নাকে আসছে পচা মাছের গন্ধ! ইরানে শ'য়ে শ'য়ে স্কুলছাত্রীকে বিষপ্রয়োগ করছে সরকার?

Iran Schoolgirl Poisoning: বিষের প্রয়োগে অসুস্থ হওয়ার আগে ছাত্রীরা নাকি ট্যানজারিন বা পচা মাছের গন্ধ পেয়েছিলেন।

যদি প্রতিবাদীর কণ্ঠ রোধ না করা যায়, তবে প্রতিবাদীকেই নিকেশ করে দেওয়া পথ। যদি অভিযোগের সমাধান না করা যায় তাহলে অভিযোগকারীদেরই খুন করে ফেলা একমাত্র পন্থা! আরও চরমতম পথ হতে পারে, কোনও অভিযোগকারী, প্রতিবাদী প্রজন্মকে জন্মাতেই না দেওয়া। ইরান কি তবে সেই পথেই এগোচ্ছে? গত প্রায় তিনমাস ধরে ইরানের অন্দরের গুঞ্জন স্কুলছাত্রীদের বিষ প্রয়োগ করা হচ্ছে। সারা ইরান জুড়ে ৫০০০ জনেরও বেশি ছাত্রী বিষক্রিয়ার শিকার হয়েছে। সত্যিই কি প্রশাসনের তরফে ছাত্রীদের উপর রাসায়নিক হামলা চালানো হচ্ছে? কেন স্রেফ ছাত্রীদের উপর এই নির্যাতন? দীর্ঘকাল ধরে টুঁটি টিপে রাখা মেয়েদের তবে স্রেফ কণ্ঠরোধ করলেই চলছে না?

প্রথম বিষক্রিয়ার ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে ৩০ নভেম্বর, কোম শহরে। ১৮ জন স্কুল ছাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ তখন থেকে ২৮টি প্রদেশে অন্তত ২৯০টি স্কুলে বিষক্রিয়ার ঘটনা ঘটেছে। ১১ বছরের ছাত্রী ফাতেমেহ রাজেইয়ের বিষক্রিয়ার কারণেই মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। বিষক্রিয়ার ফলে শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব এবং আরও নানা উপসর্গ নিয়ে ওই ছাত্রীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই বিষক্রিয়া থেকে সন্তানকে বাঁচাতে (মেয়ে সন্তান অবশ্যই) অনেক অভিভাবকই আর মেয়েদের স্কুলে পাঠাচ্ছেন না। যত কম জানে, তত বেশি মানের নীতি স্থান-কাল ভেদে অনশ্বর-অটুট থেকে যাচ্ছে। পশ্চিমের লোরেস্তান প্রদেশের বোরুজার্ড শহরের চারটি স্কুলে গত সপ্তাহে অন্তত ১৯৪ জন ছাত্রীকে বিষ দেওয়া হয়েছে। রাজধানী তেহরানের কাছে পারদিসের খৈয়াম গার্লস স্কুলে আরও ৩৭ জন ছাত্রীও বিষের কবলে। বিষের প্রয়োগে অসুস্থ হওয়ার আগে ছাত্রীরা নাকি ট্যানজারিন বা পচা মাছের গন্ধ পেয়েছিলেন।

যুক্তরাজ্যের লিডস ইউনিভার্সিটির টক্সিকোলজিস্ট এবং রাসায়নিক অস্ত্র গবেষক অ্যালাস্টার হে বলেছেন, তিনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাত্রীদের রক্ত পরীক্ষার ফলাফল দেখেছেন। এইভাবে বিষ শনাক্ত করা সবসময় সম্ভব নয়, কারণ রক্ত পরীক্ষা বিভিন্ন ধরনের বিষের প্রভাব দেখায় না। রাসায়নিক জড়িত থাকলে সম্ভবত সেটি ক্লোরামাইন, জানিয়েছেন ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্সের জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নবিদ কিথ ওয়ার্ড। ব্লিচ যুক্ত কোনও ক্লিনিং পণ্যের সঙ্গে অ্যামোনিয়া যুক্ত ক্লিনিং পণ্য মিশিয়ে ক্লোরামাইন উত্পাদিত হয়।

