কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা হলে সরকারকে কখনই পাশে পাবে না মেয়েরা?
International Women's Day: ধর্ষকের ফাঁসি দিয়ে ধর্ষণ কমেছে, এরকম কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই৷ ফাঁসির ‘অব্যর্থ দাওয়াই’-য়ের বদলে আসলে আমাদের চাই শাস্তির নিশ্চয়তা।
আরজি করের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের কর্মস্থলে নিরাপত্তা নিঃসন্দেহে প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে পড়েছে। কোনওমতে রাতের খাবার খেয়ে, বাড়িতে ফোন সেরে, সেই মেয়ে অন-কল অবস্থায় ধর্ষিতা ও খুন হন। অথচ, তার পরেপরেই সোশাল মিডিয়ায় উঠে আসে ছাত্রছাত্রীদের হাতে লেখা এক পোস্টার:
‘অধ্যক্ষ বলেছেন, রাতে মেয়েটির একা থাকা দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। অধ্যক্ষর লজ্জা হোক।’
এই ভঙ্গিতে যখন নির্যাতিতকেই দোষারোপ করা হয়, তখন বাকি মেয়েরা ভয় পান। ভয় পান তাঁদের পরিবার-পরিজন। দোলাচলে ভোগেন— তাহলে কি মেয়েদের রাতের আগেই সেঁধিয়ে যেতে হবে ঘরে? ধর্ষণ, খুন আর নিরাপত্তার অভাব নিয়ে ক্ষোভ তো ছিলই। তার উপর এই ধামাচাপার প্রবণতা এবং ভিক্টিম-ব্লেমিং আগুনে ঘৃতাহুতি দিল। যে রাতে একা ছিল বলে নাকি মেয়েটি ধর্ষিতা ও খুন হয়েছে বলে দাবি করেছিল কর্তৃপক্ষ, সেই রাতকে দখল করতে চাইল মেয়েরা। লক্ষ মেয়ে পথে নামল ১৪ অগাস্ট, ২০২৪। বিকেন্দ্রিক এই আন্দোলন হলো কলকাতা থেকে কাকদ্বীপে, ক্যানিং থেকে কানাডায়। একই রাতে প্রায় দুই শত জায়গায়। এই প্রথম মনে হয়, ভারতবর্ষে একটি আন্দোলন শুধু ধর্ষণের ঘটনার নিরিখে বিচার ও শাস্তি দাবি করল না। বরং নির্যাতনের জন্য নির্যাতিতাকেই দায়ী করার বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে রুখে দাঁড়াল আপামর নারী-প্রান্তিক লিঙ্গযৌন গোষ্ঠী। আর স্পষ্ট করে আবারও একবার কর্মক্ষেত্রে যৌন নিরাপত্তা দাবি করল।
সম্ভবত শুধু ক্ষোভ নয়, রাত দখল আন্দোলনে ভয়ও মিশে ছিল। কর্মজগতে জমি হারানোর ভয়। এটাই কি অলিখিত সমাজসম্মত দস্তুর যে রাতের আগেই মেয়েদের ঘরে সেঁধিয়ে যেতে হবে? কিন্তু মেয়ের কর্মজগৎ যদি তার অনুমতি না দেয়? একবিংশ শতকের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মেয়েদের কাজে যাওয়া হয়তো খানিক মেনে নেওয়া গেছে। তাহলে কি এমন কর্মজগতই বাছবে মেয়েরা, যেখানে রাতে ডিউটি থাকে না? সমাজ-মতে যেমন ‘মেয়েদের উপযুক্ত’ পাঠ্য বিষয় হলো ‘আর্টস’, তেমনই তাদের উপযোগী চাকরি হলো ‘শিক্ষকতা’? সেক্ষেত্রেও যুক্তিক্রম থাকে একই— এগুলি মেয়েদের উপযুক্ত কাজ, কারণ এখানে কর্মঘণ্টা শেষ হয় নির্দিষ্ট সময়ে৷ এইভাবে মেয়েদের কর্মজগৎ ঘিরে নিজস্ব স্বপ্ন, ইচ্ছা, উচ্চাকাঙ্খা সমাজনির্মিত খোপে কোনওমতে কেটেছেঁটে এঁটে নেওয়া হয়৷
এমনিতেই ভারতে কোভিড অতিমারী ও লকডাউনের পর মেয়েদের আবার কাজে যোগদানের হার কমেছিল। বলা হয়েছিল, লকডাউন শিথিল হওয়ার পর, লকডাউনের আগে কর্মরত মেয়েদের মাত্র ৫০% আবার ফিরেছিলেন কাজে, আর পুরুষরা ফিরেছিলেন ৯০%। সেই পশ্চাদপসারণ ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠছে ভারত। এমতাবস্থায় নারীসুরক্ষার বড় বড় ফাঁকফোঁকর ধরা পড়তে থাকলে এবং কর্মক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের এহেন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য বাড়লে, আরও কমবে না কি সেই হার?
