আদানির পতনে আসলে লাভ হিন্ডেনবার্গের! কেন পশ্চিমী গবেষণাই আজও মান্যতা পায় দেশে?

Hindenburg Research on Adani: কেউ প্রশ্ন তুলছেন না, কেন শেয়ার বাজার পরঞ্জয়দের পাশে দাঁড়াল না, বিশ্বাস করল চরম স্বার্থবাহী এক দ্বিতীয় ধাপের গবেষণায়।

N

আদানিদের বিরুদ্ধে শেয়ার বাজারে বেআইনি কাজকর্ম করা, অনৈতিকভাবে শেয়ারের দাম বাড়ানো, সরকারের অভয়হস্ত মাথায় নিয়ে আইনের পাশ-কাটানো, শুধু আদানিদের স্বার্থপূরণে বড় টেন্ডারে অংশ নেওয়ার শর্ত ঢিলে দেওয়া, অভিজ্ঞতা না থাকলেও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দু' ধরনের বন্দর [জল-আকাশ], খনি, রাস্তা, মোবাইল, বিদ্যুৎ, সবুজ বিদ্যুতের মতো বিশাল বিশাল ক্ষেত্রে প্রবল উপস্থিতি, বিপুল ফান্ড ব্যবহার করে ট্যাক্সহেভেনের অফশোর কোম্পানিগুলোকে কাজে লাগিয়ে শেয়ারের দাম ৯০% বাড়ানোর মতো কয়েকশো অভিযোগ এনেছে আমেরিকার শেয়ার বাজারে শর্ট-সেলার হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ। একটা অভিযোগও নতুন নয়। পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, রবি নায়ারেরা আদানির ক্রোনি চরিত্র বিশ্লেষণ করে, হিন্ডেনবার্গদের বহু আগে একই অভিযোগ তুলেছেন দেশিয় বিদেশি পত্রিকায় চার পাঁচ বছর ধরে।

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ শুধু গত ৫ বছরের আদানিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সমীক্ষা আকারে সাজিয়ে তুলে ধরেছে, নিজেদের মতো করে। পুরনো অভিযোগেই শেয়ার বাজার উথালপাথাল। অথচ পরঞ্জয় রবির বিরুদ্ধে শমন জারি হয়েছে, পরঞ্জয়কে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেছে কর্পোরেটের হুমকি, মানহানির মামলা চলছে শুধু আদানি নয় আম্বানিদের পক্ষ থেকেও। আদানি চোখের পলক না ফেলে এদের বিরুদ্ধে চরম পদক্ষেপ করেছে। পত্রিকায় এদের প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে রেগুলেটরদের তদন্ত চলছে। কিন্তু শেয়ার বাজার এই সব অভিযোগ বিন্দুমাত্র প্রতিক্রিয়া জানায়নি – সরকার বা রেগুলেটর অভিযোগের প্রেক্ষিতে খান দু'য়েক তদন্তের নির্দেশ দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলেছে। বছর তিনেক ধরে চলা তদন্তের কী হাল হলো আমরা কেউই জানি না। শেয়ার বাজার এক পয়সাও ওঠেনি, পড়েনি। বাজার সে সব দেশিয় অভিযোগে নিরুত্তাপ থেকেছে।

আরও পড়ুন- জালিয়াতি করে দেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি? গৌতম আদানির বিরুদ্ধে যে মারাত্মক অভিযোগ সামনে এল

