রামমন্দির: গণতন্ত্রের কবরে ধর্মতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা
Mandir Politics: রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে ভারতে মন্দির রাজনীতির পথ আরও প্রশস্ত হল বলেই মনে করছেন কেউ কেউ। এতদিন ভারতে হিন্দুত্বের রাজনীতিকরণ দেখেছেন মানুষ। এখন দেখছেন রাজনীতির হিন্দুত্বকরণ।
২০২৪-এর নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। নির্বাচনী তোড়জোড়ের মাঝেই ২২ জানুয়ারি অযোধ্যার রামমন্দিরে 'প্রাণপ্রতিষ্ঠা' উৎসব হতে চলেছে। রামমন্দিরকে কেন্দ্র করে ভারতে মন্দির রাজনীতির পথ আরও প্রশস্ত হল বলেই মনে করছেন কেউ কেউ। এতদিন ভারতে হিন্দুত্বের রাজনীতিকরণ দেখেছেন মানুষ। এখন দেখছেন রাজনীতির হিন্দুত্বকরণ।
লোকসভা নির্বাচনকে মাথায় রেখে একই পথে হাঁটছেন বিরোধীরাও। সব দলের পাখির চোখ হিন্দু ভোট।
অযোধ্যার রামমন্দিরে 'প্রাণপ্রতিষ্ঠা' অনুষ্ঠানের আগেই হয়ে গেল পুরীর 'শ্রীমন্দির পরিক্রমা' প্রকল্পের উদ্বোধন। বুধবার এই ৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক, পুরী দিব্যসিংহ দেবের গজপতি মহারাজ সহ আরও অনেকেই। ৭৫ মিটারের এই ঐতিহ্য পথে রয়েছে গ্রিন বাফার জোন, জগন্নাম ধর্মশালা, ফুটপাথ ও বহুতল গাড়ি পার্কিং। ৬০০০ ভক্ত একসঙ্গে উপাসনা করতে পারবেন, এমন একটি চত্বরও রয়েছে।
এ'দিকে আম আদমি পার্টি বলছে, প্রতি মাসের প্রথম মঙ্গলবার দিল্লির ৭০টি বিধানসভা কেন্দ্রেই এখন থেকে রামায়ণ পাঠ হবে। এই মঙ্গলবার রোহিনীর একটি মন্দিরে রামায়ণের সুন্দরকাণ্ড পাঠ শুনতে গিয়েছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
ওড়িশা এবং দিল্লির পথে পা বাড়িয়েছে বাংলাও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি জানিয়েছেন, তিন-চার মাসের মধ্যে দীঘায় মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হতে চলেছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলেই তৈরি হচ্ছে দীঘার মন্দিরটি। মন্দিরে থাকছে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মার্বেল প্রতিমা। তৈরি হয়েছে জগন্নাথ দেবের মাসির বাড়িটিও। শোনা যাচ্ছে, পুরীর ধাঁচেই রথযাত্রা হবে দীঘায়। রথযাত্রার জন্য ব্রহ্মপুর মৌজায় জগন্নাথ মন্দির থেকে তাঁর মাসির বাড়ি পর্যন্ত ৭ মিটার চওড়া রাস্তাটি ১৪ মিটার প্রশস্ত করা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গতবছর থেকে পশ্চিমবঙ্গে গঙ্গা আরতিও শুরু হয়েছে।
আরও পড়ুন : রামমন্দির চত্বরে ঘুরছেন থর, আয়রনম্যানেরা! দেখে ঘুম উড়ল অযোধ্যাবাসীর
রামমন্দিরে 'প্রাণপ্রতিষ্ঠা' যেন ধর্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই। তাতে যথারীতি সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। অনুষ্ঠানের আগে কৃচ্ছসাধন করছেন তিনি। খাদ্য বলতে কেবল নারকেলের জল। শুচ্ছেন ভূমিশয্যায়। এগারো দিন এই 'যম নিয়ম' পালন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
আমাদের প্রশ্ন, মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীরা কি ধর্মগুরু? ধর্মাচরণের পাঠ দেওয়াই তাঁদের কাজ? নেহরু থেকে মনমোহন—ভারতের ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনও প্রধানমন্ত্রীকে এই ভূমিকায় দেখা গিয়েছে? জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমজনতাকে ধর্মাচরণের পাঠ দিয়েছিলেন?