নারী সুরক্ষার অভাবজনিত ভয়কে সময়ে সময়ে অন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন, কর্নাটকে নারী-শিশু কল্যাণ বিষয়ক এক যুগ্ম কমিটি ২০১৭ সালে তাদের ৩২তম রিপোর্টে লিখেছিল, বেঙ্গালুরুর আইটি ও বায়োটেকনোলজি সংস্থাগুলি যেন মেয়েদের রাতের ডিউটি না দেয়। এভাবেই নাকি মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে! কমিটির প্রধান বলেছিলেন, এ প্রস্তাব তাঁরা নিয়োগকারী কর্পোরেট সংস্থাগুলির থেকেই পেয়েছিলেন। কর্পোরেটগুলি বলেছিল, মেয়েরা রাতে নিরাপদ নয়। তাছাড়া রাতে তাদের বাড়িতে কাজ থাকে। তাই তারা শুধু দিনে ডিউটি করুক। নারী যদি রাতে ডিউটি না করেন, তবে তিনি কম সক্ষম কর্মী হিসেবে গণ্য হবেন না তো? এই বিষয়ে কোনও নিশ্চয়তা অবশ্য দেওয়া হয়নি। প্রায়শই বহুজাতিক সংস্থায় দেখা গেছে, মাতৃত্বকালীন ছুটির পর প্রোমোশন আটকে গেছে মেয়েদের। এমনকী ছাঁটাইও হয়েছে। নারীনির্যাতনের সুযোগ নিয়ে, নিয়োগকারী সংস্থাগুলি নিরাপত্তার অজুহাতে নারী-নিয়োগের দায়ও ঝেড়ে ফেলছেন না তো? মধ্যপ্রদেশের বিড় জেলায় আখের ক্ষেতে কাজ করা মেয়েদের মধ্যে জরায়ু বাদ দেওয়ার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, কারণ ঋতুকালে তো বটেই, এমনকী গর্ভবতী হলেও ছুটি পাওয়া সম্ভব ছিল না। ছাঁটাইয়ের ভয়ে তাই তাঁরা শরীর ছেঁটে ফেলছিলেন! কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা তো আছেই, আছে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সময় পথে হেনস্থার ভয়। তাছাড়াও সর্বক্ষণ কর্মসুযোগ সংকোচনের ভয়ও নারীকে তাড়া করে৷
তাহলে কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার একমাত্র উপায় কি রাতে অসুরক্ষিত যাতায়াত? ছিটকিনিহীন সেমিনার রুমে রাত কাটাতে বাধ্য হয়ে ধর্ষিত হওয়া? বা নিজের শরীর ও স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই কাজে যোগদান?