একই অভিযোগ হিন্ডেনবার্গ আনলে আদানিতে চরম অনাস্থা দেখায় খুচরো ক্রেতারা। আদানিকে উদ্ধার করতে বাধ্য হয়ে এগিয়ে আসতে হয় কর্পোরেট পরিবারদের। তার মতো ফার্স্ট জেনারেশন কর্পোরেটের সুবিশাল ২০০০০ কোটি টাকার এফপিও বাজারে পুরোপুরি বিক্রি হবে কিনা, সেই আশঙ্কায় যখন শেয়ার বাজারে রক্তক্ষরণে আদানি গ্রুপের অধিকাংশ শেয়ার মাটি ধরছে দ্রুত, যখন কোম্পানির এফপিও জনগণ দূরস্থান, আদানি কোম্পানির ৫৫%-র বেশি কর্মীই কিনছেন না, জনগণ তাদের বরাদ্দ শেয়ারের ১১%-এর বেশি ছুঁয়ে দেখল না, সেই সময় এক পুরুষের বেশি ব্যবসা করা কর্পোরেট দৈত্য আম্বানি, মিত্তল, জিন্দল পরিবার প্রথম জেনারেশন এক কর্পোরেটকে প্রায় ১০০০০ কোটি টাকা - মোট এফপিওর ৫০% বেলআউট প্যাকেজ দিয়ে, তার পতন বাঁচায়। জনগণ নয় ৪/৫ টি কর্পোরেট পরিবার তাদের পারিবারিক সম্পদ নিয়ে আদানির পাশে দাঁড়াচ্ছে!

গুজরাতি-মাড়োয়াড়ি পুঁজি অধিকাংশ সময় এইভাবেই দুর্দিনে আন্তঃকর্পোরেট দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে এড়িয়েছে। আমাদের আজকের আলোচ্য কর্পোরেট বন্ধুত্ব বা দ্বন্দ্ব নয়– এই রকম দক্ষিণ এশিয় কর্পোরেট ব্যবস্থায় কীভাবে পশ্চিমী আধিপত্যবাদ প্রকট হয় সেটা বোঝা। মাথায় রাখা দরকার, খুচরো বিনিয়োগকারীরা কিন্তু হিন্ডেনবার্গের অভিযোগকে অনেকটাই মান্যতা দিল। বল আদানির কোর্টে। আদানি কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টায় প্রথম পতন ধাক্কা রুখেছে। ভবিষ্যতের জন্য বহু অনুত্তর প্রশ্ন ছেড়ে রেখে তার ২০০০০ কোটি টাকার এফপিও এশিয় কর্পোরেট পরিবারদের– বাজারের ভাষায় নন-ইন্সটিটিউশনাল ইনভেস্টরদের বদান্যতায় আপাতত ওভার সাবস্ক্রাইবড।

অথচ জনগণের সামনে আমেরিকার শর্ট সেলিং কোম্পানি হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ, ফার্মের উদেশ্য অপরিষ্কার রাখেনি। হিন্ডেনবার্গ ঘোষিত শর্ট সেলার। তারা এই ধরনের কর্পোরেট সংস্থার ব্যাপারে রিপোর্ট প্রকাশ করে বড় কোম্পানির শেয়ারের দাম উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে পতন ঘটিয়ে, বাজারের শেয়ার, বন্ড কম মূল্যে কিনে লাভ করে এবং কোম্পানি চালায়। ইওরোপে, চিনে ওরা একই কাণ্ড ঘটিয়ে লাভ করেছে– কোনও কোনও কোম্পানির শেয়ার ছ’মাসে ৯৮% পড়েছে। তবুও তারা নামেই গবেষণা সংস্থা, বিশুদ্ধ অ্যাক্টিভিজমে বিশ্বাসী গবেষণা সংগঠন নয়, মূলত ইনভেস্টমেন্ট ফার্ম। মাথায় রাখবেন, শেয়ার বাজার নিয়ে কাজ করা অধিকাংশ সংগঠনের নিজেদের গবেষণা বিভাগ থাকে, বাজার কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে সেই বিষয় আগেভাগে জানতে, খুচরো বিনিয়োগকারীদের নানান বিষয় আগে থেকেই জানাতে তাদের নিরন্তর গবেষণা চালাতে হয়। হিন্ডেনবার্গ ব্যতিক্রম নয়। তারা কর্পোরেটদের বেনিয়মগুলো সামনে আনে এবং এই কাজে লাভও করে। তাই আদানির শেয়ারের দামের পতনে হিন্ডেনবার্গের লাভের সম্ভাবনা ষোলোআনা। তথ্যটা অনেকেই জানেন। আদানি বা বিজেপি দু'পক্ষের একই অভিযোগ– এফপিওর দিন বাজারে এই সমীক্ষা আনা। তা সত্ত্বেও আদানির বিরুদ্ধে বাজারে ঘুরে বেড়ানো, কেউ পাত্তা না দেওয়া অভিযোগ নতুন করে সাজিয়েগুছিয়ে আনলে আদানির শেয়ারে বেনজির পতন ঘটে। ভারতের বাজারে সব থেকে বড় এফপিও পুরোপুরি বিক্রি হবে কিনা প্রশ্ন ওঠে।