ধর্মাচরণের পাঠ দেওয়া, কৃচ্ছসাধনকে মহিমান্বিত করা—এ'সব কি আসলে হিন্দুভোট একত্রিত করার কৌশল নয়? এতে কি ভারতের গণতন্ত্র ক্রমশ ধর্মতন্ত্রে পরিণত হচ্ছে না? প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দল যেন ধর্মীয় দল হয়ে উঠছে। নেতারা যদি শুধু ধর্ম ধর্ম করেন, তবে শিক্ষার কথা কে বলবে? স্বাস্থ্যের কথা কে বলবে? কর্মসংস্থানের কথা কে বলবে? তবে কি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলির মতোই ধর্মগুরুদের শাসন শুরু হল ভারতে?
ভারতবর্ষের মতো দেশে কোনও একটি ধর্মের দামামা বাজানো কি অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের এই বার্তা দেওয়া নয়, যে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক? প্রধানমন্ত্রীর ধর্ম রাজধর্ম। তিনি যখন তা পালন করছেন না, তাতে কি আখেরে গণতন্ত্রই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না?
এই নিয়ে প্রশ্ন করার দায়িত্ব ছিল যাদের, সেই গণমাধ্যম এখন রামমন্দিরের 'প্রাণপ্রতিষ্ঠা' অনুষ্ঠানের উদযাপন সম্প্রচারে ব্যস্ত।
প্রশ্নহীন আনুগত্যে ভরা ধর্মরাষ্ট্রে সহনাগরিককে অপর করে এক নম্বর হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন আপনি? এই দেশ কি কেবলমাত্র একের? এই আচরণই কি আদতে দেশদ্রোহিতা নয়? রইল বিশেষজ্ঞদের মতামত।
সম্বিত পাল, অধ্যাপক-সাংবাদিক
শুধু মাত্র নরেন্দ্র মোদী নন, বিরোধী নেতারাও হিন্দুত্বের রাজনীতি করছেন। এ'টাই আরএসএস-বিজেপি চেয়েছিল। বিবিধের মাঝে মিলনের যে শিক্ষা আমাদের ছিল, তা আজ আর কিছু অবশিষ্ট নেই। ২২ জানুয়ারি রামমন্দিরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিন্তু সমগ্র ভারতবর্ষে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটছে চলেছে। যে ভারতবর্ষকে আমরা দেখেছি, সেই গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষ আর থাকবে না। বাবরি মসজিদ নিয়ে এখন আর কথা বলছে না কেন কেউ? মসজিদ ভাঙা কিন্তু সমর্থন করেনি সর্বোচ্চ আদালত। আর্কেওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া প্রমাণ করতে পারেনি যে ওই জায়গায় আগে মন্দির ছিল। তবে কেন স্বাধীন ভারতে সেই জায়গাতে রামমন্দির করার প্রতিবাদ হচ্ছে না? এখানেই বিজেপির সাফল্য। এই পরিবর্তন আনতে পারাটাই নরেন্দ্র মোদীর কৃতিত্ব। কেন দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন বিরোধী নেতারা? শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিয়ে আজ আর কেউ আলোচনা করছেন না কেন? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, কেজরিওয়ালের মতো বিরোধীরাও আজ মন্দির রাজনীতির শরিক। এও বিজেপির কৃতিত্ব।
আরও পড়ুন : ক্লাস টু-এর ইংরেজিও পড়তে পারে না গ্রামীণ ভারতের ছেলেমেয়েরা! বিস্ফোরক তথ্য সমীক্ষায়
বিজেপির ম্যানিফেস্টোতে যে প্রতিশ্রুতির তালিকা ছিল, একে একে পূরণ করছেন নরেন্দ্র মোদী। ভারতবর্ষকে বহুত্ববাদের থেকে ক্রমাগত একত্ববাদের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিরোধী স্বর নেই। একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে একরকম। নেহরুর ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তায় ভাঙন ধরেছে। এতে কংগ্রেসের অবদানও রয়েছে। নেহরুর নীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে এসেছে তারাই। সেই সুযোগ সম্পূর্ণ ব্যবহার করেছে বিজেপি। হিন্দুদের মধ্যে ক্রমাগত প্রচারে প্রচারে একটা মেকী নিরাপত্তাহীনতা ঢুকিয়ে দেওয়া গিয়েছে। তাই আজ মানুষের বুনিয়াদি চাহিদাগুলো নিয়ে আর কেউ ভাবিত নয়। মসজিদ ভেঙে রামমন্দির নির্মাণ হচ্ছে গর্বের সঙ্গে। এবং এতে আমাদেরও অবদান রয়েছে।