কর্মক্ষেত্রের সূচ্যাগ্র জমিও বিনা যুদ্ধে ছেড়ে দেব না যদি ভাবি, তবে যুদ্ধটির অভিমুখ স্পষ্ট হতে হবে। অভিমুখ হবে কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষার অধিকার আদায় করার উদ্দেশ্যে। যুদ্ধ হোক মেয়েদের অন্তর্ভুক্তির উপযুক্ত পরিবেশ নির্মাণ করার লক্ষ্যে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা নিয়ে আছে বিশাখা গাইডলাইন। থাকার কথা আইসিসি বা ইন্টারনাল কমপ্লেইন্ট কমিটি। নামেই তারা অবস্থান করে। তারা যথেষ্ট ক্রিয়াশীল কি? ধর্ষক যদি প্রতিষ্ঠানের ভিতরের কেউ হয়, তবে একটি নির্দিষ্ট চরম ধর্ষণের ঘটনার আগে সে নানাজনকে যৌন নিগ্রহ করে থাকতে পারে। ছোট বড় নানা নিগ্রহ সে করবেই— এমন আশঙ্কা হয়। আরজি করে বা অন্য সকল কর্মস্থলে, সেসবের দায়িত্বশীল খতিয়ান কি রেখেছে আইসিসি? অভিজ্ঞতা বলে, কর্মক্ষেত্রে দায়ে পড়ে আইসিসি গঠনে বাধ্য হলেও, বাৎসরিক একটি লিঙ্গসাম্যভিত্তিক কর্মসূচি নিতে বাধ্য হলেও, আইসিসিকে যথার্থভাবে সক্রিয় রাখতে উৎসাহী নয় অধিকাংশ কর্তৃপক্ষ। যুদ্ধ আরও হোক নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গের শারীরিক ও জৈব সুবিধে-অসুবিধে, এমনকী সামাজিক সুবিধে-অসুবিধে সম্বন্ধে সংবেদনশীলতা ও সার্বিক সচেতনতা তৈরির উদ্দেশ্যে— যা থাকলে মেন্সট্রুয়াল লিভ, গর্ভকালীন ছুটি, প্রতিপালন ছুটি ইত্যাদি থেকে শুরু করে সামান্য লেডিজ কমন রুম, টয়লেট বা ছিটকিনি লাগানোর দাবি কর্তৃপক্ষের বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে না।
আরও পড়ুন- ফুটপাতের মেয়েটির জন্যেও আমরা গলা ফাটাবো কবে?
নারীদের কর্মক্ষেত্রে যোগদানের ইতিহাস এবং যৌন সুরক্ষা আদায়ের আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘ। একদা নারীশিক্ষার প্রগতিশীল প্রবক্তারা দাবি করছিলেন, 'সুগৃহিণী হতে গেলে সুশিক্ষিতা হওয়া প্রয়োজন।' অর্থাৎ, আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখা, পরিমাণ বুঝে খরচ করা এবং মার্জিত বুদ্ধির প্রয়োগে গুরুজনদের সঙ্গে সু-ব্যবহার করতে পারার জন্য, তথা সুমাতা হওয়ার জন্য নারীর শিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন৷ 'স্ত্রীশিক্ষা' প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথও বলেছেন— "মেয়েদের মানুষ হইতে শিখাইবার জন্য বিশুদ্ধ জ্ঞানের শিক্ষা চাই, কিন্তু তার উপর মেয়েদের মেয়ে হইতে শিখাইবার জন্য যে ব্যবহারিক শিক্ষা তার একটা বিশেষত্ব আছে।" ঠিক এরকম সময়ে বেগম সাখাওয়াৎ হোসেন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন 'মতিচুর' গ্রন্থে—
"উপার্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কী নাই? যে পরিশ্রম আমরা স্বীয় গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসা করিতে পারি না?"