মুম্বইয়ের শেয়ার বাজারের হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার করা বড় বড় দালাল ফার্ম থেকে নিজেদের সঞ্চয় থেকে কয়েক হাজার টাকার শেয়ার কেনা মধ্যবিত্ত বিলক্ষণ জানে হিন্ডেনবার্গ আদানির বিরুদ্ধে বাজারে ভেসে থাকা অভিযোগগুলো নতুন করে এনে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর জনমানসে মান্যতা থাকলেও হিন্ডেনবার্গ লাভের উদ্দেশ্যে এই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে- তারা আপাপবিদ্ধ দেবশিশু নয়। আপাতদৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য পরঞ্জয় বা রবি নায়ারদের ছিল না। কেউ প্রশ্ন তুলছেন না, কেন শেয়ারবাজার পরঞ্জয়দের পাশে দাঁড়াল না, বিশ্বাস করল চরম স্বার্থবাহী ইওরোপিয় এক দ্বিতীয় শ্রেণির গবেষণায়, যেখানে অভিযোগগুলো পরঞ্জয়েরা আগেই তুলে ফেলেছেন? খুচরো বাজার পরঞ্জয়দের নয়, হিন্ডেনবার্গের অভিযোগকে গুরুত্ব দিল। কেন? প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়ার ভাষায়, এটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।

আরও পড়ুন- আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বড় জালিয়াতির অভিযোগ হিন্ডেনবার্গের, কীভাবে করা হয় এই রিসার্চ?

আমরা কারিগর, হকার চাষিদের সংগঠন করি, ভদ্রবিত্তের মানসিক উপনিবেশের বাইরে অনেকটাই থাকি, আমরা জানি এটাই ভদ্রবিত্তের সুগভীর মানসিক উপনিবেশ। কর্পোরেটরা তো মূলত পশ্চিমী দেশগুলির উপনিবেশ হিসেবে কাজ করে। ভদ্রবিত্ত কর্পোরেটের দয়ায় বাঁচে। হিন্ডেনবার্গ কাণ্ডে পরিষ্কার হলো দক্ষিণ এশিয় ভদ্রবিত্তের মনে আজও পশ্চিমী নেতৃত্বের প্রাধান্য অটুট। প্রাক্তন কর্পোরেটেরা ইওরোপ-আমেরিকার প্রধান মুখ– সেই কর্পোরেটের মূল সুবিধাভোগী ভদ্রবিত্ত সমাজ। আজও টাকা মেরে দেউলিয়া হয়ে কর্পোরেটেরা পশ্চিমে আশ্রয় নেয়- দেশের টাকা ইওরোপ আমেরিকায় পাঠায়।

এই আধিপত্যবাদই পশ্চিমের দেশগুলি গত ২৫০ বছর ধরে তৈরি করেছে। আদানি কাণ্ডে এই আধিপত্যবাদ শেকড় ছড়াল ভদ্রবিত্ত সমাজের আরও গভীরে। হিন্ডেনবার্গ কাণ্ড আবার নতুন করে প্রমাণ করল ভদ্রবিত্তের জীবনে জাগরণে চরম সত্য নবজাগরিত পশ্চিমী নেতৃত্ব - বাকি সব ফক্কা।

More Articles