রামমন্দির নেতাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা সবার সামনে তুলে ধরেছে। বিরোধিতা যাঁরা করবেন, তাঁরা নিজস্ব প্রতিনিধি পাচ্ছেন না। একটিও বিরোধী দল সেই জায়গায় নেই। সবাই মন্দির রাজনীতি করছে। মধ্যপন্থা ব্যাপারটাই উঠে গিয়েছে। শুধুমাত্র মেরুকরণ হয়ে চলেছে। ছাত্র রাজনীতি আজ শেষ হয়ে গিয়েছে। যে সময় ছাত্ররা গণতন্ত্রের পাঠ পায়, মতামত গঠন হয়, সেই জায়গাটাই শেষ করে দেওয়া হয়েছে। এই চর্চার জায়গাটা সফলভাবে ভেঙে দিয়েছে বিজেপি। ফলে, বিক্ষুব্ধ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারছেন না।
সুমন ভট্টাচার্য, সাংবাদিক
৯২-এর ৬ ডিসেম্বরের আগের ভারতবর্ষ ও পরের ভারতবর্ষের মধ্যে একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে। নেহরুর মডেলে একজন জননেতা ধর্ম মানবেন কিনা, তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু বাবরি ধ্বংসের পর বিষয়টা অন্যদিকে মোড় নিল। আডবানি থেকে মোদী—ধারাবাহিক ভাবে এই পরিবর্তনটা হয়েছে। বিজেপি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে, পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষতা আর প্রাচ্যের ধর্মনিরপেক্ষতা এক নয়। আমাদের সমাজটা বদলে গিয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে বৌদ্ধিক চর্চা এখন আর নেই। ঘৃণাসূচক কথা বলার আগে এখন আর কেউ দু'বার ভাবেন? সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়গুলো খুব স্বাভাবিক করে তোলা গেছে।
আরও পড়ুন : মোদি মূর্তি ছোঁবেন, তাই শঙ্করাচার্যরাই যাবেন না রাম মন্দিরের অনুষ্ঠানে! কেন?
নরেন্দ্র মোদীর কাছে দুটো সুবিধা ছিল, যা আডবানি পাননি। এক, ওঁর কাছে একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। আডবানির তা ছিল না। দুই, গোটা বিশ্ব জুড়ে একই ধরনের শাসকেরা এসে গিয়েছিলেন। আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প, ইউরোপেও সংখ্যালঘুবিদ্বেষী নেতা-নেত্রীরা উঠে এসেছিলেন। ফলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবেশে একটা আমূল পরিবর্তন এল। তার প্রভাব ছিল। যে কোনও আধুনিক রাষ্ট্রে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হওয়া উচিত। কিন্তু আজ ধর্মাচরণ আর ব্যক্তিগত বিষয় নয়। সেটা দেখনদারি হয়ে গিয়েছে। এতে কংগ্রেসেরও অবদান আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে বামপন্থী সমর্থকদের একটা বড় অংশ বিজেপির দিকে চলে গেল। উদ্বাস্তু পরিবারগুলি বিজেপি সমর্থক হয়ে গেল। ভারতের কোনও সিনেমায় আজ নায়ক-নায়িকারা সাধারণ মানুষ নন। ট্রেড ইউনিয়নের নেতা আজ কোনও ছবিতে দেখা যায় না। হনুমান চল্লিশা আগেও লোকে পড়তেন। তাতে সমস্যা ছিল না। সমস্যা গর্বের সঙ্গে সে'টাকে প্রচার করা। এই দেখনদারিটাকেই আজ ধর্মাচারণ বলে প্রতিষ্ঠা করা গিয়েছে।
এখন নেতাদের হিন্দুত্ব নিয়ে রাজনীতি করাটাই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। বিজেপি বিরোধী স্বর খুব বলিষ্ঠ নয়। তেমন ভাবে এই রাজনীতির বিরোধিতা করতে পারছেন না কেউ।