ওই যে পেশা-নির্বাচনের কথা হচ্ছিল, সে বিষয়ে সরলা দেবীকে অগ্রপথিক বলা চলে। মহীশূরের মহারানী গার্লস কলেজে সুপারিন্টেনডেন্টের পদে চাকরি গ্রহণ করেন তিনি। অতদূরে চাকরি করতে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল ঠাকুরবাড়ির অনেকেই। গ্রাহ্য করেননি। রোকেয়া বলেছিলেন— "কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও। নিজেরা অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।" তার বাস্তব উদাহরণ ছিলেন সরলা দেবী।
এর প্রায় একশ বছর পর, সংবিধানে খাতায়-কলমে সাম্য থাকা সত্ত্বেও অনেক অসাম্য পেরিয়ে, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা শুরু হয় ভাঁওরি দেবীর কারণে। ১৯৯২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ক্ষেতে কাজ করছিলেন ভাঁওরি দেবী ও তাঁর স্বামী মোহনলাল। চার গুজ্জর আর এক ব্রাহ্মণ চড়াও হয়ে মোহনলালকে লাঠিপেটা করে ও ভাঁওরিকে গণধর্ষণ করে। আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই ভাঁওরি দেবী রাজস্থান সরকারের নারী উন্নয়ন প্রকল্পে আড়াইশো টাকা মাস-মাইনের ‘সাথিন’। তাঁর কাজ ছিল গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে মহিলাদের (সেই সূত্রে পুরুষদেরও) বোঝানো যে বাল্যবিবাহ খারাপ, গ্রামে উপযুক্ত শৌচ-ব্যবস্থা চাই, মেয়েদের অধিকারটুকু বুঝে নিতে হবে ইত্যাদি। ‘আখা তিজ’ মানে অক্ষয়তৃতীয়া তিথিতে রাজস্থানের গ্রামে গ্রামে সেই সময় ব্যাপক হারে বাল্যবিবাহ হতো। সেই বছর আগে থেকেই সরকার সাথিনদের বলেছিল, যে করেই হোক বাল্যবিবাহ রুখতে হবে। গ্রামের পয়সাওয়ালা গুজ্জর রামকরণের মেয়ের বিয়ে আর নিজের বাড়িতেই নাবালক দেওরের বিয়ে আটকাতে চেয়েছিলেন ভাঁওরি দেবী। অক্ষয় তৃতীয়ায় রামকরণের বাড়িতে পুলিশ এল, শিশুর বিয়ে থামল কিন্তু পরদিনই বিয়ে হলো। পুলিশ লাড্ডুও খেয়ে গিয়েছিল আমন্ত্রিত হয়ে। বিয়ে মিটতে রামকরণ দলবল নিয়ে গণধর্ষণের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় নারীর লজ্জা লুকিয়ে রাখার, কান্না গিলে ফেলার আখ্যান উল্টে দেন ভাঁওরি।
নারী উন্নয়ন প্রকল্পের দিদিদের সাহায্যে তিনি অভিযোগ দায়ের করেন। থানা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র সহযোগিতা করেনি। এরপরেও তিনি গেলেন আদালতে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশের চার্জশিট দিতে এক বছর লেগেছিল। জেলা ও দায়রা আদালতে পিতৃতান্ত্রিক ঘিনঘিনে প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তিন বছর ধরে চলা মামলায় বিচারক পাল্টেছিল ছ’বার। ১৯৯৫-এর ২৫ নভেম্বর আদালতের রায়ে বিনা প্রমাণে খালাস পেয়েছিল পাঁচ অভিযুক্তের প্রত্যেকেই! ভাঁওরি এরপরেও হাইকোর্টে গেছেন। এত বছরে তাঁর মামলার শুনানি হয়েছে মাত্র একবার। তবে পাশে পেয়েছেন জয়পুর ও দিল্লির নারী সংগঠনগুলিকে, পরে সাধারণ মানুষকেও। ১৯৯৪-এ নীরজা ভানোট স্মৃতি পুরস্কার পেয়েছেন, ’৯৫-এ গিয়েছেন বেজিংয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নারী সম্মেলনে কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর মামলার সূত্রেই ১৯৯৭-এ তৈরি হয়েছে যৌন হয়রানি মোকাবিলায় ‘বিশাখা গাইডলাইনস’, পরে ২০১৩ সালে যা রূপ পেয়েছে কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন হয়রানি বিরোধী আইনে।