রাসায়নিক হামলার জন্য ইসলামিক শাসনকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা, একাংশ আবার বলছেন এ নিতান্তই 'গণ হিস্টিরিয়া'। বিবিসির এক প্রতিবেদন বলছে, মূলত স্কুলের ছাত্রীদের মধ্যে এই বিষক্রিয়ার ঘটনা আসলে 'গণ সামাজিক অসুস্থতা' যা কোনও সুস্পষ্ট 'বায়োমেডিকাল' কারণ ছাড়াই একটি গোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কেনই বা বিষ দেওয়া হচ্ছে? বিষক্রিয়ার ঘটনা এযাবৎ শুধুমাত্র মেয়েদের স্কুলগুলিতেই ঘটেছে৷ ইরানের স্কুলগুলিতে লিঙ্গভেদ অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও সাধারণ অভ্যাস, ছেলে এবং মেয়েরা এখানে আলাদা আলাদা স্কুলে যায়। বিষক্রিয়া শুধুমাত্র স্কুলছাত্রীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, স্কুলের কর্মচারী এবং শিক্ষকরাও প্রভাবিত হয়েছেন। চিকিত্সকদের একাংশ এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কিছুজন বলছেন, বিষক্রিয়াকে 'সামাজিক অসুস্থতা' বললেই সত্য চাপা যায় না। দেশব্যাপী স্কুলছাত্রীদের বিষ দেওয়া হচ্ছে, কোনও নির্দিষ্ট শহর বা স্কুলের ছাত্রীরা এর লক্ষ্য নয়। বিষক্রিয়া কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং প্রশাসনের নির্দিষ্ট এক কর্মসূচি।

আরও পড়ুন- মাথা নত স্বৈরতন্ত্রের, কট্টর ইরানে নিষিদ্ধ হল নীতিপুলিশ! আর হিজাব?

সমাজ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান জুড়ে চলা নানা বিক্ষোভে কিশোর-কিশোরীদের অংশগ্রহণ কমাতে শাসকদল বিষ দিয়ে দেওয়ার পথে হাঁটছে। বিশেষ করে ইরানে মেয়েদের আন্দোলন, মেয়েদের বিক্ষোভকে একেবারে নির্মূল করে দিতে এই বীভৎস পরিকল্পনা রাষ্ট্রের। মহিলাদের বিরুদ্ধে শাসকদলের প্রতিশোধ নেওয়ার ঘটনা এই প্রথম নয়। ১৯৭৯ সালে যখন আয়াতুল্লাহ খোমেনি ক্ষমতায় আসেন, তিনি শরিয়া আইন (ইসলামী আইন) জারি করেন এবং মহিলাদের জন্য 'উপযুক্ত' পোশাক বিধি চালু করেন। 'জয়নাবের বোন' নামে একটি দল তৈরি করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে মহিলাদের উপর তীব্র নজরদারি চালানো হতো। প্রকাশ্যে, এমনকী ব্যক্তিগত স্থানেও মহিলাদের উপস্থিতি ও কাজকর্মের উপর নজর রাখত এই দল।

এই ধরনের বৈষম্যমূলক কানুন মেনে নেননি মহিলারা। ১৯৭৯ সালের ৮ মার্চ, খোমেনির আইনের বিরোধিতা করে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেন মহিলারা। এত বড় 'স্পর্ধা' ধাতে সয়নি শাসকের। মহিলাদের আন্দোলন দমনে চরম হিংসার নজির দেখে বিশ্ব। হিজাব পরতে অগ্রাহ্য করা মহিলাদের জন্য আইন করে ৭৪ ঘা চাবুকের শাস্তি জারি করে দেশ।

