থাকা খুবই বিড়ম্বনার। হাসিনার কন্যা দিল্লিতে থাকেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আঞ্চলিক পরিচালক তিনি। নয়াদিল্লি এই কূটনৈতিক জটিলতায় নিজেকে ফেলবে কিনা তা বড় প্রশ্ন। যদি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বা নতুন কোনও সরকার হাসিনার প্রত্যর্পণের দাবি করে, তাহলে ভারতের পক্ষে অবস্থান নেওয়া কঠিন হবে। একই কারণে, মোদি সরকার শ্রীলঙ্কার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি গোটাবায়া রাজাপাক্ষে বা আশরাফ ঘানি সরকারের অনুরোধ গ্রহণ করেনি। এঁরাও নিজ নিজ দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তাছাড়া ভারতে শেখ হাসিনা থেকে গেলে, বাংলাদেশ থেকে আরও অনেকে আশ্রয় চাইতে পারেন, আর ভারত যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে সেই অভিযোগও উঠবে। তবে নয়াদিল্লি হাসিনাকে অতিথি করে রাখবে আপাতত। তাঁর বাবা এবং বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমান সহ সারা পরিবারকে ১৯৭৫ সালে যখন হত্যা করা হয় তখনও তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।