কী আছে এই গাইডলাইনে? তিনটি বিষয়ের ওপর স্পষ্ট জোর দেওয়া হয়েছে। নিষেধ (প্রহিবিশন), প্রতিরোধ (প্রিভেনশন) এবং প্রতিকার (রিড্রেসাল)। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকায় বলা আছে, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হেনস্থা হলে অভিযোগ কমিটি গঠন করতে হবে। ২০১৩ সালের POSH আইন অনুযায়ী ১০ কিংবা তার বেশি সংখ্যক কর্মী রয়েছে এমন সংস্থার নিয়োগকর্তার ইন্টার্নাল কমপ্লেইন্টস কমিটি বা আইসিসি গঠন করা বাধ্যতামূলক। এই আইনের আওতায় পড়বে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত প্রতিটি মানুষ। একসময় বিশাখা গাইডলাইনে শুধুমাত্র চাকুরিরতা মহিলাদেরই উল্লেখ করা হয়েছিল। পরে যুক্ত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মহিলাদের সমস্যাও। সুতরাং যাঁরা মাঠে-ঘাটে, ইঁটভাটায়, বা নির্মাণ শিল্পে, রাস্তা তৈরিতে কাজ করে থাকেন, দিনমজুরি করেন, তাঁরাও বিশাখা গাইডলাইনের আওতায়। শুধু মহিলা কর্মীরাই নন, বিশেষ কোনও কাজে সংস্থায় এসেছেন এমন মহিলাও এই আইনের আওতায় পড়েন। যৌন হেনস্থার আওতায় কী কী পড়বে তাও বলা হয়েছে এই নির্দেশিকায়:
শারীরিক ছোঁয়া এবং তার থেকে বেশি অবাঞ্ছিত আচরণ,
যৌনতার দাবি,
যৌন মন্তব্য,
পর্নোগ্রাফি দেখতে বাধ্য করা
যে কোনও মৌখিক, শারীরিক, আচরণগত যৌন হেনস্থা, মহিলার যৌন জীবন নিয়ে বারবার প্রশ্ন বা মন্তব্য করা, আপত্তিজনক যৌনতাপূর্ণ এমএমএস, ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ছবি কিংবা পোস্টার দেখানো, যৌন পক্ষপাত দাবি করে কোনও মন্তব্য করা, হুমকি দেওয়া, প্রতিবাদ করলে তার উদ্দেশ্যে যৌন মন্তব্য করা ইত্যাদির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রের পরিসরে ফ্লার্টিং বিষয়েও সতর্ক করা হয়েছে।
কোনও মহিলা কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন বা হয়রানির শিকার হলে তিনি ‘বিশাখা গাইডলাইন’-এর ভিত্তিতে আইনি পদক্ষেপ করতে পারেন। কেবল শারীরিক নয়, মানসিকভাবে নির্যাতিত হলেও আইনি পদক্ষেপ করা সম্ভব। দোষীকে চিহ্নিত করা এবং শাস্তি দেওয়ার নির্দেশও দেয় এই আইনি প্রক্রিয়া। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করার পদ্ধতি নির্ধারণ করে এবং যৌন হয়রানির বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখার কাজ করে এই কমিটি। দেশের যেকোনও সংস্থায় যে কোনও বয়সের মহিলা যৌন হয়রানির শিকার হতে পারেন। তাঁর অভিযোগও যথাযথ গুরুত্ব সহকারে খতিয়ে দেখবে সংশ্লিষ্ট সংস্থার গঠিত এই কমিটি। আইন বলে, যদি ভুক্তভোগী অভিযোগ দায়ের না করতে পারেন, তাহলে ICC-এর কোনও সদস্য তাঁকে লিখিত অভিযোগ করতে সাহায্য করবেন। যদি নিগৃহীতা শারীরিক বা মানসিক অক্ষমতা বা মৃত্যু বা অন্য কোনও কারণে অভিযোগ করতে না পারেন, তবে তাঁর আইনগত উত্তরাধিকারী তা করতে পারেন। তিনমাসের মধ্যে অভিযোগ করা কাম্য। একইসঙ্গে অভিযোগকারী আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। অভিযোগ দায়েরের সময়সীমা বাড়তে পারে বিশেষ ক্ষেত্রে। উক্ত সময়ের মধ্যে মহিলাকে অভিযোগ দায়ের করতে বাধা দিলে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে আদালত।