মহিলা ও পুরুষকে আলাদা করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছেলে আর মেয়েদের ক্লাস ভাগ করে দেওয়া হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি এবং আইন সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের পড়াশোনা নিষিদ্ধ করা হয়। বিচারক এবং সঙ্গীত ও গানের দলগুলির মতো নির্দিষ্ট পেশা থেকেও মহিলাদের বাদ দেওয়া হয়। খেলাধুলোয় মহিলাদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়, এমনকী পুরুষ খেলোয়াড়দের দেখাও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। খেলার মাঠ এবং কিছু নির্দিষ্ট ধরনের বিনোদনে অংশগ্রহণ করতেও বাধা দেওয়া হয় মহিলাদের। আগুনকে চাপা দিলে সে তত বেশি পোড়াতে চায়। এই ভয় দেখানো শাসকের কাছে নতি স্বীকার করেননি মহিলারা। প্রতিবাদ করেছেন, লড়েছেন, মরেছেন। যত মরেছেন, তত হিংস্র হয়েছে শাসক।

হাশেমি রাফসানজানি বলেছিলেন, "দুঃখের বিষয়, তাদের চুল এবং শরীর যে পুরুষরা দেখে ফেলতে পারে সেই বিষয়ে কিছু মহিলা উদাসীন। আমরা হিজবুল্লাহকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে, এই মহিলারা মানুষের মতো আচরণ করবে, কিন্তু মনে হয় না তাদের এসবের কোনও ইচ্ছা আছে।” এর কিছু পরেই, আনসার হিজবুল্লাহ সদস্যরা রাস্তায় নেমে আসে এবং ইসলামিক পোশাকবিধি মেনে না চলা মহিলাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক হিংসার পথে নামে। অসংখ্য মহিলাকে বন্দি করা হয়, অপহরণ করা হয় এবং হত্যাও করা হয়।

আরও পড়ুন- কেন ইনকিলাব ধ্বনি দিচ্ছেন ইরানের মেয়েরা! কীভাবে পাড়ি দিল ভগতের স্লোগান

১৯৯৭ সালে সংস্কারপন্থী মহম্মদ খাতামি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ঠিকই, তবে অবস্থা বদলায় না মেয়েদের। ২০১৪ সালের অক্টোবরে সঠিকভাবে হিজাব না পরা মহিলাদের উপর অ্যাসিড হামলা চালায় আনসার হিজবুল্লাহেরর একটি দল। মুখ এবং হাত মারাত্মকভাবে পুড়ে যায় বহু মহিলার। একজন মহিলার মৃত্যুও ঘটে। তবু দমেননি মেয়েরা। আন্দোলনের আঁচ বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, ভেতরেও, প্রকাশ্যেও।

২০১৪ সালে, মাই স্টিলথি ফ্রিডম নামে পরিচিত এক অনলাইন সামাজিক আন্দোলন দেখা দেয়। যাতে মহিলারা হিজাব ছাড়াই সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেদের ছবি শেয়ার করতে থাকেন। বিশিষ্ট ইরানি-আমেরিকান সমাজকর্মী মাসিহ আলিনেজাদ, বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে #WhiteWednesdays হ্যাশট্যাগ ব্যবহার শুরু করেন। ২০১৭ সালে, নারী অধিকার কর্মী ভিদা মোভাহেদ এই আন্দোলনটিকে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সরিয়ে নিয়ে রাস্তায় নামেন। মধ্য তেহরানের রেভল্যুশন স্ট্রিটের (খিয়াবান-ই-ইংহেলাব) একটি প্ল্যাটফর্মে চেপে মাথার স্কার্ফ খুলে ফেলে হাওয়াতে ওড়ান তিনি। নারী অধিকারের সমর্থনে গার্লস অব রেভলিউশন স্ট্রিট নামে এক আন্দোলনের জন্ম দেন তিনি। এই আন্দোলন যত ছড়িয়ে পড়ে ততই নৃশংস হয় শাসক। আয়াতুল্লাহ খামেনি আনসার হিজবুল্লাহ বাহিনীকে এই মহিলাদের প্রকাশ্যে গুলি করার অনুমতি দেয়।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মাহসা আমিনির গ্রেফতারি এবং মৃত্যু দেশব্যাপী ব্যাপক বিদ্রোহের জন্ম দেয়। সেই আন্দোলন দমন করতে, ৭৫ জন শিশু সহ ৫২৭ জনেরও বেশি তরুণ তরুণীকে হত্যা করেছে শাসন। এই দীর্ঘ দমন পীড়নের খাতায় নতুন জুড়েছে বিষক্রিয়া।

More Articles