আইনের সংশোধনীতে রয়েছে, মহিলাদের নিশ্চিত করা উচিত যে, পশ (POSH) আইনের অধীনে বা যেখানেই তারা কাজ করছে সেখানে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকলে সাহস করে বিরোধিতা করার স্পষ্ট উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। সহকর্মীদের উৎসাহিত করতে বলা হয়েছে। কিন্তু যে কর্তৃপক্ষ গাইডলাইন মেনে অভিযোগের তদন্ত করবে, সেখান থেকেই ধর্ষণ-নির্যাতনের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হলে লড়াই কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া অসংগঠিত ক্ষেত্রে, অনেক বেসরকারি ক্ষেত্রে বা পরিযায়ী শ্রমিকদের বেলায় বিশাখা গাইডলাইন সম্পর্কে সচেতনতা এখনও দূর-অস্ত। সরকারি ক্ষেত্রেও, আগেই বলেছি, কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার যথেষ্ট অভাব দেখা যায়।
আরও পড়ুন- ধর্ষণকাণ্ডে শাস্তি ঘোষণা, রাতদখলের আন্দোলন অতীত এবার?
আরজি কর কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর নতুন করে খোঁজ পড়েছে, আইসিসিগুলো চলছে কীভাবে? দেখা যাচ্ছে, আইসিসি সংগঠিত ক্ষেত্রেই নেই, অসংগঠিত ক্ষেত্র তো কোন ছাড়! সরকারি জায়গায় আইসিসি নিয়মবহির্ভূত ভাবে তৈরি। সেখানে অনেক জায়গায় ‘এক্সটার্নাল মেম্বার’ নেই৷ প্রধান করে বসিয়ে রাখা হয়েছে এমন কোনও মহিলাকে যিনি সরকারের ও প্রতিষ্ঠানের বশংবদ তথা সহকর্মী মেয়েদের প্রতি অন্যায়ে মুখ বন্ধ রাখেন। সন্দীপ ঘোষ যেমন নিজে আইসিসি মেম্বার ছিলেন আরজি করে। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে আইসিসি প্রধান অভীক ঘোষের স্ত্রী! আরজি কর ঘটনার পর মেডিক্যাল কলেজগুলোতে যে তদন্ত কমিটি বসেছিল, তাদের কাছে অসংখ্য যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়েছিল। অথচ এখন রাজ্য সরকার এই মর্মে মামলা করেছে যে, ওই তদন্ত কমিটিগুলোর তদন্ত পদ্ধতি ঠিক ছিল না। মানে, যারা একবার সাহস করে মুখ খুলেছিল, তারাও আর মুখ খোলার সাহস পাবে না সরকারি প্রতি-আক্রমণের ভয়ে৷
১৪ অগাস্টের ঐতিহাসিক রাতদখলের পর আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় এক সতেরো দফা সার্কুলার এনেছিলেন। সেটি নাকি মহিলা ডাক্তারদের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সার্কুলার। প্রথমেই মহিলা ডাক্তারদের রাতের ডিউটি কমিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। রাতদখল আন্দোলনের পক্ষ থেকে মেয়েরা যখন রাতে নিরাপদ থাকার দাবি তুলেছেন, ঠিক তখনই এই ১৮০ ডিগ্রি উল্টো বার্তা! তাছাড়া, যে মহিলা রোগিদের রাতে মহিলা ডাক্তারদের প্রয়োজন পড়বে, তাঁরা তবে জরুরি চিকিৎসা পাবেন না? রোগিনী, নার্স, আয়া, হাউস কিপিং, অপারেশন থিয়েটারে রাতে যে মহিলা কর্মীরা কাজ করেন, তাদের কী হবে? যে আশাকর্মীকে রাতে প্রসব যন্ত্রণা উঠলে ছুটে যেতেই হবে, তাঁর? এই সকল কর্মরত মেয়েদের তাহলে নিরাপত্তার প্রয়োজন নেই? ‘রাত্রি সাথী’ অ্যাপ আনার কথা বলা হয়েছিল (যদিও কার্যকরী হয়নি)। তাতে সুরক্ষা দেবে নাকি লোকাল থানা, বিশেষ মহিলা ভলেন্টিয়ার। আবার ১০০/১১২ পুলিশ ডায়াল নম্বরের ব্যাপক ব্যবহারের কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। যেখানে ১০০ ডায়াল, মহিলা থানা, মহিলা কমিশন, ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্ট সব কিছুই অকেজো হয়ে পড়ে থাকে, সেখানে নতুন এই প্রযুক্তিগত দাওয়াই ঠিক কী নতুন সমাধান দিতে পারবে?
সার্কুলারে বিশাখা গাইডলাইন ও লিঙ্গ সংবেদনশীল কর্মশালার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল আলগোছে। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কতটুকু প্রয়োগ হয়েছে কর্মস্থলে যৌন হেনস্থা বিরোধী এই আইনের? তা মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া উচিত ছিল রাজ্য সরকারের, অন্তত আরজি করের ঘটনার পর।
এরপর এল জনরোষ প্রশমনে চটজলদি দাওয়াই অপরাজিতা বিল। মাথায় রাখতে হবে, ধর্ষকের ফাঁসি দিয়ে ধর্ষণ কমেছে, এরকম কোনও তথ্যপ্রমাণ নেই৷ ফাঁসির ‘অব্যর্থ দাওয়াই’-য়ের বদলে আসলে আমাদের চাই শাস্তির নিশ্চয়তা। অর্থাৎ প্রতিজন অপরাধী যেন শাস্তি পায়, রাষ্ট্র যেন অপরাধীকে আড়াল না করে, বিচারব্যবস্থা যেন গড়িমসি না করে এবং মেয়েদের পাশাপাশি যেন রূপান্তরকামী মানুষদের ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের জন্যও যথাবিহিত আইন আসে (বিএনএস-এ অ-যোনিজনিত বলপূর্বক সঙ্গমের বিরুদ্ধে আইন আছে কেবল মেয়েদের জন্য, ট্রান্সক্যুইয়ার মানুষের জন্য নয়)।
অর্থাৎ, যা যা আইন ও পরিকাঠামো আগেই ছিল, তাকে কার্যকর করার দিকেই দৃষ্টি দেওয়া উচিত ছিল। লোকাল থানা, রাজ্য মহিলা কমিশন, বিচার ব্যবস্থা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণমুক্ত কীভাবে হবে,তার রূপরেখা তৈরি হতে পারত। আরজি করে কি যৌন নির্যাতন নিবারক ইন্টারনাল কমপ্লেন্ট কমিটি যথেষ্ট কার্যকর ছিল? মেয়েরা ছোটখাটো নির্যাতনের ঘটনা বলতে পারত? আমাদের নিজেদের কর্মক্ষেত্রে কি তা আছে? কিংবা, একটা ধর্ষণকে খাটো করে দেখল যারা, সেই প্রমাণ-লোপাটকারীদের শাস্তি না হলে কি আদতে ধর্ষণে উৎসাহই দেওয়া হলো না? কাজের পরিসর নারী-ট্রান্স-ক্যুইয়ার বান্ধব করার জন্য যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন শৌচাগার আছে? সেই শৌচাগার রাতে খোলা থাকে? ট্রান্সদের জন্য জেন্ডার নিউট্রাল টয়লেট আদৌ আছে? রাতে মেয়ে-ট্রান্স-ক্যুইয়ারদের জন্য নিরাপদ সরকারি যান চলে? ট্রান্স মানুষদের জন্য যে ট্রান্স বোর্ড গঠন হয়েছিল, তা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল কেন? কেনই বা মহিলা কমিশন সরকারের ধামাধরা তথা নিষ্ক্রিয়? মেয়েরা, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মরত মেয়েরা, কোথায় বাচ্চা রেখে কাজে যাবেন? সরকারি ক্রেশ কি জরুরি নয়? অঙ্গনওয়াড়িকে ক্রেশে পরিণত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, তার কী হলো? আইসিসি নানা কর্মক্ষেত্রে এখনও নিষ্ক্রিয় কেন? আঞ্চলিক স্তরে এলসিসি নেই কেন? আইসিসি, এলসিসি কী তা নিয়ে সাধারণ মেয়ে বা প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার ধারণা গড়ে তুলতেও সরকার বা কর্তৃপক্ষ উৎসাহী নয় কেন? এখনও পথে আলো নেই কেন?
রাতদখল আন্দোলনে নানা পেশায় কর্মরত মেয়ে ও ট্রান্স-ক্যুইয়ার মানুষদের পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতেই উপরিউক্ত প্রশ্নগুলি ও তাদের সমান্তরাল দাবিগুলো উঠেছিল। সেই দাবি সনদ রাতদখল ঐক্যমঞ্চ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জমা দিতে চেয়েছিল। নবান্নে যাওয়া আটকানো হয়েছিল গঙ্গাসাগরের অজুহাতে৷ শেষ পর্যন্ত আদালতে কেস করে আইন দফতর মারফৎ তা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছে রাতদখল ঐক্যমঞ্চ।
১৪ অগাস্ট রাতের সৌন্দর্য এই যে, সে রাতে প্রথমবারের জন্য অভয়ার বিচারের দাবিতে শুধু নয়, নিজের নিরাপত্তাহীনতার কারণে পথে নেমেছিলেন গৃহবধূ ও শিক্ষিকা, আশাকর্মী ও পরিচারিকা, কর্পোরেট কর্মী ও নার্স, পাশাপাশি, হাতে হাত রেখে। অথচ, নানা দশকে নানা নির্মম নির্যাতনের ঘটনার পর কখনও বিশাখা গাইডলাইন, কখনও পশ আইন, কখন ভার্মা কমিশন আমরা পেয়েছি কিন্তু ১৪ অগাস্টের আন্দোলন থেকে মেয়েরা, ট্রান্স, ক্যুইয়ার মানুষরা এখনও সরকারি তরফে কোনও অর্থবহ কমিশন, কোনও উদ্যোগ, কোনও আইনি বদল পায়নি। সরকার তো মেয়ে বা প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের এই আন্দোলনের স্টেকহোল্ডারই ভাবেনি, তাই আলোচনাতেই ডাকেনি। ভেবেছে অপরাজিতা বিল (যা এমনিতেও কখনও পাশ হবে না) নামক খুদকুড়োতেই তারা ধন্য হবে। অথচ কোনও আইনজ্ঞ, কোনও সমাজকর্মী গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করে নারী-সুরক্ষার এমন বিল আনার ঘটনাই নজিরবিহীন। অপরাজিতা বিল কোনওভাবেই কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করে না৷ তা রাক্ষুসে এবং অপরায়িত ধর্ষকের তত্ত্বের ভিত্তিতে আধারিত। অথচ যৌন নির্যাতকরা ছড়িয়ে আছে আমাদের কাজের জগতে, বাড়িতে, সর্বত্র এবং তাদের শিং, লেজ ইত্যাদি নেই, তারা সাধারণ ভব্যদর্শন মানুষ৷ সব ঠগকে ফাঁসি দিয়ে গাঁ উজাড় না করে, চরম ঘটনা ঘটার অপেক্ষা না করে, চাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। সরকার যেহেতু সে পথেই হাঁটছে না, তাই আন্দোলনের দীর্ঘজীবী না হয়ে উপায় নেই।